Logo
Logo
×

বাতায়ন

প্রবাদতুল্য সাংবাদিকদের কথা

Icon

আফসান চৌধুরী

প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রবাদতুল্য সাংবাদিকদের কথা

আফসান চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

সেদিন MRDI অফিসে মিডিয়া গবেষণাবিষয়ক এক মিটিং চলছিল। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ চলবে। সংস্থা প্রধান হাসিবুর রহমান মুকুর পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল আমাকে এই বলে যে, ‘আপনাদের অনেকের চেয়ে আফসান ভাইয়ের সাংবাদিকতায় সময় কেটেছে বেশিদিন।’ আসলেই, ৫১ বছর তো কম নয়, এখন যাওয়ার কাল, পেশা থেকে অবসর বানানোর কাল। কেউ কি আর এতদিন ধরে কোনো চাকরি করে? কিন্তু আমরা সাংবাদিকরা থামতে পারি না যেন। মানে থামে কী করে? কিছু না কিছু করতেই থাকে তারা। কেউ আর কিছু না হোক, পড়ায় বা প্রেস ক্লাবে আড্ডা দেয়। এক অদ্ভুত পেশা। বেতন পাক আর না পাক, নেশা হয়ে যায়। তবে আজকাল পেশার দিনকাল ভালো নয়, একটু মুমূর্ষু, অনেকেই পেশা ছাড়ছেন, মানুষের আস্থার ঘাটতিটা বোঝা যায়, ভালো ছেলেমেয়েরা বেশি আসতে চায় না। চাই আর না চাই, আমাদের অতীতটা আমাদের বর্তমানের চেয়ে বেশি উজ্জ্বল মনে হয় অনেকের কাছে। আর আছে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব। যাই হোক, সেসব অন্য কথা। আমি নিজেও গুটিয়ে নিচ্ছি। একেবারে না বললে লিখি না কোথাও, নিজেদের প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা ঢাকা কুরিয়ার ছাড়া। আজকাল লেখার আগে আপনজন খুঁজি। তবে হাঁটলাম অনেকদিন, কিছু মানুষের কথা বড় মনে পড়ে। তাদের দু-একজনের কথা।

প্রথম লেখা ও প্রথম বিপদ

১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ডাকসু নির্বাচন হয়, সেটা ঘিরেই ছিল আমার প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট। তবে আমার দাড়ি, চুল, গায়ের চাদর দেখে একপক্ষ আমাকে রাজনৈতিক কর্মী ভাবে। খুব ঝামেলা চলছিল চারদিকে, মারধর, বন্দুক দর্শন সবই ছিল, শেষে তাড়া খাই। এক বন্ধুর সাহায্যে রিকশায় পালাই ক্যাম্পাস থেকে; তবে লেখাটা জমা দেই। তবে সম্মানি পাইনি মনে আছে। এ লেখার জন্য টাকা না দেওয়াটা আমাদের গণমাধমের অন্যতম সবল ঐতিহ্য, আজও চলছে। কী আর করা!

প্রথম চাকরি ও ইংরেজি ম্যাগাজিন এন্ডেভারের আনোয়ারুল হক

আমার বন্ধু আনোয়ারুল হক অসম্ভব সক্রিয় ও কর্মঠ মানুষ ছিল। স্ট্যান্ড করা ভালো ছাত্র, সমাজকর্মী এবং সাংবাদিক ও ভীষণ উদ্যোগী আনোয়ার বাংলাদেশের প্রথম ইংরেজি নিউজ ম্যাগাজিন প্রকাশ করে। নাম ছিল ‘এন্ডেভার’। খুব খারাপ ছাপা, একেবারে ব্রাউন নিউজপ্রিন্ট কিন্তু লেখাগুলো ছিল অনেক ভালো। এত বছর পরও মনে পড়ে সেসবের উন্নত মান, উন্নত ইংরেজি। আনোয়ার বেতন দিত বা দেওয়ার চেষ্টা করত। প্রথম থেকেই প্রফেশনাল কিন্তু পারত না, তবু টাকা পেয়েছি। কয়েক বছর চালায়, কিন্তু একদিন পত্রিকাটা থেমে যায় টাকার অভাবে। পরে সে ইংরেজি সাংবাদিক হিসাবে অনেক নাম কুড়ায়। ২০০১ সালে ‘ডেইলি স্টার’ পত্রিকায় আমরা দুজনেই একসঙ্গে কাজ করেছি। পরে সে দিল্লিতে যায় ডিপ্লোম্যাটিক পোস্টিং নিয়ে। দারুণ রিপোর্টার, লেখক, আয়োজক। স্ট্রোক করে কর্মক্ষমতা হারায়, তবে আমাদের কালের একটি দক্ষ, যোগ্য নাম। ভালো থেকো অকাল প্রয়াত বন্ধু।

আতাউস সামাদ ভাই, বিবিসি : দুই না তিনজন মৃত?

আজকাল অনেকেই সংবাদমাধ্যমকে তেমন বিশ্বাস করে না। অতিরঞ্জন আর ফেক নিউজের জমানা এটা। ভুল তথ্য ধরার কাজ করে অনেকে সংসার চালান পর্যন্ত। কী আর করা। তবে এমন দিন সব সময় ছিল না।

বহু জায়গায় কাজ করেছি, যেমন অনেকে করে। তবে প্রতিষ্ঠানের চেয়ে মানুষগুলোকেই বেশি মনে পড়ে। যেমন, আমার রিপোর্টিং গুরু আতাউস সামাদ ভাই। ভীষণ খুঁতখুঁতে রিপোর্টার, কিন্তু কী অসাধারণ তার পেশাদারি সততা আর দক্ষতা!

আমরা ১৯৯৪-৯৬ সময়কালে বিবিসির জন্য কাজ করি। তিনি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে এবং আমি বাংলা সার্ভিসের হয়ে। ১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ প্রতিবাদ মিটিং ও সমাবেশের ডাক দেয়। বড় ধরনের সংঘর্ষ, মারধর, এমনকি গোলাগুলিও হয়। লাশ পড়েছিল রাস্তায়। এর মধ্যে দাঁড়িয়ে রেকর্ডিং করেছি। আশ্চর্যের বিষয়, কোনো ভয় লাগেনি, যা এত বছর পরে আমার বেশ অদ্ভুত মনে হয়। সময় একেই বলে।

আমি একজন যুবককে রাস্তার বোমায় পা হারাতে দেখি। বিস্ফারিত চোখ নিয়ে ফুটপাতে বসে থাকতে দেখলাম, হতবাক হয়ে জমে গিয়েছিল ছেলেটা। পলিটিক্সের কেউ না। শহরে এসেছে চাকরির খোঁজে। কী হচ্ছে কিছুই জানে না, একজন সাধারণ পাবলিক। আমি পুলিশকে বলি ওকে হাসপাতালে নিতে। পুলিশ অনুরোধ রেখেছিল।

আতাউস সামাদ ভাই আমাকে প্রায় ৩টার দিকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করলেন আমি রিপোর্টে কতজনকে ‘মৃত’ উল্লেখ করছি। আমি বলেছিলাম, দুটি নিশ্চিত এবং একটি সম্পর্কে নিশ্চিত নই, সেই ছেলেটার কথা। তিনি বলেন, হাসপাতালে বোমায় চৌচির পা’র সেই ছেলেটির সাক্ষাৎকার তিনি নিয়েছেন। ‘সে এখনো মারা যায়নি। আমাদের দুজনেরই একই মৃতের সংখ্যা থাকা দরকার। আমি দুই বলছি, তুমিও বলো।’

আমার রিপোর্টিং সময় সন্ধ্যা ৬.৩০টা। এর ঠিক ১০ মিনিট আগে সামাদ ভাই ফোন করে বললেন, ‘আফসান, তিনটা করো। ছেলেটি মারা গেছে।’ আজকাল কে এত যত্ন নেয়, কে দুই না তিন, এই একজন নিয়ে রিপোর্ট করার আগে ভাবে?

আমাদের রিপোর্টগুলো দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, পত্রিকা পর্যন্ত কাভার করেছিল। কিন্তু আমার সবচেয়ে বেশি মনে আছে সামাদ ভাইয়ের নির্ভুলতার প্রতি নিষ্ঠা। এটি সাধারণ ও অসাধারণের মধ্যে সব পার্থক্য তৈরি করেছিল। সালাম সামাদ ভাই।

মিন্টু ভাই, শাহাদাত ভাই, মোয়াজ্জেম ভাই, হারুন ভাই ...

পত্রিকা অফিসগুলো অনেক সময় শুধু গণমাধ্যম চর্চা করে না, আরও কিছুর প্রসার ঘটায়। সত্তরের দশকে যেমন ছিল শাহাদাত চৌধুরী ভাইয়ের ‘বিচিত্রা’, আশির দশকে যেমন ছিল হলিডে পত্রিকা। যারা লিখতেন, কাজ করতেন, তারা নিজেরাও এসে ওইসব অফিসের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করতেন। ‘বিচিত্রা’কে নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে, হলিডে কালচার কিছুটা কম চর্চিত। কিন্তু সেই মিন্টু ভাই-সম্পাদক এনায়েতুল্লাহ খান, সামাদ ভাই, মোয়াজ্জেম ভাই, এনএম হারুন ভাই, অচিন্ত্য দা বা আরও যারা ছিলেন, তারা এমন এক পরিবেশ তৈরি করেন, যা লেখায়, শেখায়, স্বপ্ন দেখায় ভালো কাজ করতে। এদের মধ্যে মোয়াজ্জেম ভাইয়ের কথা বলি, যিনি পরে ‘ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস’ পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেন, যার মজবুত ভিত্তি আজকের গণমাধ্যমে অসাধারণ অর্জন একটি। তিনি শুধু শ্রেষ্ঠ ইকোনোমিক রিপোর্টার ছিলেন না, সম্পাদক হিসাবে ছিলেন কিংবদন্তি। তার মৃত্যুর কয়েক মাস আগেও আমরা একটি সাপ্তাহিকের পরিকল্পনা করছিলাম। তিনি চলে গেলেন, হলো না পত্রিকা; কিন্তু রেখে গেলেন একটি পত্রিকা, একটি প্রতিষ্ঠান, একটি মডেল। আপনাকে সালাম।

শেষে ঘরে ফিরলাম

কত জায়গায় কাজ করলাম, শেষে ঘরে ফিরলাম। ১৯৮৪ সালে আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু এনায়েতুল্লাহ খান ‘ঢাকা কুরিয়ার’ পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করে। সেই কালে এটা ছিল একটি সাহসী পা ফেলা। হাসান ফেরদৌস ও আমি তার সঙ্গে যুক্ত হই। আমি ছিলাম দায়িত্বে। আমরা বহু ভালো রিপোর্ট করি, তবে আমি ১৯৮৬ সালে অন্য পেশায় চলে যাই, কিন্তু যোগাযোগ ছিল পুরোটাই। সেই বছর এনায়েত ইউএনবি প্রতিষ্ঠা করে। এতেও আমরা সবাই মিলে হাত লাগিয়েছি। অনেক নাম তাতে জড়িত। হাসান সাঈদ ভাই, রৌশন ভাই, এজেডএম হায়দার ভাই, ফরিদ ভাই, আরও অনেক নাম। আজ এটি দেশের প্রধান বেসরকারি নিউজ সরবরাহ সংস্থা। ‘ঢাকা কুরিয়ার’ যেমন ইংরেজি ম্যাগাজিনে অন্যতম শীর্ষে।

২০২১ সালে আমি আবার যোগ দেই এ দুই প্রতিষ্ঠানে উপদেষ্টা সম্পাদক হিসাবে। এতদিন পর হাজার দুনিয়া ঘুরে ফিরে এলাম নিজ গৃহে, এটাই হোক আমার শেষ ঠিকানা।

আমি মনে করি, মিডিয়ায় আমাদের মৌলিক পরিবর্তন হয়েছে, আমাদের সবাইকে অনেক পালটাতে হবে টিকতে হলে। পারব কী পারব না, জানি না; তবে চেষ্টা করতেই হবে। এইটুকু জানি, করব।

আফসান চৌধুরী : সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম