৩ নভেম্বর: একাত্তরের আরেক প্রতিশোধ
তৌহিদুল হাসান নিটোল
প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২৩, ০৭:৫২ পিএম
ইতিহাসের কালো অধ্যায় নিয়ে আলোচনা সুখকর নয়। আর সেই কালো অধ্যায়টি যদি আমার নিজের জাতীয় ইতিহাসের গায়ে কলঙ্ক আকারে লেগে থাকে তাহলে তা নিয়ে আলোচনা আরও শক্ত, আরও কঠিন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর আমাদেরই দেশের কিছু কুলাঙ্গার আমাদের জাতীয় বীর জাতীয় চার নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জন বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার এই জাতীয় চার নেতা হলেন- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামান।
একাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর ৩ নভেম্বর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন, কলঙ্কিত দিন- আমরা সবাই জানি। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যার পর তারই চার সহযোগীকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের কারা প্রকোস্টে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রকারী খন্দকার মোশতাক সরকার বঙ্গভবনে তার অনুচর তাহের উদ্দিন ঠাকুর, মাহবুব আলম চাষী, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ও ওবায়দুর রহমানের সঙ্গে বৈঠক করে এ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা সাজায় এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ফারুক-রশীদ-ডালিমদের অনুগামী কিছু সেনা সদস্য দিয়ে এ জঘন্য হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে।
৩ নভেম্বরের জেল হত্যাকাণ্ড কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর একই সূত্রে গাঁথা। গভীর ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর খুনিরাই ইতিহাসের জঘন্যতম এই দুটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর খন্দকার মোশতাক এই জাতীয় চার নেতাকে তার পাশে চেয়েছিলেন। মোশতাক সরকারের মন্ত্রিসভায় যোগদান করার আহ্বান জানিয়েছিলেন; কিন্তু তারা তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর ১৫ আগস্টের জঘন্যতম ঘটনার পর একই বছরের ২৩ আগস্ট এই জাতীয় চার নেতাকে বন্দি করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। কারাগার হলো যে কোন ব্যক্তির জন্য নিরাপদ স্থান। কারাবন্দি ব্যক্তির নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। অথচ খুনি মোশতাক দেখল, বঙ্গবন্ধুর এই চার সহযোগী জাতীয় বীর। তাদের বাঁচিয়ে রাখলে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বা আদর্শ বেঁচে থাকবে এবং তারা একসময় না একসময় বঙ্গবন্ধু হত্যার বদলা নেবে। ১৫ আগস্টের ঘটনার বিচার করবে। তারা বেঁচে থাকলে তাদের নেতৃত্বে একসময় গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রতিষ্ঠা পাবে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ পরিচালিত হবে। তাই শেখ পরিবারের মতোই এই জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর খুনিরা পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে। খুনিরা চেয়েছিল বাংলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। একাত্তর সালের পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ করতে। তাদের সেই অলিক স্বপ্ন পুরণ হয়নি।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সামরিক জান্তা সরকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দি করে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস পাকিস্তানের কারাগারে আটক করে রাখে। বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে প্রথমে ঢাকা থেকে পাকিস্তানের করাচি নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালী কারাগারের নির্জন কনডেম সেলে স্থানান্তর করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকিস্তান কারাগারে বন্দি। বাংলাদেশের মানুষ জানত না তাদের প্রিয় নেতাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে! কোথায় রাখা হয়েছে! তিনি বেঁচে আছেন নাকি তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। তেমনি বঙ্গবন্ধুও তার প্রিয় বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারতেন না। জান্তা সরকার বঙ্গবন্ধুকে কিছুই জানায়নি।
এদিকে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে পূর্ব বাংলায় তখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে মুজিবনগর সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়ের যুদ্ধ ও যুদ্ধকালীন বহুবিধ কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করেছেন এই জাতীয় চার নেতা। বঙ্গবন্ধুর শারীরিক অনুপস্থিতিতে তারা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগরে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সমন্বয়ে ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ গঠন করা হয়। সেই পরিষদ বঙ্গবন্ধুর ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ ও ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ অনুমোদন করে। তারই ভিত্তিতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং উপ-রাষ্ট্রপতি হন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন এএইচএম কামরুজ্জামান। মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ করে ১৭ এপ্রিল। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রিয় বাংলাদেশকে হানাদার মুক্ত করেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের দূরদর্শিতার কথা ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের রক্তঝরা দিনগুলোতে সফলভাবে নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন এই চার নেতা। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে এই জাতীয় চার বীরের অবদান আমাদের সবসময়ই শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা উচিত। কিন্তু আমরা কি তা করছি? বিশেষত, নতুন প্রজন্মের কতজন আমাদের এই জাতীয় বীরদের অবদানের কথা জানে?
বাংলাদেশ হানাদার মুক্ত হওয়ার পর, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন। ১১ জানুয়ারি তাজউদ্দীন আহমদের বাসভবনে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনা বিষয়ে সমস্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি সামরিক সরকার কাঠামো ভেঙে বাংলদেশকে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। স্বাধীন দেশে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন বঙ্গবন্ধু স্বয়ং; সৈয়দ নজরুল ইসলাম শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী; তাজউদ্দীন আহমদ অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী; ক্যাপ্টেন মনসুর আলী যোগাযোগমন্ত্রী এবং এএইচএম কামারুজ্জামান ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী হন। বঙ্গবন্ধু জাতীয় চার নেতাকে সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। জাতির পিতা ও জাতীয় চারনেতার আরাধ্য স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করে প্রিয় বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করা।
আমাদের জাতীয় ইতিহাস আলোচনায় এই জাতীয় চার নেতার কথা কতটা স্থান পায়? রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন- ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম, সে কখনো করে না বঞ্চনা... মৃত্যুতে সব দেনা শোধ করে দিতে’। কবিগুরুর এ কথাটি অনেক ক্ষেত্রে সঠিক বলে প্রতীয়মান হলেও বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাস আলোচনায়, এ কথাটি একেবারেই সঠিক নয়। কারণ জাতীয় চার নেতার দেনা আমরা এখনো শোধ করতে পারিনি।
আসলে জাতীয় চার নেতার আলোচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো উনাদের দেশপ্রেম। ব্যক্তিকেন্দ্রিক এ বিশ্ব ব্যবস্থায় যেটি বিরল ঘটনা। বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে জাতীয় চার নেতার অবদান খুব একটা আলোচিত হয় না। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক। বাংলাদেশের আগামী প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে জাতীয় চার নেতার অবদান বিষয়ে আরও চর্চা হওয়া দরকার।
লেখক: তৌহিদুল হাসান নিটোল, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর পিস অ্যান্ড লিবার্টি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।