Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থার বিবর্তন ও প্রসঙ্গ 

Icon

ড. মো. রফিকুল ইসলাম 

প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২৩, ১০:২৫ এএম

ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থার বিবর্তন ও প্রসঙ্গ 

বাংলাদেশ একটি নবীন দেশ হলেও এ দেশে ইসলামি শিক্ষার ইতিহাস অনেক পুরনো। এ দেশে মুসলমানদের আগমন ও ইসলামি শিক্ষার প্রচলন মূলত একই সূত্রে গাঁথা। মুসলিম শাসনামলে এই সনাতন ইসলামি শিক্ষা মাদ্রাসা শিক্ষা নামে  এ দেশে প্রধান শিক্ষাব্যবস্থা হিসেবে প্রচলিত ছিল। ইংরেজ শাসনামলে শিক্ষাব্যবস্থা দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর এই দ্বৈত ধারার কোনো পরিবর্তন হয়নি। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পরও এই দ্বৈত ধারা অটুট থাকে। সাধারণ ও মাদ্রাসা শিক্ষা হিসেবে আমাদের জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা প্রবাহিত হয় দ্বৈত ধারায় এবং সমাজের শিক্ষিত শ্রেণি হয় দ্বিধাবিভক্ত। ফলে শাসনব্যবস্থা থেকে শুরু করে দেশের উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষিতদের দিয়ে পরিচালনা করানো হয়েছে। অন্যদিকে সনাতন ইসলামি শিক্ষায় বা মাদ্রাসায় শিক্ষিতরা ধর্ম প্রচার ছাড়া উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড তেমন কোনো অবদান রাখতে পারছেন না। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের রয়েছে ভিন্ন ধরনের পদচারণা। 

বাংলার ইতিহাসের একটি সুদীর্ঘ সময় অর্থাৎ এয়োদশ শতকের প্রথম দিকে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজীর ক্ষমতাগ্রহণের পর থেকে শুরু করে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত মাদ্রাসা শিক্ষাই ছিল এ দেশের প্রধান শিক্ষাব্যবস্থা। দেশে ব্রিটিশ রাজস্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মুহূর্তে অবিভক্ত বাংলায় প্রায় ৮০ হাজার মাদ্রাসা বিদ্যমান ছিল বলে জানা যায়। এসব প্রতিষ্ঠানের লেখাপড়ার মান ছিল খুবই উন্নত এবং প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থনৈতিক দিক থেকে সমৃদ্ধশালী থাকার প্রমাণও পাওয়া যায়। ওই সময় প্রায় প্রতিটি মসজিদ ও খানকাহ মাদ্রাসা হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার প্রচলন ছিল। এসব শিক্ষাকেন্দ্রে এককালীন সরকারি সাহায্য অথবা জায়গীর বা ওয়াকফ সম্পত্তি প্রদান করা হতো। দেশের জনসাধারণ এসব প্রতিষ্ঠানে মুক্তহস্তে দান করত। এসব প্রতিষ্ঠানকে সাহায্য করাই ধর্মীয় কর্তব্য বলে মনে করা হতো। এয়োদশ শতকের প্রথম দিকে মাদ্রাসা থেকে শিক্ষিত লোকজনের প্রাধান্য ও প্রভাব এতটাই ছিল যে, প্রায় সব সরকারি ও বেসরকারি কার্মকাণ্ড তাদের প্রাধান্য ছিল। শুধু ধর্মীয় শিক্ষক বা আধ্যাত্মিক গুরুই (নেতা) নয়, বরং সমাজসেবক, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সৈনিক ও নাবিক প্রভৃতি পেশায় নিয়োজিত সবাই ছিলেন মাদ্রাসা থেকে ডিগ্রি প্রাপ্ত। বস্তুত তারাই ছিলেন সমাজের উচ্চ শ্রেণি এবং সমাজের প্রধান ধারা। আর সমাজের এই মূল ধারার সঙ্গে একত্রিত সম্মানজনক জীবিকা নির্বাহের জন্য অনেক অমুসলিমও মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।


১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্যিক সংস্থা থেকে রাজনৈতিক সংস্থায় পরিণত হওয়ার পরেই মূলত এ দেশে মাদ্রাসা শিক্ষার অবনতি শুরু হয় এবং দেশে দ্বৈত শিক্ষা প্রবর্তিত হয়। প্রায় ২০০ বছরের রাজত্বকালে তাদের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ এ দেশের সনাতন ও স্থানীয় শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনে এবং নতুন শিক্ষাব্যবস্থার (ইংরেজি শিক্ষা) প্রবর্তন করে। কোম্পানি ১৭৬৫ সালে সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করার সঙ্গে সঙ্গে এ দেশের মুসলমান সমাজ তথা মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করে। দেওয়ালি হস্তান্তরের সঙ্গে সঙ্গে সরকারের অর্থ ও রাজস্ব বিভাগ সরাসরি ইংরেজদের হাতে চলে যাওয়ার কারণে এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তার স্থানে ইংরেজ কিংবা স্থানীয় হিন্দুদের স্থলাভিষিক্ত করা হয়। ফলে সমগ্র প্রশাসন ও রাজস্ব বিভাগে মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিতদের চাহিদা প্রায় শেষ হয়ে যায়। বাংলার মুসলিম সমাজকে তাদের সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। এর ফলে সরাসরি ইসলামি শিক্ষা তথা মাদ্রাসা শিক্ষার ওপর মারাত্মক আঘাত হানে। কারণ সমৃদ্ধশালী মুসলিম পরিবারগুলো ইসলামি শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতায় তারা নিজস্ব খরচে স্বীয় পরিবার ও দরিদ্র শ্রেণি প্রতিবেশীর সন্তানদের ইসলামি শিক্ষা প্রদানের জন্য শিক্ষক নিয়োগ করেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে তারা সম্পদ হারায় এবং ইসলামি শিক্ষার পৃষ্ঠপোষক শ্রেণি নিঃশেষ হয়ে যায়। ফলে মাদ্রাসায় শিক্ষিত ও শিক্ষকতায় নিয়োজিত লোকজন বেকার হয়ে ধীরে ধীরে দরিদ্র শ্রেণিতে পরিণত হয়। ব্রিটিশরা  এ দেশের ক্ষমতাগ্রহণকালে অবিভক্ত বাংলার প্রায় এক-চতুর্থাংশে ভূমি বা খেরাজ ও ওয়াকফ করা ছিল। তবে দেশের শাসক, সমাজপতি ও বিত্তশালী লোকেরা মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকাহর জন্য মৌখিকভাবেই এসব ভূমি দান করেন। কোনো প্রকার দলিল করে রাখার প্রয়োজন মনে করেনি। এসব সম্পত্তির আয় থেকে মসজিদ ও মাদ্রাসার ব্যয়ভার বহন করা হয়। কিন্তু এসব সম্পত্তি দলিলবিহীন, বিধায় ব্রিটিশ সরকার ১৮২৮ সালে এক আইন চালু করে। এসব সম্পত্তির স্বত্বাধিকার জব্দ করে নেয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যায় এবং মাদ্রাসায় শিক্ষিত জনগণ বেকার হয়ে পড়ে। আর যেসব প্রতিষ্ঠান টিকে থাকে তা জনগণের চাঁদার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এ কারণেই ১৮২৮ সালের অর্পিত এই আইনকে অনেকেই ব্রিটিশ শাসকদের দ্বারা বাংলার মুসলমান ও ইসলামি শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে শেষ আঘাত হিসেবে গণ্য করা হয়।

১৭৮১ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস কলকাতা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এর দুটি উদ্দেশ্য ছিল— প্রথমত স্থানীয় জনসাধারণ, বিশেষ করে মুসলমানরা আবেদন করেন এবং দ্বিতীয়ত সরকারি কার্যপরিচালনার জন্য মুসলিম কর্মচারীদের ফারসি ভাষা জানা বাধ্যতামূলক। ফলে খারিজি মাদ্রাসা বা কওমি মাদ্রাসা নামে এক ধরনের মাদ্রাসার উন্মেষ ঘটে। কেবল জনগণের চাঁদার ওপর নির্ভর করে। এসব মাদ্রাসা উন্নততর ইসলামি শিক্ষা প্রদানের সাথে সাথে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ইংরেজগণ মুসলমানদের আকৃষ্ট করার জন্য উনিশ শতকে শেষ ভাগ থেকে নিউ স্কিম মাদ্রাসা চালু করেন, যা মাদ্রাসায় থেকে পাস করা শিক্ষিত জনগণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ ও প্রশাসনে চাকরির ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে। ১৭৮০ সালের সেপ্টেম্বরে কলকাতার মুসলিম শিক্ষাবিদ ও নাগরিক প্রতিনিধিগণ ওয়ারেন হেস্টিংসকে অনুরোধ করেন মাদ্রাসাগুলো পরিচালনার জন্য আরবি ও ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত আলেম প্রয়োজন। এতে বঞ্চিত মুসলমানদের মাদ্রাসা শিক্ষার পথ উন্মুক্ত হবে এবং ওয়ারেন হেস্টিংস সম্মত হন। ১৭৮০ সালের অক্টোবর থেকে মজদুদ্দীন ওরফে মোল্লা মদন নামে আরবি ও ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত আলেম মাদ্রাসা পরিচালনার জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়। এর মাসিক বেতন ছিল ৩০০ টাকা। কলকাতা নগরীর বৈঠকখানা রোডে একটি ভাড়া বাড়িতে মাসিক ১০০ টাকায় মাদ্রাসা গৃহের ব্যবস্থা করা হয়। ১৭৮০ সালের অক্টোবর থেকে ১৭৮১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত এ ভাড়া বাড়িতে মাদ্রাসার শিক্ষার কার্যক্রম চলে। এদিকে মাদ্রাসায় ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ভাড়া বাড়িতে সংকুলান না হওয়ায় পদ্মাপুকুর লেইন-এ ৫৬৪১ টাকার একখণ্ড জমি ক্রয় করা হয় এবং মাদ্রাসা নির্মাণ করা হয়। পরে মাদ্রাসার নামকরণ করা হয় মোহামেডান কলেজ। ১৭৮৫ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস চাকরি থেকে অবসরগ্রহণ করার পূর্বেই মাদ্রাসা (মোহামেডান কলেজ) কলেজের সার্বিক ব্যয় নির্বাহের দায়িত্ব সরকারের ওপর ন্যস্ত করে। মাদ্রাসার প্রশাসনিক কার্যক্রমের জন্য একটি বোর্ড অর ডাইরেক্টরস গঠন করা হয় এবং তাদের ওপর সমস্ত দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়। এর ব্যয় নির্বাহের জন্য মাদ্রাসা মহাল নামে একটি ভূসম্পত্তি ক্রয় করে। কিন্তু মাদ্রাসার ঘর ও সস্পত্তি হিন্দু এলাকায় অবস্থিত হওয়ার কারণে মাদ্রাসাটিকে মুসলিম এলাকায় ১৭৮৫ সালে স্থানান্তরিত করা হয়।  

১৮২১ সালে মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বিরোধিতা সত্ত্বেও মাদ্রাসায় প্রথাগত পরীক্ষার ব্যবস্থা চালু করা হয়। ১৮৫৪ সালে শিক্ষা সংক্রান্ত ডেম্পাচ এ কলকাতা মাদ্রাসাকে প্রস্তাবিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নিয়ে আসার ইঙ্গিত থাকলেও মাদ্রাসাটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আনা হয়নি। ফলে মাদ্রাসা শিক্ষিতদের সরকারি কর্মকাÐ শেষবারের মত বন্ধ করে দেয়া হয় এবং রাষ্ট্রীয় কার্য-পরিচালনার ভাষা ইংরেজি প্রবর্তন করে। এর পরে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। শুধু তাই নয়, কলকাতা মাদ্রাসাকে কখনই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে এর শিক্ষা কার্যক্রমও মুসলিম জনগণের চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে কলকাতা মাদ্রাসায় এফএ পর্যায়ের ক্লাস সংযোজিত করা হয়। তদ্রূপ পরবর্তী সময় স্থগিত করা হয় এবং তা বাতিল করা হয়। এর ফলে মাদ্রাসায় একটি পৃথক ইনস্টিটিউট হিসেবে ইঙ্গ-ফারসি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইংরেজি ও ফারসি ভাষায় শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীদেরকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অংশগ্রহণের উপযোগী করে গড়ে তোলা। ১৮৬৩ সালে নবাব আব্দুল গণির জামাতা খাজা মুহাম্মদ আজগর ও মৌলবী ইলাহাবাদ খান ঢাকাতে মোহামেডান লিটেরারি সোসাইটির একটি শাখা প্রতিষ্ঠা করেন। ইসলামি শিক্ষার উপর অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়ার কারণে পূর্ব বাংলার মুসলমানরা তাদের সন্তানদের বিদ্যমান সরকারি বা প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ইংরেজি শিক্ষার জন্য পাঠাতে অনিচ্ছুক ছিল। কেননা এসব প্রতিষ্ঠানে ইসলামি শিক্ষাগ্রহণের কোনো সুযোগ ছিল না। দেশে যদি পৃথক কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হয় আর সেখানে যদি আরবি ও ফারসির সঙ্গে ইংরেজিও শিক্ষা দেওয়া হয়। অতিসহজ পদক্ষেপ যা অবিলম্বে মুসলমান ছাত্রের জন্য একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়। এর ফলে ইসলামি শিক্ষার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে।

লেখক
ড. মো. রফিকুল ইসলাম 
গ্রন্থাগার বিভাগের প্রধান 
সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম