বাংলাদেশে ডক্টর অফ বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ডিবিএ) ডিগ্রি ও তার বাস্তবতা
ড. মো. আবু জাফর সাদেক
প্রকাশ: ১৮ আগস্ট ২০২৪, ০৫:২৭ পিএম
যে কোনো পেশার উৎকর্ষ সাধনে গবেষণা অপরিহার্য। গবেষণার জন্য প্রয়োজন বিশেষায়িত জ্ঞান যা অধিকতর বা উচ্চ-শিক্ষার মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। পরিবর্তনশীল বিশ্ব-ব্যবস্থায় ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ একদিকে প্রতিদ্বন্তিতাপূর্ণ বাজার অন্য দিকে প্রযুক্তির দ্রুত আধুনিকায়ন। ব্যবসায়িক বিশ্বে আজকে যা নতুন কালকে তা পুরাতন হলেও অবাক করার কিছু নেই। অর্থাৎ ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া হওয়া উচিত গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে।
ব্যবসায়িক গবেষণার জন্য সারা দুনিয়ায় হাজার হাজার গবেষণা ফার্ম গড়ে উঠেছে, যাদের কাজই হলো অন্য প্রতিষ্ঠানের হয়ে গবেষণা করে তার ফলাফল উপস্থাপন করা। বাংলাদেশে এমন গবেষণা প্রতিষ্ঠান নেহায়েত কম নয়। তৃতীয়পক্ষের উপর নির্ভরশীল এই প্রক্রিয়া আপাত দৃষ্টিতে ভালো মনে হলেও তাতে গোপনীয়তার বিষয়টি নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে যায়। তাই বড় বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলি উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী নির্বাহীদের গবেষণাধর্মী পড়াশোনার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করে এবং উচ্চ-শিক্ষালাভের জন্য অর্থ বিনিয়োগ করে।
এমন বাস্তবতায় গবেষণা ভিত্তিক ব্যবসায়িক জ্ঞান দানের নিমিত্তে ১৯৯০-এর দশকে সুনির্দৃষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞতা ও ভালো একাডেমিক ক্যারিয়ার সম্পন্ন নির্বাহীদের জন্য পশ্চিমাবিশ্বে চালুহয় ডক্টর অফ বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ডিবিএ)-ডিগ্রী।
প্রাথমিকভাবে পশ্চিমাবিশ্বে থাকলেও প্রয়োজনীয়তার নিরিখে দুনিয়ার সব বড় বড় বিজনেস স্কুল ডিবিএ-ডিগ্রী প্রদান শুরু করে। বর্তমানে মার্কিন মুল্লুকের ৪০টি, যুক্তরাজ্যের ৩০টি, অস্ট্রেলিয়ার ২০টি বিশ্ববিদ্যালয় বা বিজনেস স্কুল হতে ডিবিএ-ডিগ্রী প্রদান করা হয়। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের নামকরা ব্যবসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ বিজনেস ম্যানেজমেন্ট (আইআইবিএম) এবং ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট স্টাডি (আইআইএমএস)-সহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান ডিবিএ-ডিগ্রী প্রদান করে।
এসবের পাশাপাশি ভারতে বেসরকারি পর্যায়ে ও অনলাইনে ডিবিএ-ডিগ্রী প্রদান স্বীকৃত। পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ এডুকেশন নেটওয়ার্ক নামে পরিচিত পাঞ্জাব কলেজসহ অনেক নামকরা প্রতিষ্ঠান হতে ডিবিএ-ডিগ্রী প্রদান করা হয় যা পৃথিবীজুড়ে স্বীকৃত।
অতিসম্প্রতি হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের ডিন ড. নিতিন নড়িয়া বলেন, আমরা আমাদের ডিবিএ-গ্রাজুয়েটদের ঐতিহ্য ও অর্জনকে অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখি যেহেতু নতুন প্রজন্মের হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল-এর ডক্টরাল ছাত্রছাত্রীদের সফলতা ও গবেষণার ফলাফলের কার্যকরী ব্যবহারের উপর জোর দিচ্ছি।
ওয়াররিংটোন কলেজ অফ বিজনেস, ইউনিভার্সিটি অফ ফ্লোরিডা-এর মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক এবং বিজনেস এনালিটিক্স ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সেন্টার-এর পরিচালক ড. জিম হোভারসহ অনেক প্রসিদ্ধ ও সফল একাডেমিসিয়ান আছেন যারা শিক্ষা জীবনে ডিবিএ-ডিগ্রী লাভ করেছেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ডিবিএ ও পিএইচডি ডিগ্রীর মূলতফাৎ হলো ডিবিএ-ডিগ্রীর ক্ষেত্র অতিমাত্রায় ব্যবহারিক এবং এর মাধ্যমে যে কোনো কিছুর ব্যবসায়িক মূল্য নির্ধারণ করা হয়ে থাকে বা করার চেষ্টা করা হয় অন্যদিকে পিএইচডি-ডিগ্রির মূলক্ষেত্র হলো মৌলিক গবেষণা যা পরবর্তীতে ব্যবহারিক দিকে অগ্রসর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ব্যবসার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার, অনেক বহুজাতিক বা বৃহৎ কোম্পানি তাদের ব্যবসার বিলিয়ন ডলার তথা উচ্চমাত্রার বিনিয়োগের জন্য যোগ্য থেকে যোগ্যতম নির্বাহী চাইবে এটাই বাস্তবতা।
এই দৃশ্যপট বিবেচনায়, আজ থেকে প্রায় একযুগ আগে গবেষণা সংশ্লিষ্ট যোগ্য নির্বাহী তৈরির লক্ষ্যে প্রথমে ইনস্টিটিউট অফ বিজনেস এডমিস্ট্রেশন (আইবিএ) এবং পরবর্তীতে ফ্যাকাল্টি অফ বিজনেস স্টাডিস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চালু করে ডিবিএ-কোর্স।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-এর এই সিদ্ধান্ত শুধু সঠিকই ছিলোনা তা ছিল যুগোপযোগী। বিগত একযুগে আইবিএ-তে ভর্তিকৃত আনুমানিক ৮০জন শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ১৯জন ডিবিএ-ডিগ্রী সম্পন্ন করতে সমর্থ হয়েছে, এই পাশের হার উন্নত বিশ্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এখন পর্যন্ত এই দুই প্রতিষ্ঠান থেকে আনুমানিক ২২জন ডিবিএ-গ্রাজুয়েট তৈরী হয়েছে যাদের প্রায় সবাই তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে অত্যন্ত সফল।
দেশ ও বিদেশের মাটিতে তারা যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে চলেছে। আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রবন্ধ প্রকাশ কিংবা পেপার উপস্থাপন তাদের সাধারণ ব্যাপার। দেশে গবেষণা সংশ্লিষ্ট দক্ষ ও অভিজ্ঞ নির্বাহী না থাকলে বৃহৎ ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বিদেশী পরামর্শক আসবে যা দীর্ঘমেয়াদে ভালো ফলাফল বয়ে আনবেনা। অন্যদিকে দেশের অর্থ বিদেশে চলে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা দেখা দিবে।
৪ বছর মেয়াদি ডিবিএ প্রোগ্রামে ভর্তির প্রাথমিক শর্ত হলো মাস্টার্ অফ বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এমবিএ)-সহ পূর্বের শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ভালো ফলাফল, গবেষণার বিষয়ে নিদৃষ্ট মাত্রার চাকুরী/কাজের অভিজ্ঞতা, পদবি ও কাজের ক্ষেত্র এবং গবেষণা সংক্রান্ত প্রাথমিক ধারণা। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডিবিএ ডিগ্রী অর্জনের জন্য পূর্ণকালীন ছুটির প্রয়োজন হয় না, তবে প্রথম দুই বছর নিয়মিত কোর্স করার বাধ্যবাধকতা আছে।
যেহেতু নির্বাহীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চাকুরিরত থাকেন তাই ক্লাসগুলি হয়ে থাকে শুক্র ও শনিবার (বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে)। ইনস্টিটিউট অফ বিজনেস এডমিস্ট্রেশন (আইবিএ), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-এ যে প্রক্রিয়ায় ডিবিএ-তে ভর্তি করানো হয় তা আন্তর্জাতিক মানের।
এখানে উপরোল্লিখিত শর্তের পাশাপাশি একটি গবেষণা প্রকল্প জমাদান ও জেষ্ঠ্য অধ্যাপকদের উপস্থিতিতে গবেষণা প্রকল্প উপস্থাপন করতে হয়। ভর্তি কমিটি সকল বিষয় ও সংশ্লিষ্টক্ষেত্রে ওই গবেষণার অবদান কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ তা বিবেচনা করে প্রার্থী বাছাই করেন যা অত্যন্ত স্বচ্ছ ও বৈজ্ঞানিক।
ভর্তিকৃত পরীক্ষার্থীকে অনুন্য ১২টি কোর্সের প্রতিটিতে আলাদা আলাদা ভাবে নিদৃষ্ট নম্বরসহ পাশ করার পরেই কেবলমাত্র মূলগবেষণায় প্রবেশের সুযোগ দেয়া হয়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, নিজস্ব জেষ্ঠ্য শিক্ষকের পাশাপাশি আইবিএ-তে কোর্স শিক্ষক হিসেবে পাঠদান করেন ইন্ডাস্ট্রিতে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন উচপর্যায়ের নির্বাহীরা, যারা বাস্তব বিষয়ে সম্যক ধারণা দিয়ে থাকেন।
কোর্স-ওয়ার্ক সম্পন্ন হলে নিদৃষ্ট তত্ত্বাবধায়কের (প্রথম থেকেই নির্ধারিত) অধীনে শুরুহয় মূল গবেষণা যার অগ্রগতি নিদৃষ্ট বিরতিতে জেষ্ঠ্য অধ্যাপকদের সামনে উপস্থাপন করতে হয়। উপস্থাপিত গবেষণা মানসম্পন্নহলে স্বীকৃত মানের জার্নালে প্রবন্ধও প্রকাশ করতে হয়।
এই প্রক্রিয়াতে উত্তীর্ণ হলে তত্ত্বাবধায়কের পরামর্শে লিখতে হয় থিসিস পেপার। এই পেপারের সত্যতা ও উদ্ভাবনী বিষয় পরীক্ষান্তে তত্ত্বাবধায়কের অনুমোদন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে জমাদিতে হয়।
জমাকৃত থিসিস পেপার পাঠানো হয় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ দেশি ও বিদেশী ৩জন জেষ্ঠ্য অধ্যাপকের নিকট, তারা অনুমোদন দিলেই কেবল মাত্র ডিবিএ-ডিগ্রির জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়া যায়। অর্থাৎ আইবিএ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-এর ডিবিএ-ডিগ্রী প্রদান প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক মানের যেখানে কোনো ধরনের ব্যত্যয় হওয়ার সুযোগ নাই বললেই চলে।
দেশের ব্যবসা বাণিজ্য আধুনিকায়নে এবং ভবিষৎতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শুধু বাংলাদেশেই নয় সারা দুনিয়াতেই ডিবিএ-গ্রাজুয়েটদের কদর বাড়ছে যা আগামীদিনেও অব্যাহত থাকবে। আইবিএ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের কর্পোরেট সেক্টরের জন্য বিজনেস গ্রাজুয়েট (বিবিএ/এমবিএ) তৈরিতে যে উচ্চতর আদর্শ সৃষ্টি করেছে ডিবিএ গ্রাজুয়েট তৈরির ক্ষেত্রেও একই আন্তর্জাতিক আদর্শ বজায় রাখবে বলে আশা রাখি।