পরাশক্তির মোড়লগিরি ঠেকানোর উপায়

এটিএম মোস্তফা কামাল
প্রকাশ: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ছবি: সংগৃহীত
যে কোনো পরাশক্তিকে পাত্তা না দিয়ে চলার পথ প্রশস্ত করার জন্য বাংলাদেশকে দুটো কাজ করতে হবে : অর্থনৈতিক সংস্কার এবং সামরিক শক্তি বৃদ্ধি।
ক. অর্থনৈতিক সংস্কার-
১. রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে : লার্জ ট্যাক্স পেয়ারদের দেওয়া আয়কর অব্যাহতি প্রত্যাহার করে তাদের কাছ থেকে আয়কর আদায় করতে হবে।
রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাদের লক্ষ কোটি টাকার আয়কর অব্যাহতি দেওয়ার কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। কারণ তারা প্রজাতন্ত্রের সম্পত্তি নদীর পার দখল করে শিল্প-কারখানা করছেন, ব্যাংকে রক্ষিত জনসাধারণের অর্থ সঠিক জামানত না দিয়ে ঋণ হিসাবে নিয়ে সঠিকভাবে বিনিয়োগ না করে আত্মসাৎ করছেন কিংবা বিদেশে পাচার করছেন, তারা সঠিক জামানত না দিয়ে ব্যাংকের সঙ্গে প্রতারণা করছেন, তারা বিশ্বমানের মজুরি না দিয়ে শ্রমিক/কর্মচারীদের ঠকাচ্ছেন, ঋণের অর্থ ফেরত না দিয়ে সে অর্থ নিজের উন্নতমানের গাড়ি/বাড়ি ক্রয়ের কাজে ব্যয় করছেন, অর্থ পাচার করে বিদেশে ব্যবসা করছেন, শিল্প-কারখানার বর্জ্য দিয়ে নদীদূষণ করছেন-দেশের পরিবেশ দূষিত করে নিজ পরিবারসহ ইউরোপে বসবাস করবেন এবং ঋণ পরিশোধের জন্য চাপ প্রয়োগ করলে দেশের নাগরিকত্ব ছেড়ে বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণ করবেন।
তাদের কাছ থেকে কী পেয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃপক্ষ তাদের লক্ষ কোটি টাকার আয়কর অব্যাহতি দিয়ে দেশটিকে দেউলিয়া হওয়ার পথে ঠেলে দিচ্ছেন? জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এরূপ হঠকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে রুখে দাঁড়াতে হবে।
২. বড় বড় এনজিওকে দেওয়া আয়কর অব্যাহতির আদেশ প্রত্যাহার করতে হবে। তাদের কাছ থেকে নিয়মানুযায়ী আয়কর আদায় করতে হবে। যারা ব্যবসা করে আয় করছে, তাদের আয়কর দিতে হবে-এটাই হবে রাষ্ট্রের মূল নীতি।
ছোট-বড় সব এনজিওর একমাত্র টার্গেট হচ্ছে অধিক মুনাফা। তাদের পরিচালিত ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমে সুদের হার কম-বেশি ৩০ শতাংশ। সুতরাং বড় বড় এনজিওকে আয়কর অব্যাহতি দেওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।
৩. বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকসহ এ ধরনের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রকল্প সহায়তা বাবদ বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে বিদেশে প্রশিক্ষণ এবং গাড়ি ক্রয়ের জন্য কোনো ঋণ গ্রহণ করা যাবে না। পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রেও কঠোরতা অবলম্বন করতে হবে। লার্জ প্রজেক্ট ছাড়া কোনো পরামর্শক নিয়োগ করা যাবে না। প্রকল্পের দুর্নীতি এবং বৈদেশিক ঋণের অপচয় রোধকল্পে এটি বাধ্যতামূলক করতে হবে। এ শর্ত মেনে ঋণ দিলে আমরা সেই ঋণ নেব, অন্যথায় সেটা নেব না। ভিয়েতনাম বহুকাল আগে একই রূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
নিজস্ব অর্থে যে প্রকল্প ২০ কোটি টাকা দিয়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব, দাতা সংস্থার অর্থায়নে সেটি করতে ব্যয় হবে ২০০ কোটি টাকা। দেশকে বন্ধক রেখে এরূপ ঋণ গ্রহণের সংস্কৃতি থেকে সরে আসতে হবে।
কোনো অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে, সমাজসেবা অধিদপ্তরের খাতিরের প্রকল্পে এবং ক্লাব ভবন-সমিতি ভবন ইত্যাদি নির্মাণে অর্থ বরাদ্দ করা যাবে না।
৪. রাষ্ট্রকে বন্ধক দিয়ে নেওয়া ঋণের টাকায় কর্মকর্তাদের বিদেশে সাইট সিংয়ের জন্য বেড়াতে যাওয়া একটা অনৈতিক বিলাসী এবং গুরুতর অন্যায় কাজ। এটি বন্ধ করা অত্যাবশ্যক। সুতরাং ক্যাপাসিটি বিল্ডিং প্রজেক্ট নামীয় কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা যাবে না।
৫. যেসব সংস্থার নিজস্ব আয় আছে, সেসব সংস্থাকে নিজস্ব আয়ের অর্থ দিয়ে নিজেদের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। তারা বৈদেশিক ঋণের অর্থে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করতে পারবে না। রেলওয়ে, বাংলাদেশ বিমান, স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষসহ সব সংস্থার ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য।
৬. LOC-Line of Credit-এর অধীনে Indian/Chinese Exim Bank-এর কাছ থেকে বাণিজ্যিক সুদে কোনো বৈদেশিক ঋণ নেওয়া যাবে না। কারণ এরূপ ঋণ রাষ্ট্রের অনেক ক্ষতি করছে।
৭. ভারতের সঙ্গে করা ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তি বহাল রাখা হলে তা রিভিউ করে আন্তর্জাতিক মানে ট্যারিফ ধার্য করতে হবে এবং ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তির শুরু থেকে সেটি কার্যকর করতে হবে। ট্যারিফ ধার্য করার আগে ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তি অকার্যকর হিসাবে গণ্য করা যেতে পারে।
৮. বিপিসি তেল আমদানি করে সেটি বেশি দামে বিক্রি করে আয় করে থাকে। আয়ের অর্থ দিয়ে আবারও তেল আমদানি করবে। কাজেই বিপিসি কর্তৃক কোনো বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার কথা নয়। কিন্তু বিপিসি নিজস্ব অর্থ ব্যাংকে গচ্ছিত রেখে বৈদেশিক ঋণ নিয়ে তেল আমদানি করে থাকে। বিপিসির এরূপ কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে।
৯. মিটিং অ্যালাউন্স এবং গাড়ি ভাতা প্রদান বন্ধ করে দিতে হবে। অপ্রয়োজনীয় অফিস বন্ধ করতে হবে-উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অধিদপ্তর, প্রতিযোগিতা কমিশন, দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-এরূপ আরও অনেক অকার্যকর প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় অর্থে পোষার কোনো মানে নেই-সিঙ্গাপুরে এটি কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়ে থাকে, অননুমোদিত পদে পদোন্নতি দিয়ে রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতি করার কোনো মানে নেই [অননুমোদিত পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা প্রদান করা যাবে না]; বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বসিয়ে রেখে বেতন-ভাতা প্রদান করা যাবে না [No Service No Pay]।
১০. দেশে গ্যাসকূপ খনন, গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার, উত্তোলন এবং বিপণনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। এলএনজি আমদানিকে নিরুৎসাহিত করতে হবে।
১১. সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য নতুন গাড়ি ক্রয় ১৫-২০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করতে হবে। বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য যেসব গাড়ি ক্রয় করা হয়েছে, প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষে কিংবা প্রকল্পের কাজে অপ্রয়োজনীয় হলে সেসব গাড়ি পরিবহণ পুলে ফেরত দিতে হবে। প্রকল্পের জন্য কেনা গাড়ি প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা ছাড়া অন্য কেউ ব্যবহার করতে পারবেন না।
১২. রপ্তানি প্রণোদনা প্রদান বন্ধ করে দিতে হবে; কারণ এ সুযোগের অপব্যবহার করে বিদেশে মুদ্রা পাচার করা হয়ে থাকে, ভুয়া বিল দাখিল করে বৈদেশিক মুদ্রা আত্মসাৎ করা হয়ে থাকে।
১৩. দেশের ব্যাংক ব্যবস্থাপনাকে সর্বোচ্চ মানে উন্নীত করতে হবে। ঋণ ব্যবস্থাপনাকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সংসদ-সদস্য, প্রভাবশালী ব্যবসায়ী বা অন্য কোনো ব্যক্তি যেন অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে ঋণের নামে ব্যাংকে গচ্ছিত জনসাধারণের আমানত লুট করে নিতে না পারে, সেরূপ বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে। ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনামলে যারা ব্যাংকের শত হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে কিংবা বিদেশে পাচার করেছে, তাদের সব সহায়সম্পদ, এমনকি ঘরবাড়ি-ভিটি পর্যন্ত বিক্রি করে ঋণের টাকা আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। বিদেশে পাচারকৃত টাকাও উদ্ধারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মাস্টারমাইন্ড সাবেক গভর্নর আতিউরের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় সব আইনি কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে [যুগান্তর-২৩, জানুয়ারি, ২০২৪]।
১৪. বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে চীনা মডেল অনুসরণে শতভাগ বাংলাদেশি কর্মচারী নিয়োগ এবং বিদেশি পার্টনার পুঁজি প্রত্যাহার করে চলে যাওয়ার পর দেশি পার্টনার একই ব্র্যান্ডে উৎপাদন কাজ চালিয়ে যেতে পারবে-এরূপ শর্তাবলী যুক্ত করতে হবে। ট্যাক্স হলিডে দিয়ে প্রদত্ত সুবিধা প্রত্যাহার করে নিতে হবে।
১৫. বিশ্বব্যাংক কর্তৃক বাংলাদেশকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হিসাবে ঘোষণা ত্রুটিযুক্ত। ফ্যাসিস্ট রেজিমে লুটপাট ছাড়া প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের কোনো ধনাত্মক উন্নয়ন হয়নি, হয়েছে ঋণাত্মক উন্নয়ন। সে বিবেচনায় বাংলাদেশ Least Developed Country (LDC) হিসাবে গণ্য এবং বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ LDC country-এর জন্য প্রযোজ্য সর্বনিম্ন সুদহারে বৈদেশিক ঋণ পেতে পারে। বিষয়টি রিভিউ করে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক টার্গেট Economic goal) পুনঃনির্ধারণের আবশ্যকতা রয়েছে।
১৬. পর্যটন প্রচুর সম্ভাবনাময় খাত। শুধু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে ইউরোপ স্ট্যান্ডার্ডে উন্নীত করা সম্ভব হলে, পর্যটন খাতে বাংলাদেশের আয় হাজার গুণ বৃদ্ধি পাবে।
উপর্যুক্ত সংস্কারমূলক কাজগুলো করা হলে বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য বৈদেশিক ঋণ সহায়তা গ্রহণের প্রয়োজন হবে না। বৈদেশিক ঋণ সহায়তার প্রয়োজন না হলে শুধু ভারত কেন, বিদেশি কোনো পরাশক্তিকে পরওয়া করার প্রয়োজন হবে না।
খ. সামরিক সক্ষমতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দেশমাতৃকার প্রতি ইঞ্চি ভূমি সুরক্ষায় সদা প্রস্তুত, সুদক্ষ বাহিনীরূপে গড়ে তুলতে হবে। প্রতিবেশী দেশগুলোর উসকানিমূলক বক্তব্যকে মাথায় রেখে আমাদের সামরিক বাহিনীকে প্রস্তুত রাখতে হবে।
এটিএম মোস্তফা কামাল : অর্থনীতিবিদ, অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম-সচিব