খালিদ বিন হাসান আমাদের সহকর্মী খাদিজার পুত্র। দুদিন আগে সে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের মাঠে খেলতে গিয়ে নিখোঁজ হয়। প্রায় ২৪ ঘন্টার চেয়েও বেশি সময় পরে তাকে উদ্ধার করা হয় আরামবাগের এক মসজিদ থেকে। সে ফিরেছে তার মায়ের কোলে।
খালিদের বয়স ১৪। উদয়ন স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। মা খাদিজা ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের শিক্ষক। আমরা ধরেই নিতে পারি এলিফেন্ট রোডের বাসায় সে পরিবারের সঙ্গে স্বাচ্ছন্দেই বসবাস করতো। কোন কিছুর অভাব ছিল না। যতটুকু জানতে পেরেছি অভাব ছিল শুধু খেলাধুলার। জাহিনের মা খাদিজা তাকে দূরে কোথাও যেতে দিত না খেলতে। কিন্তু কেন ?
আমরা যারা কিশোর-কিশোরীর বাবা মা তারা জানি এই শহরে বাচ্চা বড় করা যে কত কঠিন কাজ। যাদের করতে হচ্ছে তারা জানে। বাচ্চাদের মন ও শরীর গঠনে প্রধান ভূমিকা রাখে খেলাধুলা। সেই খেলার কোন সুযোগ নাই বললেই চলে। যে দুএকটা মাঠ এখনো অবশিষ্ট আছে তাও বেশিরভাগ সময় বড়দের দখলে থাকে অথবা খেলার অনুমতি থাকে না।
জাহিনের প্রথম অভিযোগ তাকে খেলতে দেয়া হয় না। সে বিকেএসপিতে পড়তে চায় কারণ সেখানে খেলার ব্যবস্থা আছে। বাবা মা হয়তো তাতে রাজি হননি। ফলে সে অভিমান করে বাড়ি না ফিরে মসজিদে যেয়ে বসেছিল। সারারাত বাবা মা আত্মীয় স্বজনের কিভাবে কেটেছে সহজেই অনুমেয়। আমাদের সকলের চাওয়া শুনেছেন আল্লাহ। জাহিন ফিরেছে। খাদিজা একজন ভাগ্যবান মা। কারণ প্রায়ই কিশোরের মৃতদেহ পাওয়া যায় এই শহরে। আমরাও নিঃশ্বাস ফেলেছি। কিন্তু সত্যিই কি স্বস্তি এসেছে ?
খুব গভীর একটি প্রশ্ন আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কোথায় ঠেলে দিচ্ছি। ঘরবন্দি বাচ্চারা স্থুলতায় ভুগছে। সামাজিকীকরণ হচ্ছে না। বড় হয়ে তাদের ব্যবহারের মধ্যে অসামঞ্জস্যতা লক্ষিত হচ্ছে। এ দায় কার। ছুটি গল্পের ফটিক কিন্তু শুধু গল্প নয় এসমাজের প্রতিচ্ছবি।১৩/১৪ বছরের মতো বালাই আর নাই। সত্যিই মানুষের এই সময়টা অত্যন্ত জটিল। কারন তার এই সময়ে শারীরিক পরিবর্তনের সাথে সাথে মানসিক পরিবর্তন হয় হরমোনাল কারনে খুব বেশি আবেগী হয়ে পড়ে। অভিভাবক অনেকেই ঠিকভাবে হ্যান্ডেল করতে পারে না এবং অনেক সময় নিজেকে দিয়ে বিচার করে। যার দরুন অনেক আত্মহননের ঘটনাও ঘটে। আমাদের সেদিকটাও ভেবে দেখতে হবে। সময়ের পরিবর্তন হয়েছে। হাতের মুঠোয় পৃথিবী। নব টিপলেই ভালোমন্দ সব দেখা বা জানার সুযোগ আছে। তাই ইচ্ছা করলেই আপনার মতামত এখনকার বাচ্চাদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারবেন না।
আর যে বয়সটার কথা বলছি সেই বয়সে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হতে থাকে। সে বিষয়টাকে বাদ দিলে চলবে না।
অনেক সময় বাবা মায়েদের বলতে শুনি , আমার ছেলে বা মেয়ে কিছু বোঝে না দুনিয়ার। তাদের কাছে আমার প্রশ্ন ওই বয়সে আপনি কি কিছুই বুঝতেন না? যদি বুঝতেন তাহলে আপনার বাচ্চাও বোঝে। বাচ্চাকে তার বয়স অনুযায়ী সবকিছু পরিষ্কার করুন সমাজ সর্ম্পকে ধারণা দিন । তার বয়োঃসন্ধি সর্ম্পকে বলুন। এই ফেজটাতে তাকে কী কী অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে সেটি বলুন। ছেলে মেয়ে যাইহোক। তাহলে তার নিজের পরিবর্তন সর্ম্পকে সঠিক ধারণা তৈরি হবে। তাকে বই পড়ায় আগ্রহী করে তুলুন। খেলার সুযোগ যতটুকু সম্ভব করে দিন। লেখাপড়ার পাশাপাশি সৃজনশীল কাজে যুক্ত করুন তার পছন্দমত। তার কোন প্রশ্ন থাকলে তা এড়িয়ে না গিয়ে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করুন। এতে করে আপনার সাথে তার সর্ম্পক আরো ঘনিষ্ঠ হবে। এই সময়টায় ছেলেমেয়েরা একা থাকতে চায়। তার প্রাইভেসি দিতে হবে কিন্তু সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে সে কি করছে ? সর্বোপরি তার বন্ধু হয়ে উঠুন। কোন গোপনীয়তার প্রয়োজন যেন না পরে। তার ইচ্ছাগুলো পূরণ করা সম্ভব হলে করুন আর না হলে বুঝিয়ে বলুন কেন সম্ভব নয়।
আসলে আমাদের যুগ শেষ হয়ে গেছে। বাবা মা মারলেও কিছু মনে করতাম না খুব বেশি হলে ভাত খেতাম না। আমরা বাবা মাকে খুশী করার চেষ্টা করতাম। আর এখন বাচ্চাদের খুশী করতে আমরা তঠস্ত থাকি। যদি কেউ খুশী করতে ব্যস্ত না থাকে তাহলেই বাচ্চাদের অভিযোগের শেষ থাকে না। সময়ের পরিবর্তনের সুবিধাগুলো আমরা ভোগ করছি আর অসুবিধাগুলো নেব না তা হয় না। সব নিয়েই আমাদের চলতে হবে। আমদের ভাবনার জায়গাটা বদলাতে হবে।
যারা নীতিনির্ধারক তাদের ভাবতে হবে এই উঠতি বয়সের ছেলেমেয়ের কথা। প্রতিটি এলাকায় খেলার মাঠ থাকতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্টানে মাঠ বাধ্যতামূলক থাকতে হবে। আবাসিক এলাকাতে পার্ক থাকলেও সেখানে মানুষ হাঁটাহাটি করে। সেটাও প্রয়োজন। নাহলে আপনি হাঁটবেন কোথায় ? বাচ্চারা সেখানে খেলতে পারে না। রাস্তার মধ্যে ক্রিকেট খেলে।
এই শহরকে শুধু ইট কাঠ পাথরের বস্তি না বানিয়ে খেলার মাঠ রাখতে হবে যেন অভিমান করে কোন জাহিনকে অন্য কোথাও চলে যেতে না হয়। আমরা কেন ভাববো ছেলে মেয়েকে শুধু ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে ? দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে দেখেছি ছেলে বা মেয়ে সায়েন্স পড়তে চায় না কিন্তু অভিভাবক তাকে বাধ্য করেছে সায়েন্স পড়তে। ফলাফল রেজাল্ট খারাপ। অধ্যক্ষ অবস্থায় অনেক শিক্ষার্থী এসে বলেছে তার অভিভাবককে বলতে সে সায়েন্স পড়তে চায় না । বলেছি। অনেক অভিভাবক শুনেছেন। বেশীরভাগ শোনেননি। রেজাল্ট খারাপ হয়েছে। অনেকক্ষেত্রে ভালো রেজাল্ট কিন্তু ডাক্তারি পড়তে চায় না। বাবা মা পড়াবেনই। এরকম ঘটনা ঘরে ঘরে। তাই আমাদের সচেতন হতে হবে। যে পড়বে তার ইচ্ছাকে মূল্যায়ন করতে হবে।
ডাক্তার , ইঞ্জিনিয়ার মানেই সফল জীবন নয়। এটা মাথায় নিতে হবে। আপনার বাচ্চা আপনি তাকে পৃথিবীতে এনেছেন ঠিকই কিন্তু সে একটা আলাদা মানুষ। যা জোড়ালো হতে থাকে বয়:সন্ধিতে। তাই বুঝিয়ে নিজের ইচ্ছেটা পূরণ করতে না পারলে চাপিয়ে দেবেন না। কিশোরীদের কথাতো বলার অপেক্ষা রাখে না। তাদের এই সময়টা সত্যিই এই শহরে কষ্টদায়ক। নিরাপত্তার অভাবে একা কোথাও যেতে পারে না। ফলে মোবাইলের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। যা চিন্তার বিষয়। বিভিন্নভাবে প্রলোভিত হচ্ছে ওইটুকুন একটা যন্ত্রের মাধ্যমে। তাদেরও প্রয়োজন মুক্ত বাতাস যেখানে সে নির্ভয়ে বেড়ে উঠবে। নাহলে শারীরিক সমস্যার সাথে সাথে মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা বৃদ্ধি পাবে।
যাইহোক, কে জানে বিকেএসপিতে পড়ে আরো একটা পৃথিবী সেরা অলরাউন্ডার আমরা পেতে পারি জাহিনকে।
হতেই তো পারে। আমরা আশা নিয়ে বাঁচি। বেঁচেতো আছি।
লেখক: অধ্যাপক ফেরদৌসী পারভিন
সাবেক অধ্যক্ষ, গাজীপুর সরকারি মহিলা কলেজ