নতুন ধারণা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কারে এগিয়ে আসতে হবে
অধ্যাপক ড. আকমল হোসেন
প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫:৪৮ পিএম
৫ আগস্ট রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর সমাজের নানা স্তরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংস্কার, বদল, পরিবর্তন, আগের সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি উঠেছে। এটা স্বাভাবিক যেহেতু আগের শাসকদের সময় নিয়ম না মেনে, মেধাকে অবজ্ঞা করে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পদে পন্থীবাজদের বসানো হয়েছিল তাই আজকে পরিবর্তনের দাবি জোরদার হচ্ছে।
রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচার করতে গিয়ে হরেদরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ বাছাই করে রাজনৈতিক বিরোধীদের কোনঠাসা করা হয়েছে। সরকারের অন্যায়ের বিরোধিতা মানেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী বলে একটা গতানুগতিক (cliche) প্রচার হয়েছে। নানা প্রতিষ্ঠানের নামকরণে দৃষ্টিকটুভাবে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের পিতা, মাতা, দাদা-দাদী, ভাইবোন এবং নিজের নাম ব্যবহার সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
৫ আগস্টের পরিবর্তনকে রাষ্ট্র সংস্কার করার সুযোগ বলছেন আন্দোলনকারীরা। বিপ্লবও বলছেন। বিপ্লব মানে তো পুরান কাঠামো ভেঙ্গে নতুন করে সমাজ তৈরির পথ অনুসন্ধান করা। কিন্ত যারা এখন রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন তারা কী বলছেন আমরা জানিনা। তাদের কর্মসূচী কী তা বলেননি এখনও। তারা এসব কাঠামোগত পরিবর্তন করার চিন্তার মানুষ কীনা সে প্রশ্নও আছে। তবে তারা নিশ্চয় রাষ্ট্রীয় কিছু প্রতিষ্ঠান সংস্কার এবং শাসনতন্ত্র, অন্যান্য আইন, বিধিবিধান পরিবর্তন করতে চাইবেন।
আমার কর্মক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বলে আমি সেই প্রতিষ্ঠান নিয়ে কিছু কথা বলতে পারি।
সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে উপাচার্যদের মধ্যে পদত্যাগের হিড়িক চলছে। সব সরকারের সময় নিয়ন্ত্রণের একটা জায়গা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার এ স্থানে সরকার তার মাস্তান ছাত্রসংগঠন দিয়ে নিরীহ ছাত্রদের উপর যে মাত্রায় নির্যাতন চালিয়েছে তা সবাই জানে। এখানে উপাচার্যসহ শিক্ষকরা গুরু হিসাবে তাদের কাছে মান্য। কিন্তু গত দেড় দশক বা তার আগেও তারা সে ভূমিকা পালন করেছেন?
বর্তমানে কেউ ভাবছেন ভালো উপাচার্য নিয়োগ করা গেলে সমস্যার সমাধান হবে। আমার প্রশ্ন--তাই কি? সমস্যা কি উপাচার্য, উপ-উপাচার্য নিয়োগের মধ্যে খুঁজতে হবে!
রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কীভাবে পরিবর্তন হবে? বাংলাদেশ রাষ্ট্র যে পরিমান অগণতান্ত্রিক হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তার সাথে মিল রেখে স্বেচ্ছাচারি ও জবাবদিহিহীন প্রতিষ্ঠানে পরিনত হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের কথা পাকিস্তান যুগে শিক্ষকদের মুখে উচ্চারিত হয়েছে কী পড়াব তার স্বাধীনতার আকাক্ষার কারণে। ১৯৭৩ অধ্যাদেশ প্রদান তখনকার সরকারের প্রথম কাজের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাতে academic freedom এর সাথে শিক্ষকরা যাতে নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয় নিজেরা পরিচালনা করতে পারেন তার অবকাশ তৈরি করা হয়েছিল।
ঢাবিতে আমার প্রায় সাইত্রিশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে এ দুটি লক্ষ পূরণ হয়েছে বলে আমি নিশ্চিত নই। পঠন-পাঠনের বেলায় শিক্ষকরা এতটা স্বাধীন থাকেন যে তিনি কতদিন শ্রেণীকক্ষে এসেছেন তার জবাবদিহি করতে বাধ্য নন। বছরের বড় সময় গবেষণা-সেমিনারের নামে বিদেশে থাকায় তার শিক্ষার্থীরা যে তার অধীত জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তা তার দেখার বিষয় না? সময় মতো শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করা তো আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। একজন শিক্ষক তো রাজনীতিতেও ব্যস্ত। তাকে তাহলে এত কিছু করা কীভাব সম্ভব! তবে তাতে পদোন্নতি থেমে থাকেনি!
অস্বস্তি লাগছে উল্লেখ করতে যে বর্তমান শিক্ষা উপদেষ্টা খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ হয়েও ক্লাশে পাঠদানে অনিয়মিত ছিলেন বলে অভিযোগ ছিল। একজন শিক্ষক অনেক বড় পন্ডিত বা নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী হলেও ক্লাস নেওয়া, শিক্ষার্থীদের সময় মতো মূল্যায়নের বেলায় যদি শিথিলতা দেখান তাহলে তার শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হয়।
একজন শিক্ষকের জবাবদিহিতা আমার মতে প্রথমে তার নিজের কাছে, তারপর বিভাগীয়/বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে। শুনতে অপ্রিয় হলেও বলব যে ১৯৭৩ এর অধ্যাদেশ আমাদের দায়িত্বহীন ব্যক্তিতে পরিণত করেছে।
অধ্যাদেশ শিক্ষকদের বছর জুড়ে বিভিন্ন নির্বাচনে ব্যস্ত রাখে (ছাত্র সংসদের নির্বাচন নিয়ে তাদের মাথা ঘামাতে দেখা যায় না)। কোন নির্বাচিত পদ incumbent ব্যক্তির পদোন্নতি কারণে শূণ্য হলে ঐ পদে উপ নির্বাচন না করে একই ব্যক্তিকে রেখে দিয়ে অধ্যাদেশকে লঙঘন করতে দেখা যায়।
সিন্ডিকেটে প্রভাষক থেকে সহযোগী পদের বেলায় এ অনিয়ম বেশি হয়ে থাকে। প্যানেলের মাধ্যমে উপাচার্য নির্বাচন না করে সরকারের নিয়োগ করা উপাচার্যকে বছর বছর মেনে নেওয়া- এসব অধ্যাদেশ লঙঘনের কিছু উদাহরণ।
নানা সময় সরকারের হস্তক্ষেপ মেনে আর যাই হোক স্বায়ত্তশাসন নিয়ে বড়াই করা যায় না। শিক্ষকদের নানা বর্ণগুলো আদতে ক্ষমতায় থাকা বা বিপক্ষের রাজনৈতিক দলের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা হিসাবে চিহ্নিত করলে ভালো হয়। দলদাস শিক্ষকদের উৎপত্তি এখান থেকে। বিভিন্ন পদ পাওয়ার জন্য দলের পায়রবি করার মাত্রা ক্রমান্বয়ে বেড়েছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটা অংশ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়কে বঞ্চিত করে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ দেওয়ার সাথে নানা নামে কাজে-অকাজের (প্রায়োগিক অর্থে) বিষয়ে ইভিনিং বা বিশেষ কোর্স চালু করে অর্থাগমের এক নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন অনেক বছর ধরে।
নতুন করে শুরু করা এত সহজ বলে মনে হয় না। রাষ্ট্রের মাথায় যা আছেন তারা কারা? তাদের কি জ্ঞানবিতরণকারী না দলবাজ শিক্ষক দরকার তা ঠিক করতে হবে। শিক্ষকদের ঠিক করতে হবে যে তারা কি পড়াবেন বেশি এবং রাজনীতি কম করবেন (দলীয় না)? রাজনৈতিক দলগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্তান না বানিয়ে বিবেকবান নীতিনিষ্ঠ শিক্ষার্থী বানাবে কীনা তা ঠিক করতে হবে।
অনেক বছর আগে আমার এক লেখায় '৭৩ অধ্যাদেশকে review করার প্রস্তাব করেছিলাম। শিক্ষকরা কেউ সাড়া দেননি। আমি আবারও সে প্রস্তাব করছি। অধ্যাদেশ প্রণয়নের পর পাঁচ দশক পেরিয়ে গেছে। নতুন ধারণা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কারে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক: অধ্যাপক ড. আকমল হোসেন, (অব) শিক্ষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাবি