স্বৈরশাসনের পতন: নতুন বাংলাদেশের সম্ভাবনা
আলফাজ আনাম, সাংবাদিক
প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০২৪, ০৩:৩৪ পিএম
আলফাজ আনাম
ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত আন্দোলনের মধ্যদিয়ে নতুন এক বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটতে যাচ্ছে। এক নায়ক শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ৬ শতাধিক মানুষের আত্মত্যাগের ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে শুধু নয়, সাম্প্রতিক বিশ্বের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। বাংলাদেশের এই আন্দোলনে দেখা গেছে এমন কিছু দৃশ্য যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে আগামী দিনে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বিভেদ ও বিভাজনের রাজনীতির মাধ্যমে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে কার্যত একটি মাফিয়া রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন। শেখ হাসিনা রাষ্ট্র পরিচালনায় তৈরি করেছিলেন কয়েক স্তরের সুবিধাভোগী শ্রেণি। যেখানে প্রথমে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিলো তার পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের। শেখ পরিবারের অন্তত ৯ জন ছিলেন সংসদ সদস্য। এরপর ছিলো তার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের পছন্দের কিছু তরুণ। যোগ্যতা বা মেধা নয়, তারা ছিলেন জয়ের সমবয়সি একটি মাস্তানচক্র। এই চক্রটি নানা ধরনের প্রপাগান্ডা চালিয়ে তথাকথিত স্মার্ট বাংলাদেশের শ্লোগান দিয়ে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লোপাটের সাথে জড়িত ছিলেন। এদের সাথে ছিলো একটি ব্যবাসীয় অলিগার্ক শ্রেণি ও প্রশাসনের বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তারা।
শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনে পুলিশ, বিজিবি ও বেসামরিক আমালতন্ত্রকে সম্পূর্ণভাবে ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দিয়েছিলেন। যেখানে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির একমাত্র যোগ্যতা ছিলো ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততা। বিচার বিভাগে নিষ্ঠুর কিছু ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিলো, যাদের প্রধান লক্ষ্য ছিলো যত বেশি সংখ্যক ব্যক্তিকে ফাঁসি প্রদান করা। পদোন্নতি ও সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে মানদণ্ড হয়ে উঠেছিলো কে কত বেশি ফাঁসির রায় দিতে পারবেন। এই ঘটনা জেলা আদালত, তথাকথিত আন্তর্জাতিক আদালত থেকে সর্বেবাচ্চ আদালত পর্যন্ত দেখা গেছে। আদালতের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর নিপীড়নমূলক শাস্তি চাপিয়ে দেওয়া। ফলে বাংলাদেশ থেকে বিচার ও আইনের শাসন বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো।
সামগ্রিকভাবে একটি রক্ত পিপাসু পুলিশ প্রশাসন ও বিচার বিভাগ গড়ে তোলা হয়েছিলো। প্রত্যকটি হত্যকাণ্ড ও নিপীড়নের পক্ষে শেখ হাসিনার সাফাই ছিলো ভুক্তভোগীরা ছিলেন স্বাধীনতাবিরোধী। তিনি যে সুবধিভোগী শ্রেণি তৈরি করেছিলেন সেখানেও তিনি স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষের শক্তির কথা বলে একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দিয়ে গেছেন। দিয়েছেন অন্যায় ও অপকর্মের অবাধ লাইসেন্স। এই বিভাজনের কৌশলের অংশ হিসেবে তিনি তরুণ-কিশোর ছাত্র-ছাত্রীদের রাজাকারের নাতি-পুতি বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। ২০২৪ এর ছাত্র আন্দোলনে ক্ষুদ্ধ শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বহুল আলোচিত শ্লোগান ছিলো তুমি কে- আমি কে রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে- কে বলেছে স্বৈরাচার-স্বৈরাচার।
ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী তরুণরা শেখ হাসিনার বিভাজনের রাজনীতির কৌশলটি শুরুতেই ধরে ফেলেছিলেন। এ কারণ তারা সব মতাদর্শের শিক্ষর্থীদের একত্রিত করতে পেরেছিলেন। সেখানে একমাত্র পরিচয় ছিলো ছাত্র। ফলে ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে এক সময় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে। কারণ সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে এটি এমন এক আন্দোলন যেখানে বিভক্তি ও বিভাজন নেই। ডান-বাম, ইসলামপন্থি সবাই ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। ছাত্র আন্দোলনের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠে। ফলে জনবিচ্ছিন্ন শেখ হাসিনার শাসনের পতন তরান্বিত হয়ে উঠে।
বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনে আমরা এবার প্রথমে দেখেছি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের এক সাথে অংশ নিতে। বাংলাদেশের রাজনীতি যে বিভাজনের ধারায় চলছিলো সেখানে ছাত্ররা সবাইকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। এই আন্দোলনের সফলতার প্রধান শক্তি ছিলো ছাত্রদের এই দূরদর্শী কৌশল ও নীতি। আমরা রাজপথে অনেক বিরল দৃশ্য দেখেছি। হিন্দু-মুসলিম, দাড়ি টুপি হিজাবি- নন হিজাবি সব মত পথের ছাত্র ও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ দেখেছি। এই ছাত্র আন্দোলনে কয়েক জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থী প্রাণ উৎসর্গ করেছে।
আন্দোলনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিলো নারীর অংশগ্রহণ। অতীতে বাংলাদেশের কোনো আন্দোলনে রাজপথে নারীদের অংশগ্রহণ দেখা যায়নি। শেখ হাসিনার লক্ষ্য ছিলো আন্দোলনকারীদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করে তাদের রাস্তায় নামা থেকে বিরত রাখা। এ কারণে তিনি নির্বিচারে গুলি করে মানুষ হত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন। ছাত্রদের কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির প্রথম দিনে দুই শতাধির মানুষকে হত্যা করা হয়। যার মধ্যে ছিলো অসংখ্য নারী ও শিশু।
বাংলাদেশের মানুষ রক্ত দিয়ে শেখ হাসিনার এই কৌশল ব্যর্থ করে দেয়। তার নির্দেশে যত বেশি সংখ্যক মানুষ হত্যা করা হয়েছে তত বেশি মানুষ এই আন্দোলনে শামিল হয়েছেন। নারীরা তাদের সন্তানদের সাথে রাস্তায় নেমে আসে। ছাত্রীরা আরও বেশি এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়। তারা বুঝতে পারে তাদের ভাইদের হত্যা ও নিপীড়ন ঠেকাতে হলে শেখ হাসিনার বিদায় ছাড়া সম্ভব নয়। ফলে ছাত্র আন্দোলন শেখ হাসিনার পতনের এক দফার আন্দোলনে রূপ নেয়। এটি হয়ে উঠে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ছাত্র- জনতার আন্দোলন। ছাত্র আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ বাংলাদেশের নতুন এক রাজনৈতিক শক্তি প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
শেখ হাসিনা তার ১৮ বছরের স্বৈরশাসনে বাংলাদেশে মানুষের সব ধরনের মৌলিক অধিাকর হরণ করেছিলেন। তার শাসনের মূল চাবিকাঠি ছিলো ভয় দেখানো। এই ভয় দেখানোর কাজটি করা হতো প্রশাসন, আদালত এবং তার দলের পেটোয়া বাহিনীর মাধ্যমে। ফলে বাংলাদেশের বহু মানুষ ভয়ে অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলো। তিনি ভেবেছিলেন দেশের মানুষ তার নিপীড়নমূলক শাসন মেনে নিয়েছে। কিন্তু এ দেশের মানুষ কখনোই তার ফ্যাসিস্ট শাসন মেনে নেয়নি তারা ঐক্যবদ্ধ আওয়াজের অপেক্ষায় ছিলেন। ছাত্ররা মানুষের কথা বলার সেই পরিবেশ তৈরি করে দেয়।
বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটিকে শেখ হাসিনা একটি পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের মতো করে পরিচালনার চেষ্টা করেছেন। সাধারণ মানুষ যে রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক তা তিনি কখনোই মনে করতেন না। তিনি মনে করতেন, তার পিতা ও তার পরিবার এ দেশের মানুষকে একটি রাষ্ট্র এনে দিয়েছে। ফলে গণভবনে বসে এই দেশ শাসন করার একমাত্র এখতিয়ার হচ্ছে তার পরিবারের। তিনি কার্যত বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে একটি জমিদারিতে পরিণত করতে চেয়েছেন, যার একমাত্র শাসক হচ্ছে তার পরিবার। ফলে তার পতনের সাথে সাথে মানুষের আক্রোশের প্রকাশ ঘটে গণভবনে। সেখানে হাজার হাজার মানুষ ঢুকে পড়ে। পতনের উল্লাস প্রকাশ করে।
এ দেশের মানুষের ওপর নিপীড়নমূলক শাসন চাপিয়ে দিয়ে তারা পরিবার বিদেশে বিলাসি জীবনযাপন করে গেছেন। তার পুত্র যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করে স্থায়ী হয়ে গেছেন। তার বোনোর পরিবার লন্ডন ও ইউরোপের স্থায়ী হয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষ মনে করে, তিনি ও তার বোনের পরিবার এ দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছে। এ সংক্রান্ত বেশ কিছু খবর ইতোমধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। শেখ হাসিনার ভাগ্নি ও বৃটেনের পার্লামেন্ট সদস্য টিউলিপ সিদ্দিকির বিরুদ্ধে সম্পদ হিসাব দেওয়া নিয়ে তদন্ত চলছে। এর আগে শেখ রেহানার লন্ডনে বিলাসবহুল বাড়ি কেনার নানা তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। সজীব ওয়াজেদ জয়ের সম্পদ নিয়ে আছে নানা প্রশ্ন।
শেখ হাসিনার ১৮ বছরের দুঃশাসনে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রশাসন পরিচালনা ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তি পূজার এক অনন্য উদাহরণ তৈরি করেছিলেন। তিনি বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাস চাপা দিয়ে তার বাবা ও পরিবারকে বাংলাদেশের একমাত্র মহানায়ক হিসেবে হাজির করেছিলেন। তার বাবার নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এ নিয়ে এদেশের মানুষের মধ্যে কারো কোনো দ্বিমত নেই।
কিন্তু তার বাবাও যে তার মতো একজন ব্যর্থ স্বৈরশাসক ছিলেন এই ইতিহাস তিনি আড়াল করে একমাত্র মহানায়ক হিসেবে হাজির করার চেষ্টা করে গেছেন। জোর করে পড়ানো বিকৃত ইতিহাসের বাইরে এ দেশের ছাত্ররা প্রকৃত ইতিহাস জেনেছেন। নতুন প্রজন্ম বানানো ইতিহাসের বয়ান প্রত্যাখান করেছেন। তার পতনের সাথে সাথে বিকৃত ইতিহাসের পতন শুরু হয়। তার বাবার মূর্তিগুলো মানুষ অপসারণ শুরু করে।
ছাত্র আন্দোলনের মধ্যদিয়ে শেখ হাসিনার পতন যেমন নতুন এক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার সম্ভবনা তৈরি করেছে তেমনি বাংলাদেশ রাষ্ট্র ভয়ানক এক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। গণআন্দোলনে শেখ হাসিনার পতনের কারণে বাংলাদেশের রাজনীতি ও প্রশাসনে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এখন দ্রুত একটি অর্ন্তবর্তী সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শুধু তাই নয়, সে সরকারকে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে নতুন নির্বাচনের পথে যেতে হবে।
শেখ হাসিনার পতনের পর সারা দেশের মানুষ রাস্তায় নেমে এসে উল্লাসে মেতে উঠে। কিন্তু একই সাথে মানুষের দৃষ্টি ছিলো কারা রাষ্ট্রের দায়িত্বে আসছে। সেখানে সেনাবাহিনীর ভূমিকা কী হবে। আশার কথা হলো- বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেনি। যদিও সেনাবাহিনী ক্ষমতা নিলেও মানুষ হয়তো তাতে স্বাগত জানাতো। কিন্তু সেনাবাহিনী প্রাথমিকভাবে দূরদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সব রাজনৈতিক দলকে সেনা সদরে আমন্ত্রণ জাননো হয়। সেনাপ্রধান স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, সবার সাথে আলোচনা করে অর্ন্তবর্তী সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে। এরপর বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সাথে সব দলের প্রতিনিধিরা বৈঠক করেন।
শেখ হাসিনার প্রতিহিংসা পরায়ন নিপীড়নমূলক শাসনের প্রতীক হিসেবে বন্দি খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাকে অসুস্থ খালেদা জিয়ার আহবান রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বিভাজনের রাজনীতির কৌশল হিসেবে শেখ হাসিনার শেষ সময়ে নিষিদ্ধ করা জামায়াতে ইসলামীকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। যা ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক ভূমিকা পালনে সহায়ক হবে।
সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্যটি এসেছে ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের কাছ থেকে। তারা জানিয়ে দিয়েছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে তারা নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের নাম প্রস্তাব করেছেন। তিনি এ দায়িত্ব পালন করতে রাজি হয়েছেন। ড. ইউনূস ছিলেন শেখ হাসিনার প্রতিহিংসার শিকার।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ড. ইউনূসের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের নতুন যাত্রা শুরু হতে পারে। সত্যিকার অর্থে হয়তো তার নেতৃত্বে বিভাজনের রাজনীতির অবসান ঘটে বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।