Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

মামুনুর রশীদ কীভাবে তৈরি করবেন হিরো আলমকে?

Icon

সায়েম খান

প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০২৩, ১২:৪৩ পিএম

মামুনুর রশীদ কীভাবে তৈরি করবেন হিরো আলমকে?

রুচির প্রসঙ্গ টেনে নাট্যজন মামুনুর রশীদ যেন মহাঅপরাধ করে ফেলেছেন। তিনি তথাকথিত এক ব্যক্তি নিয়ে মন্তব্য করেছেন বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেন অন্যায় আর প্রতিবাদের ঝড় উঠে গেছে। ছেলে থেকে বুড়ো সব শ্রেণির লোকের বিষোদগারে যেন মামুনুর রশীদের মতো প্রথিতযশা নাট্যকার ও অভিনেতা আজ তিক্ত। হিরো আলম বাস্তবিক অর্থে শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙনে কদর্যহীনভাবে যা উপস্থাপন করছেন তা কি নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করলে প্রদর্শনযোগ্য? 

চলনে-বলনে আপাদমস্তক ভাঁড়কে নিয়ে যদি কেউ মন্তব্য করেন, তা হলে মন্তব্যকারীকে দ্বিগম্বর করাই কি শ্রেয়? তা হলে রুচির প্রশ্নে যারা এত কথা বলে, তারাই বা কতটুকু রুচিশীল? ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন— যে দেশে গুণীর কদর নেই, সে দেশে গুণী জন্মাতে পারে না। এই কথার মর্মার্থ কি আমরা বর্তমান সময়ে অনুধাবন করতে পারছি? 

মামুনুর রশীদ স্যার যা বলেছেন, তা অনেক আগেই আরও অনেক গুণীজনের বলা উচিত ছিল। কারণ অপাংক্তেয়দের দিয়ে একটা জাতির শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ঝাণ্ডা দাঁড় করানো যায় না। অতি নিম্নমানের নাচ, গান ও অভিনয় প্রদর্শন করে হিরো আলম যে সস্তা জনপ্রিয়তা কুড়িয়েছেন, তা দিয়ে হয়তো তিনি ব্যক্তিগতভাবে কিছু করে খেতে পারছেন। কিন্তু একটি জাতির সাংস্কৃতিক মানদণ্ড কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে তা কি আমরা কেউ অনুধাবন করতে পেরেছি? 

আজ হয়তো অনেকে হিরো আলমের অনুসরণযোগ্য। আমরা নিশ্চিত কয়েক বছরের মধ্যে আরও এক-দুজন হিরো আলমকে মিডিয়া কাভারেজ দেবে। এভাবে আমাদের সাংস্কৃতিক অঙনে ভুঁইফোড় হিরো আলমেরা কদর্যহীনভাবে তাদের নাচন-কোদন প্রদর্শন করে অপসংস্কৃতির বীজ বুনে যাবে। যে বীজ একদিন অংকুরিত হয়ে এক মনস্টারে পরিণত হবে বলে ধারণা করা যায়। 

হিরো আলম একটি নিম্নমানের বস্তাপচা সস্তা ট্রেন্ড। তার কুবাতাস আকাশে-বাতাসে হয়তো আরও কিছু দিন বইবে। বাতাসের দমকা হাওয়া থেমে গেলে একদিন ঝড়ে পড়ার দলে হারিয়ে যাবে আজকের উত্তেজনা। কিন্তু এর মধ্যে হিরো আলম নিজ স্বার্থ হাসিল করে সমাজের উচ্চবিত্ত হয়ে একটি জায়গা দখল করে নেবেন। অবশেষে একটা জাতি সংক্রমিত হবে অপসংস্কৃতির দুরারোগ্য ব্যাধিতে। অতঃপর সেই ব্যাধি থেকে বাঁচার জন্য বা মুক্ত হওয়ার জন্য মামুনুর রশীদের মতোই শিল্প-সংস্কৃতির গুণীজনরা নিঃস্বার্থে এগিয়ে আসবেন। মামুনুর রশীদেরা মন ও মননের কথা বলে। তারা তাদের কর্মে ও গুণে রুচি ও সৌন্দর্যের বিচার করেন। 

সমাজের সামগ্রিক অস্থির শিল্পচর্চার অবস্থা নিরুপণ করে মামুনুর রশীদের মতো নাট্যজনেরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে যদি তার পুত্রসম হিরো আলমকে তার কর্মের গুণাগুণ বিচারে রুচির প্রশ্ন উত্থাপন করেন, তা হলে এতে তার সমধিক বাহবা পাওয়া উচিত। কিন্তু আমরা দুদলে বিভক্ত হয়ে মামুনুর রশীদ বনাম হিরো আলম নামক একটা নোংরা খেলা শুরু করেছি, যা কিনা একটি জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়েছে বিগত কয়েক দিন।  

নাটক-সিনেমা জগতের রথী-মহারথীদের অনেকেই হিরো আলমের পক্ষ নিয়ে মামুনুর রশীদকে কটুক্তি করছেন, নিন্দা জানাচ্ছেন। কিন্তু বিষয়টি অন্যভাবে চিন্তা করলে দেখা যায়— সমগ্র মিডিয়া জগতে আমরা কী প্রদর্শন করছি, আর কী গ্রহণ করছি, তারই একটি মেটাফোর তিনি তার মন্তব্যে তুলে ধরেছেন। এই মেটাফোরের একটি উদাহরণ হিসেবে হিরো আলম বিবেচ্য। তিনি এখানে ব্যক্তি হিরো আলমের অর্জন বা সফলতা নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। 

নৌকায় ফুটো থাকলে জল ঢুকে যেমন নৌকাকে ডুবিয়ে দেয়, তেমনি রুচিহীন ও মানহীন শিল্পের আধিপত্যে হিরো আলমের মতো অপাংক্তেয় ও অযোগ্যরা প্রবেশ করার কারণে শিল্প তার কদর্য হারাচ্ছে এবং এ কারণেই মানুষ সত্যিকারের শিল্প ও সংস্কৃতির গভীরতা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে যোজন যোজন দূরে।

হিরো আলম তার কাউন্টার পার্টে মামুনুর রশীদ স্যারকে বলেছেন, স্যার যেন তাকে তৈরি করেন। তাকে তৈরি করতে না পারলে নাকি রুচিরও পরিবর্তন হবে না। হিরো আলমের এই কথাগুলো কতটুকু সংবেদনশীল তার কিছুটা বিশ্লেষণ না করলেই নয়। মানলাম হিরো আলম জনপ্রিয়, তার কোটি মানুষের একটি ফ্যানবেজ তৈরি হয়েছে। কিন্তু তিনি যা করবেন সেটাই কি জাতিকে গিলে খেতে হবে। সেটাকেই রুচিশীল করে নিতে হবে? তা হলে কি ব্যাপারটি এই দাঁড়াচ্ছে— হিরো আলমের প্রতিটি কর্মকাণ্ড অর্থাৎ তিনি যা মিডিয়াতে ফোকাস করেন, তাই আমাদের সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে? তার ফ্যানবেজ তৈরি হয়েছে, তার ব্যক্তিগত সংগ্রামী জীবনের ছায়াকে অবলম্বন করে। 

একদিকে তার দেখার অযোগ্য শ্রীহীন নাচ-গান আর অভিনয়ের কারণে হাজারও মানুষের ট্রলেও তিনি টলছেন না। অপরদিকে তার ছেলেবেলা থেকে জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার গল্পের আবেগময়তার কারণে হাজার মানুষের মনে তার ঠুনকো জনপ্রিয়তার জায়গাটি তৈরি হয়েছে। এই জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী হলেও তার স্থায়িত্ব কতটুকু তা প্রণিধানযোগ্য। 

একজন মামুনুর রশীদ নিভৃতচারী। আজকের ‌‘চঞ্চল চৌধুরী’ কিন্তু তারই গড়া। নানা ত্যাগ তিতিক্ষার পরেই মামুনুর রশীদ গড়তে পেরেছেন একজন চঞ্চল চৌধুরীকে। সেলিব্রিটির তকমা বাদ দিয়ে, দুনিয়ার তাবৎ সুখভোগ বাদ দিয়ে হিরো আলম কি পারবেন চঞ্চল চৌধুরীর পদাংক অনুসরণ করতে। তা হলে মামুনুর রশীদ ঠিকই পারবেন হিরো আলমকে তৈরি করতে। 

পৃথিবীর সব শিল্পী বা অভিনেতার জীবন ঘাঁটলে দেখা যায় সবাই তার নিজের চেষ্টায় সফলতার শিখরে অবস্থান করছেন। অর্জনের পেছনে ছুটতে গেলে যে কঠিন সংগ্রাম ও অধ্যবসায় দরকার, সেটি আদৌ হিরো আলমের জানা আছে কিনা তা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম