মহাবিপন্ন চন্দ্রবোড়ার আধিপত্য কেন দেশজুড়ে?
মো. শহিদুল ইসলাম
প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২৪, ০৪:১১ পিএম
যদি সারা পৃথিবীর মাটি, বৃক্ষ, লতা-পাতা, ফসল বৈচিত্র্য, মানুষের আহার, চলন-বলন আবহাওয়া বৈচিত্র্য একরকম হতো তাহলে প্রাণবৈচিত্র্যও হয়তো একই রকম হতো। ভিন্নতা আছে বলেই লোনা পানিতে ইলিশ আর মিঠা পানিতে শিং মাগুড় মাছ জন্মে। ভিন্নতা আছে বলেই উচুঁ-নীচু মাটি, টিলার প্রাণবৈচিত্র্য আর সমতলের প্রাণবৈচিত্র্যের ধরনও আলাদা। প্রতিটি ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের রয়েছে আলাদা স্বাধীনতা, আলাদা স্বকীয়তা। আর সেই স্বকীয়তা এবং স্বাধীনতার বদৌলতে প্রাণগুলো গড়ে তোলে তাদের বাসস্থান ও নিজস্ব সার্বভৌমত্ব।
এমন একটি পরিবেশে শুধু একটি নয়, সেই পরিবেশে নানা প্রাণবৈচিত্র্য যা দেখা অদেখা মিলে একটি বাস্তুতন্ত্রের সার্বভৌমত্ব গড়ে তোলে। বিভিন্ন প্রাণসমষ্টি পরস্পরের সাথে এবং তাদের পারিপার্শ্বিক জৈব ও অজৈব উপাদানের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে একটি জীবনধারা গড়ে তোলে। এই পারিপার্শ্বিক জীবনধারার সার্বভৌমত্বে যখন আঘাত আসে, তখনই কোনো প্রাণী হয়তো একেবারে শেষ হয় (বিলুপ্তি), আগ্রাসী হয় নতুবা শেষ করতে বা টিকিয়ে থাকতে নেয় প্রতিহিংসামূলক পন্থা। তৈরি হয় নানামুখী সহিংসতার পরিবেশ। চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার সাপটিও একটি সার্বভৌমত্বের দাবিদার হয়ে বেঁচে থাকার কথা। কিন্তু তা হয়ে উঠেনি। আজ শুধু চন্দ্রবোড়া নয়- এরকম কতো প্রাণই তার বাস্তুতন্ত্রের সার্বভৌমত্ব হারিয়ে নিঃস্ব বিলুপ্ত প্রায় এবং এর কারণেই সহিংসতা ও সংঘাত ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে।
ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে ভারতবর্ষের সন্নিহিত জনপদগুলোর মধ্যে বরেন্দ্র ভূমি একটি আলাদা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত অঞ্চল। যার বিস্তার বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগসহ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সম্পূর্ণ উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর এবং মালদহ জেলার অধিকাংশ এলাকাজুড়ে। ভারত এবং বাংলাদেশ মিলে যার মোট এলাকা প্রায় ১০০০০ বর্গকিলোমিটার এবং এটি একটি পুরাতন পলি সংবলিত আদিভূমি হিসেবে পরিচিত। আবহাওয়া, জলবায়ু এবং মাটির ধরণ ও সংস্কৃতিসহ নানা ক্ষেত্রেই এই অঞ্চলটির ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। প্রাকৃতিক লীলাভূমি এবং ঘনজঙ্গলে আচ্ছাদিত, লাল মাটির উচঁ-নিচু বির্স্তীর্ণ মাঠ আর খাল খাড়ি, নদী-নালা, প্রাকৃতিক জলাধারের বৈশিষ্ট্যে ভরপুর ছিলো এই বরেন্দ্র অঞ্চল। যেখানে নানা প্রাণের বৈচিত্র্য আর আন্তঃসম্পর্কের ভিত ছিলো অটুট।
কিন্তু দিনে দিনে নানামুখী উন্নয়ন বৈষম্যের কারণে বৈচিত্র্যতা আর সম্পর্কের মধ্যে সৃষ্টি করছে সংকট, ঘাত-প্রতিঘাত। এ জন্যই বর্তমান সময়ে মানুষ হচ্ছে আদিকাল থেকে বসবাস করা চন্দ্রবোড়া (রাসেলস ভাইপার) বা অন্যান্য প্রাণের শত্রু। আবার সঙ্গত কারণেই চন্দ্রবোড়া সাপও হচ্ছে মানুষের শত্রু। সাপ মানুষকে কামড় দিয়ে মেরে ফেলছে আবার প্রতিদিন সাপকেও মানুষ মেরে ফেলছে। প্রকৃতির আন্তঃনির্ভরশীলতার প্রতি বাঁধা সৃষ্টি করাতে, মানুষই ডেকে আনছে এই সংকট।
আজ থেকে এক দশক আগেও এই চন্দ্রবোড়া এবং মানুষের সংকট ছিলো শুধু বরেন্দ্র অঞ্চল তথা রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের মধ্যে। এখন এই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বাংলাদেশে। ২০০৯ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষে এই চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার সাপকে বাংলাদেশে মহাবিপন্ন এবং বিশ্বে বিপদমুক্ত বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বাংলাদশের ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত। কিন্তু কি এমন হলো যে এই মহাবিপন্ন প্রাণীটি ছড়িয়ে পড়লো প্রায় গোটা দেশেই।
এর জন্য আঞ্চলিক উন্নয়ন বৈষম্য দায়ী নয়তো! আমরা কেনো সেই দিকটি সামনে নিয়ে আসছি না। আমরা কেনো আমাদের আসল সত্যকে লুকিয়ে রেখে আগামীতে আরো মহাবিপর্যয় ডেকে আনার চেষ্টা করছি। আজ হয়তো চন্দ্রবোড়া; আগামীতে হয়তো অন্যকোনো বিষয় দেখা দিবে। লুকোচুরির এ খেলা বন্ধ না করলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এই দেশের সাধারণ জনসাধারণ, কৃষক এবং নিম্নগোত্রের মানুষরাই, যারা আমাদের উৎপাদনের মূল চালিকা শক্তি। আমরা যখন বরেন্দ্র অঞ্চলের ইতিহাস ঐতিহ্য এবং প্রাণবৈচিত্র্যের অনুসন্ধান করতে থাকি, তখন দেখা যায় এই চন্দ্রবোড়া অপরিচিত কোনো প্রাণী নয়। এটি খুবই পরিচিত একটি প্রাণী। চন্দ্রবোড়া থাকতো চন্দ্রবোড়ার ঘরে আর মানুষ থাকতো মানুষের ঘরে। সকলের মিলমিশে একটা সংসার ছিলো। চন্দ্রবোড়া শুকনো এলাকার সাপ, চন্দ্রবোড়া উচুঁ-নিচু আইল আর টিলার সাপ, চন্দ্রবোড়া গর্তে থাকতে পছন্দ করে না, আইলের নীচে থাকতে পছন্দ করে। সাপটির খাবারের পছন্দের তালিকায় ইঁদুর আর ছোট ছোট ফড়িং, পোকামাকড়। সাপটি গর্তে থাকতে পছন্দ করে না, পানিতে থাকতেও না। এই সাপ বেশি দূর আহার করতেও যায় না। নিজের এলাকার এবং গন্ডির মধ্যেই থাকতে ভালোবাসে। কিন্তু তার এই ভালোবাসার জায়গাটি যখন আমরা দখল করলাম, তার খাদ্য এবং বাসস্থানের সংকট সৃষ্টি করলাম, তখনই নিজেকে রক্ষার জন্য চন্দবোড়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো চারিদিকে। শস্য ফসলে রাসয়নিক সার আর কীটনাশকের কারণে ইঁদুর আর এখন জমিতে থাকতে পারে না। বরেন্দ্র অঞ্চলের উঁচু-নিচু টিলা আইল কেটে যখন সমান করা হলো, তখন চন্দ্রবোড়া তার বাসা হারালো। ছোট বনজঙ্গল ঝোপ ঝাড় সবই উজার করে চাষাবাদ করা শুরু হলো। নিজভূমে পরবাসী হয়ে গেলো চন্দ্রবোড়া।
এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে বলা প্রয়োজন যে, ইংরেজদের শাসন আমল থেকে আজ অবধি বরেন্দ্র অঞ্চলে (বাংলাদেশ ও ভারতসহ) যে উন্নয়নযজ্ঞ বাস্ততবায়ন করা হচ্ছে, তাতে এই অঞ্চলের ভৌগোলিক, প্রাণবৈচিত্র্য এবং স্থানীয় পরিবেশকে কম গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। চিকন-সরু চালের লোভে এবং নীল চাষের জন্য ইংরেজরা এই অঞ্চলে ঝোপ ঝার কেটে জমিতে কৃষকদের জোর করে চাষাবাদ করাতো। দেশ বিভাগের পর পাকিস্থানি শাসক গোষ্ঠীর চলে অনৈতিক শোষণ আর জুলুমবাজ উন্নয়ন। পানি উন্নয়নের কথা বলে সেই সময় ১৯৬২ সালে বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্যতম শিব নদের উৎসমুখ নওগাঁ জেলার মান্দার বৌদ্দিপুরে বন্ধ করে দিয়ে নদীটিকে হত্যা করা হয়। দেশ স্বাধীন হবার পর সেই ইতিহাসও ভুল করে যখন উপস্থাপন হয়, তখন নতুন প্রজন্ম জানে না তার সঠিক ইতিহাস।
এখানে বলা প্রসঙ্গ যে, বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলা পিডিয়াতে যখন শিব নদীকে মান্দার একটি বিল থেকে উৎপন্নের কথা বলা হয়েছে। যা সম্পূর্ণ একটি ভুল তথ্য। নদীটি মূলত নঁওগার আত্রাই নদী থেকে উৎপন্ন হয়েছে। এরকম নানা ও বহুমাত্রিক কাজের কারণে গোটা বরেন্দ্র অঞ্চল দিনে দিনে ঝুঁকি আর সংকটের দিকে এগিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম আরেকটি সংকট ১৯৭৫ সালে বরেন্দ্রর বুক চিরে যাওয়া রক্তের শিরার মতো গঙ্গা তথা পদ্মার বুকে ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে একতরফাভাবে পানি নিয়ে নেওয়া হয় ভারতের বরেন্দ্র অঞ্চল অংশে, যেখানে শুকনো খরা, সেসব অঞ্চলের পানি ছড়িয়ে দিয়ে উন্নয়ন কাজ করা হয়। অন্যদিকে ভাটিতে পানির অভাবে বাংলাদেশের নদী জলাভূমিগুলো ধ্বংস হয়ে যাওয়া এবং ভূউপরোস্থ পানির উৎস কমে যাবার ফলে বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চল অংশে পাতাল থেকে পানি উত্তোলনের মহাপরিকল্পনা করা হয়। এই দীর্ঘ সময়ে জোর করে বা আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যকে গুরুত্ব না দিয়ে উন্নয়ন কাজ করার ফলে ভারত কিংবা বাংলাদেশ দুই অংশে জড়িয়ে থাকা বরেন্দ্র অঞ্চলের যে আপন বৈচিত্র্য তা কমে গেছে। আর সংকটগুলো এভাবে বাড়তেই আছে। এখানে ইকোসিস্টেম বা বাস্তুসংস্থানের দারুণ এক সংকট তৈরি হয়েছে। রবিশস্য বা কম পানি নির্ভর শস্য ফসল বাদে যখন অধিক ধান ফলাতে গিয়ে এখানে পাতালের পানি তুলে গোটা শুকনো বরেন্দ্র অঞ্চলকে ভিজিয়ে দেওয়া হয়েছে। উচুঁ-নিচু টিলা কেটে সমান করা হয়েছে। উপর্যপুরী ফসল ফলাতে দেধারছে রাসায়নিক কীটনাশকের প্রয়োগ করা হয়েছে। প্রাকৃতিক পুকুর-দিঘি জলাধারগুলোতে রাসায়নিক কীটনাশকের ম্যাধমে মৎস চাষের নামে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট করা হয়েছে।
যার ফলে এই অঞ্চলের প্রাণবৈচিত্র্যের যে সহবস্থধান তা বিনষ্ট হয়েছে। হয়তো কোনো প্রাণের আধিক্য বেড়েছে আবার কোনো প্রাণ একেবারেই প্রায় বিলুপ্ত বা কমে গেছে। বৈচিত্র্যময় বৃক্ষলতা পাতার গাছও কমেছে, উন্নয়নের নামে বৃক্ষ কর্তন করা হয়েছে, কমেছে প্রাকৃতিক বন জঙ্গল। যেসব বড় গাছে ঈগল, পেঁচাসহ কতো ধরনের পাখির বসবাস ছিলো। উন্নয়নের নামে সকল প্রাণের খাদ্য চক্রের সার্বভৌমত্ব লুন্ঠিত করা হয়েছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কিছু এলাকা শুকনোই থাকতে হবে, পরিত্যক্ত থাকতে হবে, থাকবে, তা এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যর জন্যই। তা একান্তই এই অঞ্চলের মানুষ বাদে অন্যান্য প্রাণের জন্য। কেনো প্রতি ইঞ্চি মাটিতে ফসল ফলাতে হবে, কেনো শুধু মানুষের খাদ্যের জন্য তা করা হবে! মানুষ তখনই সুখে থাকবে যখন অন্যান্য সকল প্রাণকে সে সুখে থাকতে সহায়তা করবে। বেঁচে থাকতে সহায়তা করবে। আর যখন তার উল্টোটা ঘটানো হচ্ছে, তখনই চন্দ্রবোড়া মানুষের শত্রু হয়েছে, মানুষ চন্দ্রবোড়ার। আমাদেরকে ভাবতে হবে এই বিষয়গুলো নিয়ে। বরেন্দ্র অঞ্চলের যে ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য সেটিকে গুরুত্ব দিয়েই এই অঞ্চলের উন্নয়ন করতে হবে। তা না হলে সংকট আরও বাড়বে। এই পৃথিবীটা শুধু মানুষের নয়, এখানে সবাইকে নিয়ে সবারই বাঁচতে হবে। তা না হলে মানুষই সব থেকে বেশি সংকটের মুখে পড়বে।
চন্দ্রবোড়ার বর্তমান সংকট উত্তোরণে তাই প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। কৃষি বিভাগ, বনবিভাগ এবং স্বাস্থ্য বিভাগ মিলে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সাপের থাকার বাসস্থান ঠিক রাখতে বন ও কৃষি বিভাগে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। স্বাস্থ্য বিভাগ কমিউনিটি ক্লিনগুলো পর্যন্ত এর চিকিৎসা ও সাপ না মারতে জনসচেতনতার উদ্যোগ নিতে হবে। একইসঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সাথেও এই সংকট প্রতিকার করতে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
মো. শহিদুল ইসলাম
পরিবেশ আইন গবেষক
বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজিনাস নলেজ (বারসিক)
ইমেইল-shahidul546mh@gmail.com
মোবাইল- ০১৭১৬৪৯৭২২৭