Logo
Logo
×

ঘরে বাইরে

ভ্রমণ

পুঠিয়া রাজবাড়ি

Icon

সুমন্ত গুপ্ত

প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পুঠিয়া রাজবাড়ি

ছবি: সংগৃহীত

রাত দশটা আমি আর মা আছি কল্যাণপুরে, অপেক্ষা বাসের জন্য। ঘোষণা দেওয়া হলো অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের বাস রাজশাহীর উদ্দেশে যাত্রা শুরু করবে। আঁধার ভেদ করে আমাদের বাস ছুটে চলছে। বাসের জানালা ভেদ করে দেখতে পাচ্ছিলাম আঁধার রাতে গন্তব্য পানে ছুটে চলা মানুষের মুখচ্ছবি। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আঁধার ভেদ করে ফুটে উঠল আলো। আমরা এসে পৌঁছালাম রাজশাহী শহরে। এবার কিছু সময় বিশ্রাম নেওয়ার পালা।

আগের থেকেই আমার অফিস সহকর্মী তসিকুলকে বলে রেখেছিলাম। সে আগে থেকে হোটেল খুঁজে রেখেছিল, তাই হোটেল খোঁজ করতে আর আমাদের বেগ পেতে হয়নি। মোবাইল মহাশয়ের ডাকাডাকিতে ঘুম থেকে উঠতেই হলো। তাকিয়ে দেখি তসিকুলের ফোন, স্যার সকাল এগারোটা হতে চলল ঘুম থেকে উঠুন। আমি রাস্তায় আছি হোটেলের দিকে আসছি। ঘুম থেকে উঠে দ্রুত তৈরি হয়ে নিলাম। ও বলাই হলো না, আমরা রাজশাহী এসেছি। বাংলার প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের মধ্যে অন্যতম রাজশাহীর পুঠিয়া রাজবাড়ি দেখতে। তসিকুল এসে উপস্থিত।

আমরা সকালের নাশতা করে বের হয়ে পড়লাম রাজবাড়ির পথে। এবার বাসে করে ৩৪ কিলোমিটার দূরে, পুঠিয়াতে যেতে হবে। রাজশাহী থেকে নাটোরগামী বাসে চড়ে বসলাম। নামতে হবে পুঠিয়া বাসস্ট্যান্ডে। স্ট্যান্ডে নামতেই দেখা পেলাম নসিমনের। পাঠক, নসিমনকে রমণী ভেবে থাকলে ভুল করবেন, এটা ইঞ্জিনচালিত ত্রিচক্রযান। অনেক নাম শুনেছি নসিমনের আজ নিজের চোখে দেখলাম। যা হোক, নসিমনে চেপে আমরা এগিয়ে গেলাম রাজবাড়ির পথে। চলতি পথে গুগল ঘেঁটে জেনে নিলাম এর ইতিহাস। সপ্তদশ শতকে মোগল আমলে তৎকালীন বাংলার বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে পুঠিয়া জমিদারি ছিল প্রাচীনতম। কথিত যে, জনৈক নীলাম্বর মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে ‘রাজা’ উপাধি লাভ করার পর, সেটি পুঠিয়া রাজবাড়ি হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। ১৭৪৪ সালে জমিদারি ভাগ হয়।

সে ভাগাভাগিতে জমিদারের বড় ছেলে পান সম্পত্তির সাড়ে পাঁচ আনা এবং অন্য তিন ছেলে পান সাড়ে তিন আনা। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত জমিদারি প্রথা ছিল। প্রথা বিলুপ্ত হলে, পুঠিয়া রাজবাড়ির জমিদারিও বিলুপ্ত হয়। কিন্তু জমিদারি বিলুপ্ত হলেও সে আমলে নির্মিত তাদের প্রাসাদ, মন্দির ও অন্যান্য স্থাপনা ঠিকই এখনো টিকে রয়েছে। অপরূপ এ প্রাসাদটি ১৮৯৫ সালে মহারানি হেমন্ত কুমারী দেবী তার শাশুড়ি মহারানি শরৎ সুন্দরী দেবীর সম্মানে নির্মাণ করান। আমরা এসে পৌঁছলাম। পুঠিয়া বাজারে প্রবেশ করতেই হাতের বাঁ পাশে শিবসাগর নামক দিঘির দক্ষিণ পারে বড় শিবমন্দিরের দেখা পেলাম। সেখানে নসিমনের ভাড়া চুকিয়ে এগিয়ে গেলাম সম্মুখ পানে। কারুকার্যময় শিবমন্দির, সঙ্গে দিঘির পাড়ের নির্মল বাতাস। উঁচু মঞ্চের ওপর নির্মিত মন্দিরটির দক্ষিণ দিকে আছে সুপ্রশস্ত সিঁড়িসহ প্রধান প্রবেশপথ।

চারপাশে টানা বারান্দায় রয়েছে ৫টি করে খিলান প্রবেশপথ। বারান্দার পিলারগুলোর নিচের অংশ চমৎকারভাবে অলংকৃত এবং মেঝের বহিরাংশে বেলে পাথর স্থাপিত। মন্দিরের মূল কক্ষের পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ দেওয়ালে ১টি করে প্রবেশ পথ রয়েছে। যেখানে বেলে পাথরের চৌকাঠ ব্যবহৃত হয়েছে এবং চৌকাঠগুলো ফুল আকৃতির নকশা দ্বারা অলংকৃত। প্রত্যেক প্রবেশ পথের দুপাশে চুন-সুরকি দ্বারা নির্মিত। দেব-দেবীর দণ্ডায়মান মূর্তির দেখা পেলাম আমরা। উত্তর পাশে অবস্থিত দিঘিতে নামার জন্য বাঁধানো ঘাট এবং ঘাটে ওঠা-নামার জন্য পৃথক সিঁড়ির ব্যবস্থা আছে।

চতুষ্কোণাকৃতির কাঠামোর ওপরে পিরামিড আকৃতির চূড়াগুলো নির্মিত হয়েছে। পুঠিয়ায় অবস্থিত মন্দিরগুলোর মধ্যে এটি উল্লেখযোগ্য। পাঁচআনী জমিদার বাড়ির রানি ভুবনময়ী দেবী এ মন্দিরটি নির্মাণ করেন। তাই এ মন্দিরকে ভুবনেশ্বর মন্দিরও বলা হয়। বড় শিবমন্দির থেকে কয়েক ক্রোশ দূরত্বে জগন্নাথ মন্দির অবস্থিত। এ মন্দিরটিতে পোড়ামাটির কোনো ফলক না থাকলেও এর নির্মাণশৈলী বেশ চমৎকার। উত্তর ও পূর্ব পাশে রয়েছে দুটি প্রবেশপথ। প্রবেশপথে বেলে পাথরের চৌকাঠের ওপর চমৎকার অলংকরণ আছে। দোতলার কক্ষটি আকারে ছোট এবং এটির চারপাশে উন্মুক্ত প্রবেশপথ আছে। এ মন্দিরটি রানি ভুবনময়ী ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে বড় শিবমন্দির নির্মাণের পরপরই নির্মাণ করিয়েছিলেন বলে জানা যায়। আমরা পদব্রজে চলছি এগিয়ে সঙ্গে আছে তসিকুল। আমরা এবার এলাম দোল মন্দিরে।

পুঠিয়া বাজারের মধ্যে অবস্থিত ৪ তলাবিশিষ্ট এটি একটি সুদৃশ্য অট্টালিকা। মন্দিরটি দোলমঞ্চ আকারে ক্রমান্বয়ে সরু হয়ে ওপরে উঠে গেছে। মন্দিরের দ্বিতল, নিচের তলা থেকে ছোট, ত্রিতল, দ্বিতলের চেয়ে ছোট এবং ত্রিতলের ওপরে চতুর্থ তলাটি আরও ছোট। চতুর্থ তলার ওপরে আছে মন্দিরের গম্বুজাকৃতির চূড়া। এরপর আমরা গেলাম পুঠিয়া পাঁচআনী জমিদার বাড়ি অঙ্গনে অবস্থিত গোবিন্দ মন্দিরে। রাজবাড়ির নিচের অংশের একটা সুপ্রাচীন দরজা দিয়ে প্রবেশ করলাম আমরা। লোকসমাগম একদম খারাপ নয়। নিয়মিত পূজা-অর্চনা হয় বোঝা গেল। মন্দিরের কেন্দ্রস্থলে আছে একটি কক্ষ। চার কোনায় আছে ৪টি বর্গাকৃতির ছোট কক্ষ। মন্দিরের পিলার ও দেওয়াল অসংখ্য পোড়ামাটির চিত্রফলক প্যানেল দ্বারা সজ্জিত। মন্দির গাত্রের সর্বনিম্ন স্তর ফুলেল ফলক এবং এর ওপরের সারিতে হাতি, ঘোড়া, পালকি, তির-ধনুকসহ মোগল আমলের শিকারের বিভিন্ন দৃশ্য পোড়ামাটির চিত্রফলকের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে।

তার ওপর বিভিন্ন সারি ও কলামে হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি, রামায়ণ ও মহাভারতে বর্ণিত শ্রীকৃষ্ণ ও রাধারানির প্রেম বিনিময়ের চিত্র, শ্রীকৃষ্ণ ও রাধারানির নৌকাবিলাস এবং বিভিন্ন দেব-দেবীর প্রতিকৃতি চিত্রিত হয়েছে। মন্দিরের পশ্চিম দিকের প্রবেশপথের ওপরে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ এবং রাম-রাবণের যুদ্ধের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। চিত্রফলকগুলো দেখে কান্তজীর মন্দিরের কথা মনে পড়ে গেল। আমরা এলাম রাজবাড়ির মূল ভবনের সামনে। শুধু কাচারি অঙ্গনের উত্তর ও পশ্চিমের দ্বিতলবিশিষ্ট দুটি ব্লক ছাড়া প্রাসাদটির অন্যান্য অংশ একতলা আকারে নির্মিত। এ প্রাসাদ নির্মাণে উপকরণ হিসাবে ইট, চুন-সুরকি, লোহা ও কাঠ ব্যবহৃত হয়েছে। কাচারি অঙ্গন ও মন্দিরাঙ্গনে প্রবেশের জন্য রাজবাড়ির সম্মুখে পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে রয়েছে দুটি সুউচ্চ ফটক। আমরা এগিয়ে যেতে থাকলাম। দেখতে পেলাম বারান্দা ওঠার জন্য কাঠের সিঁড়ি। তসিকুল বলল, কাচারি অঙ্গনের উত্তর দিকের নিচতলার কক্ষটি ট্রেজারি অফিস ছিল। রাজবাড়ির কক্ষগুলোর অভ্যন্তর ও বাইরে পলেস্তারার আস্তরণে এবং সম্মুখভাবে আকর্ষণীয় ইন্দো-ইউরোপীয় স্থাপত্যরীতির প্রভাব লক্ষ করা যায়।

দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমরা এবার ভেতরের কক্ষগুলো দেখতে পারিনি। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার পরই দেখি দরজা বন্ধ। ছাত্রাবস্থায় যখন এসেছিলাম তখন অবশ্য রাজবাড়ির ছাদ পর্যন্ত উঠেছিলাম। সংস্কার কাজের জন্য আপাতত দোতলায় প্রবেশ নিষেধ। মনের মাঝে একটি প্রশ্ন খেলা করছিল, এ রাজবাড়িকে পাঁচআনী রাজবাড়ি বলার পেছনে কারণ কী? আমার প্রশ্নের উত্তর পেলাম তসিকুলের কাছে। ১৭৪৪ সালে পুঠিয়ার রাজা ছিলেন অনুপনারায়ণ। নরেন্দ্রনারায়ণ, রুপেন্দ্রনারায়ণ, মোদননারায়ণ এবং প্রাণনারায়ণ নামে তার ৪ পুত্র ছিল।

অনুপনারায়ণের মৃত্যুর পর তার বড় ছেলে নরেন্দ্রনারায়ণ গোপনে সব সম্পত্তি নিজের নামে করার চেষ্টা করেন। তা জানতে পেরে অনুজ তিন ভাই বাধা দেন এবং সম্পত্তির সমান চার ভাগ হয়। পরে নরেন্দ্রনারায়ণ জ্যেষ্ঠত্বের দাবি জানালে ছোট তিন ভাই প্রত্যেকের অংশ থেকে আধা আনা করে বড় ভাইকে ছেড়ে দেন। ফলে নরেন্দ্রনারায়ণের অংশে সাড়ে পাঁচ আনা এবং অপর তিন ভাইয়ের অংশে পড়ে সাড়ে তিন আনা করে। এ সাড়ে পাঁচ আনা থেকেই পাঁচআনী জমিদারবাড়ি নাম হয়।

এ জমিদারবাড়ির ভিত্তির ওপরই পরে মহারানি হেমন্তকুমারী রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন। এরপর আমরা একে একে ঘুরে দেখলাম চারআনী রাজবাড়ি, বড় আহ্নিক মন্দির, ছোট গোবিন্দ মন্দির, গোপাল মন্দির। পুঠিয়ার নিদর্শনগুলোর দেখার সবচেয়ে সুবিধা হচ্ছে সব নিদর্শনই কাছাকাছি জায়গায় অবস্থিত। যে কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে ঘুরলেই আমার মনের ভেতর বিষাদ ভর করে। পুরাকীর্তিগুলো ক্ষণে ক্ষণে স্মরণ করিয়ে দেয় জীবন কত ক্ষণস্থায়ী।

কীভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে রাজশাহী : ঢাকা থেকে সড়ক, রেল ও আকাশপথে রাজশাহী যাওয়া যায়। সড়কপথে ঢাকার গাবতলী ও কল্যাণপুর থেকে বাসে উঠতে হবে। এজন্য গ্রিন লাইন, দেশ ট্রাভেলস, শ্যামলী ও হানিফসহ বেশ কয়েকটি বাস সার্ভিস রয়েছে। শ্রেণিভেদে ভাড়া পড়বে ৪০০ থেকে ১ হাজার টাকা। রেলপথে যাওয়ার জন্য রয়েছে সিল্কসিটি এক্সপ্রেস ও পদ্মা এক্সপ্রেস নামে দুটি ট্রেন। রোববার ছাড়া প্রতিদিন দুপুর ২টা ৪০ মিনিটে সিল্কসিটি এক্সপ্রেস এবং মঙ্গলবার ছাড়া প্রতিদিন রাত ১১টা ১০ মিনিটে কমলাপুর থেকে রাজশাহীর উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ভাড়া শ্রেণিভেদে ৩৫০ থেকে ১ হাজার ৮১ টাকা পর্যন্ত। এছাড়া আকাশপথে ঢাকার শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, ইউনাইটেড এয়ার ও ইউএস-বাংলা এয়ারের বিমানে রাজশাহী যাওয়া যায়।

রাজশাহী থেকে পুঠিয়া : পুঠিয়ার দূরত্ব রাজশাহী থেকে ৩৪ কিলোমিটার এবং নাটোর থেকে ১৮ কিলোমিটার। রাজশাহী থেকে নাটোরগামী বাসে চড়ে বা লোকাল বাসে করে রাজশাহী-নাটোর মহাসড়কের পুঠিয়া বাসস্ট্যান্ডে নেমে ৫ থেকে ১০ মিনিট হাঁটলেই পুঠিয়া রাজবাড়ি।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম