চাঁদ দেখাসাপেক্ষে দেশে ১০ অথবা ১১ এপ্রিল পবিত্র ঈদুল ফিতর অনুষ্ঠিত হবে। রোজ ২৯টি হলে ১০ এপ্রিল আর ৩০টি হলে ১১ এপ্রিল ঈদ হবে।
শেষ সময়ে এসে সবাই সব ব্যস্ততা গুছিয়ে বাড়ি ফিরছেন। বেসরকারি সব অফিস প্রায় বন্ধ। কেউ কেউ আগামী মঙ্গলবার (৯ এপ্রিল) পর্যন্ত অফিস খোলা থাকলেও কার্যক্রম থাকছে না।
ব্যাংকে শেষ সময়ে যথেষ্ট চাপ থাকলেও সরকার অফিস ফাঁকা। ৮ ও ৯ এপ্রিল অফিস খোলা থাকলেও অনেক চেয়ার ফাঁকা। ঈদের ছুটির সঙ্গে ছুটি বাড়িয়ে তারা বাড়ি ফিরছেন। এবার যারা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে গ্রামে যাচ্ছেন তারা দীর্ঘ যানজটে না পড়লেও অন্য ভোগান্তিতে পড়ছেন।
সরকার কঠোর হওয়ার ঘোষণা দিলেও বাড়তি ভাড়া আদায় ঠেকাতে পারেনি। প্রায় সব পরিবহণই বাড়তি ভাড়া নিচ্ছেন। সড়ক লঞ্চ এমনকি আকাশপথেও বাড়তি ভাড়া দিতে বাধ্য হচ্ছেন যাত্রীরা। প্রতি বছরই ঈদে অনেকের কাছে বিষাদে পরিণত হয়।
ঈদ আনন্দ সবার সাথে ভাগাভাগি করে কাটানোর জন্য গ্রামে ফিরেন নগরবাসী। কিন্তু অনেক সময় সেই আনন্দ বিষাদে পরিণত হয়। বিশেষ করে সড়কে ঝরে যায় অসংখ্য তাজা প্রাণ। বাস চালকরা টানা ডিউটি করার কারণে তারা বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ পান না। ফলে চালানোর সময় অনেক সময় তারা ব্যালেন্স রাখতে পারেন না।
এ কারণে ঈদের সময় দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পায়। ঘটে প্রাণহানিও। আহত হয়ে পড়ে থাকতে হয় হাসপাতালে। অনেক সময় ফিটনেস নেই এমন যানবাহন ঈদের সময় অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহণ করে, এ কারণেও দুর্ঘটনা বাড়ে। যাত্রীরা গণমাধ্যমের কাছে এবং বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি ভাড়াও নেওয়ার অভিযোগ জানাচ্ছেন কিন্তু এর কোনো প্রতিকার নেই। বাড়িতে ঈদ করা নিয়ে এখন মানুষের ব্যস্ততা। ঈদে বাড়ি ফেরা মানেই দুর্ভোগ।
প্রতি বছর ঈদ সামনে রেখেই বেহাল সড়কগুলো সংস্কারের দিকে মনোযোগ দেয় সরকার। কিন্তু সেই উদ্যোগ সময়মতো শেষ না নেওয়ায় দুর্ভোগ থেকে রেহাই পায় না মানুষ। তবুও রেলস্টেশন ও বাস টার্মিনালে বাড়ি ফেরার মিছিল লক্ষ করা যাচ্ছে; কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো সড়ক-মহাসড়কের বেহালের কারণে আমাদের দেশে ঈদে বাড়ি ফেরা প্রায়ই আনন্দময় হয় না। প্রতি বছরের মতো এবারও ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে সড়ক, রেল ও নৌপথে প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার কিন্তু ভোগান্তি কি দূর হয় না।
দেশের বেশির ভাগ যাত্রী সড়কপথে বাড়িতে যায় এবং ফিরেও আসে সড়কপথে। তাই যাত্রীদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য সড়কপথে যেন ফিটনেসবিহীন বাস কেউ নামাতে না পারে, সেদিকে নজর রাখতে হবে। এমনকি ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই, এমন কেউ যাতে বাস বা অন্য কোনো যানবাহন চালাতে না পারে, সেদিকেও নজর রাখতে হবে। কেউ যাতে প্রতিযোগিতা করে যানবাহন না চালায়, এ ব্যাপারে চালকদের সতর্ক করে দেয়া জরুরি। ঈদের সময় ট্রেনেও উপচে পড়া ভিড় থাকে। টিকিট না পেয়ে অসংখ্য যাত্রী ছাদে উঠে গন্তব্যে যায়। কেউ যাতে ট্রেনের ছাদে উঠতে না পারে সেদিকে কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। নদীপথে ঈদের এ সময় ফিটনেসবিহীন লঞ্চ যেন নামতে না পারে। যাত্রীরাও যদি একটু সতর্ক থাকে, তাহলে ঈদযাত্রা হতে পারে নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রতি বছর ঈদ উৎসবের আগমুহূর্ত থেকেই ঘরমুখী মানুষের মনে নিরানন্দের সুর ধ্বনিত হতে দেখা যায়। টিকিট কালোবাজারি, যানজট, ছিনতাই-ডাকাতি ও চাঁদাবাজি, জাল নোট, সড়ক ও লঞ্চপথে দুর্ঘটনা এবং শ্রমিক অসন্তোষের কারণে রাস্তা অবরোধসহ বিভিন্ন ঘটনায় জনদুর্ভোগ চরমে ওঠে। অতীতের ঘটনা থেকে প্রমাণিত-দেশের কোনো পথই ঘরমুখী মানুষের ঈদযাত্রার জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। সড়কপথ, নৌপথ ও রেলপথ ঈদের আগে কোথাও স্বস্তির কোনো চিত্র পরিলক্ষিত হয় না। নির্ঝঞ্ঝাট ও নিরাপদ ভ্রমণের প্রত্যাশা নিয়ে মানুষ টিকিটের জন্য বাস, লঞ্চ ও রেলস্টেশনে ভিড় জমায়; কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের টিকিট পাওয়া দুরূহ হয়ে পড়ে। মূলত অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের জন্য অবৈধ পন্থায় টিকিটের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে এ সময় মানুষকে উচ্চমূল্যে টিকিট কিনতে বাধ্য করা হয়। ঈদের আগে এ ধরনের অনিয়ম-অব্যবস্থা মোটেই কাম্য নয়।
প্রতিটি জাতীয় উৎসব-পর্বে মানুষ মাটির টানে উৎসে ফিরে যান, স্বজনদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করেন। গ্রামের সঙ্গে তাদের আত্মিক সম্পর্কটি এখনও অটুট ও অহবান রয়ে গেছে। এটি আমাদের সামাজিক সংহতিকেও সুদৃঢ় করে। বছরের অন্যান্য সময়ে ছুটিছাঁটা তেমন পাওয়া যায় না বলেই ঈদের সময় অনেক বেশি মানুষ শহর থেকে গ্রামে যান। আবার অনেকে আনন্দ ভ্রমণের জন্যও এ সময়টি বেছে নেন। নানা কারণে আমরা বিদেশি পর্যটকদের তেমন আকৃষ্ট করতে না পারলেও অভ্যন্তরীণ পর্যটন অনেক বেড়েছে।
ঈদের সময় কক্সবাজার, কুয়াকাটাসহ দর্শনীয় স্থানগুলো পরিণত হয় জনারণ্যে। ঈদে মাটির টানে বাড়ি ফেরা কিংবা আনন্দ ভ্রমণের জন্য বের হওয়া হাজার হাজার নারী-পুরুষ ও শিশুর যাত্রাকে নিরাপদ করা সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্ব। ঈদের সময় নৌ, স্থল ও ট্রেনে যানবাহনের সংখ্যা অনেক বাড়ানো হয়। কিন্তু তারপরও যাত্রীর সংখ্যার তুলনায় তা অপ্রতুল। ফলে একধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যায়, যা অনেক সময় প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমরা আর কোনো দুর্ঘটনা চাই না। ঝুঁকিমুক্ত ঈদযাত্রা চাই। একটি পরিবারেও যেন দুর্ঘটনার বেদনা সইতে না হয় এমনটাই প্রত্যাশা। সবাইকে অগ্রিম ঈদ মোবারাক।
লেখক: হাসান আল বান্না, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক