দিন যত যাচ্ছে মানুষের মধ্যে মায়া মমতা ভালোবাসা কমছে। উল্টোদিকে বাড়ছে হিংসা বিদ্বেষ ও ক্ষোভ। আগে পাড়া মহল্লায় কারো কোনো বিপদ হলে অন্যরা দৌড়ে যেতেন, পাশে দাঁড়াতেন, কিন্তু এখন কি তা আছে? এখন পাশের ঘরে সমস্যা দেখা দিলেও কেউ এগিয়ে আসতে চান না। ব্যতিক্রম দু’চারটা ঘটনা ছাড়া পরিস্থিতি এখন ঠিক এমনই দঁড়িয়েছে।
এখন প্রতিবেশীর কাছে প্রতিবেশী নিরাপদ বোধ করেন না। এমনকি স্বজনরাও নিরাপদ নন অন্য স্বজনের কাছে। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ঘটনা মানুষের হৃদয়ে নাড়া দিয়ে গেছে। অভিভাবকদের না জানিয়ে চাচাতো বোনকে বিয়ে করায় আপন চাচার হাতে কয়েক টুকরো হতে হয়েছে ভাতিজাকে। স্ত্রী ও শিশু সন্তানকে খুন করেছেন পাষণ্ড বাবা। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর বলছে বছরের প্রথম পাঁচ মাসে স্বজনের হাতে খুন হয়েছেন অন্তত দুইশ জন।
সম্প্রতি ময়মনসিংহ সদরের মনতলা এলাকায় মনতলা ব্রিজের নিচে সুতিয়া নদী থেকে লাগেজে খণ্ডিত দেহ ও তার পাশ থেকে বিচ্ছিন্ন মাথা উদ্ধার হয়েছে। খবর পেয়ে রাতেই ছুটে আসেন নিহতের পরিবারের সদস্য ও বন্ধুরা। স্বজনদের ভাষ্য, প্রেমের সম্পর্ক ছিল ওমর ফারুক সৌরভ ও তার চাচাতো বোন ইসরাত জাহান ইভার। গত ১২ই মে ঢাকায় যান ইভা। পরে সৌরভের এক বন্ধুর বাসায় বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সারেন সৌরভ-ইভা।
এরপর নিজের বাসাতেও নিয়ে গিয়েছিলেন সৌরভ। ওই দিনই ইভা চলে আসেন ময়মনসিংহে। দু’দিন পর ময়মনসিংহে এসে চাচা-চাচিকে বুঝানোর চেষ্টা করেন সৌরভ; কিন্তু না মেনে উল্টো তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেন। সৌরভের মায়ের ভাষ্য, ইভাকে কানাডা পাঠিয়ে দেওয়ার পর তার ছেলেকে ডেকে এনে হত্যা করেছে তারই আপন চাচা। এ ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান তিনি।
প্রায় একই সময়ের ঘটনা। হোটেল কক্ষ ভাড়া নিয়ে স্ত্রী ও সন্তানকে নৃশংসভাবে গলা কেটে হত্যার পরও থামেনি ঘাতক আজিজুল হক। ১ বছর বয়সি ছেলে আবদুল্লাহ আল রাফির শরীর থেকে মাথা কেটে ব্যাগে ভরে সাত কিলোমিটার দূরে করতোয়া নদীতে ফেলে দেয়। জোড়া খুনের পর নিজেই সাজে সাধু। মঞ্চস্থ করে স্ত্রী-সন্তান নিখোঁজ নাটক।
খুনের আগে স্ত্রী-ছেলের সঙ্গে ছবিও তোলে। তিনজনের সেই ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে ঘাতক আজিজুল লেখে, ‘আমার স্ত্রী ও সন্তান নিখোঁজ’। অবশ্য পুলিশের হাতে ধরা পড়ে হত্যার দায়ও স্বীকার করেছে।মর্মস্পর্শী ঘটনাটি বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার।
সংবাদপত্রের খবর ও পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় প্রতিদিনই একাধিক পারিবারিক সহিংসতায় স্বজনের হাতে ঝরছে স্বজনের প্রাণ। প্রতিটি মানুষের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বিবেচিত গৃহকোণটিও যেন পরিণত হচ্ছে অনিরাপদ স্থানে। অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষকরা এজন্য অন্যান্য আর্থ-সামাজিক ও মনোগত বিষয়ের পাশাপাশি তথ্য-প্রযুক্তির অপব্যবহার ও নৈতিক অবক্ষয়কে দায়ী করছেন। শুধু পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা নিয়ে পৃথক কোনো জরিপ না থাকলেও পুলিশ সূত্র ও গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, গত পাঁচ মাসে পারিবারিক সমস্যার জেরে অন্তত ২০০টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
গত ২ জুন দিন জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে মাদারীপুরের এক গ্রামে বড় ভাইয়ের হাতে খুন হন ছোট ভাই। পারিবারিক কলহের জেরে পাবনার ঈশ্বরদীর ইপিজেডে মাদকাসক্ত স্বামীর ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারান এক গার্মেন্টকর্মী। বগুড়া শহরের উপকণ্ঠের একটি হোটেল থেকে এক নারী ও তার এক বছরের ছেলের গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়। ঠিক একইদিন রাজধানীর ভাটারা থানা এলাকার এক ফ্ল্যাট থেকে জাপান প্রবাসী এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ ও স্বজনরা বলেছে, ওই ব্যক্তি জাপানে সে দেশের এক নারীকে বিয়ে করলেও কানাডা প্রবাসী এক বাংলাদেশি নারীর সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। সম্প্রতি উভয়েই ঢাকায় এসে ওই ফ্ল্যাটে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে ওঠেন। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, ওই নারী ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে যাওয়ার কয়েক দিন পর সেখানে পুরুষটির গলিত লাশ পাওয়া যায়। প্রায় একই সময় এতগুলো হত্যাকাণ্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সর্বত্র আলোচনার ঝড় বইছে।
বেসরকারি গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পারিবারিক সহিংসতার কারণে চলতি বছরের প্রথম চার মাসে ১৫৪ জন নারী ও শিশুর মৃত্যু হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভিযোগ অনুযায়ী এর মধ্যে ৪৮ জন স্বামীর হাতে, ১১ জন স্বামীর পরিবারের হাতে এবং ২৩ জন নিজ পরিবারের হাতে প্রাণ হারিয়েছে। এছাড়া ৬৬ জন আত্মহত্যা করে। তবে অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, গণমাধ্যমে পারিবারিক সহিংসতার যেসব খবর আসে, প্রকৃতপক্ষে ঘটনা তার চেয়ে আরও অনেক বেশি। আর পারিবারিক সহিংসতায় বেশি প্রাণ ঝরছে নারীদের।
আমরা কোনো কারণে এমন ঘটনা পুনরায় দেখতে চাই না। আমরা চাই পূর্বের ন্যায় সব মানুষের মধ্যে একটি প্রীতি ও ভালোবাসার সম্পর্ক। কোনো স্বজন যেন অন্য মানুষের হাতে প্রাণ না হারায়- এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: হাসান আল বান্না, সাংবাদিক ও কলামিস্ট