Logo
Logo
×

বাতায়ন

বাইফোকাল লেন্স

জেলা প্রশাসকের পদবি পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত হবে যুগোপযোগী

Icon

একেএম শামসুদ্দিন

প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জেলা প্রশাসকের পদবি পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত হবে যুগোপযোগী

১৪ জানুয়ারি জাতীয় পত্রিকাগুলোতে অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গঠিত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের নেওয়া বেশকিছু সিদ্ধান্তের তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে যে বিষয়টি অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, তা হলো, ডেপুটি কমিশনার বা ডিসিদের পদবি বদলে যাওয়াসংক্রান্ত খবরটি। কমিশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ‘জেলা প্রশাসকের (ডিসি) পদবি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট করার সুপারিশ করা হতে পারে। যদি তাই হয়, তাহলে বলব, কমিশনের জেলা প্রশাসকের পদবি পরিবর্তন করার সিদ্ধান্তটি হবে যুগোপযোগী। সরল ভাষায় আমরা যা বুঝি, তা হলো, বেতনভুক্ত সরকারি কোনো কর্মকর্তা জনগণের ঘাড়ের ওপর শাসক হয়ে বসতে পারেন না। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, সরকারের সব পর্যায়ের কর্মকর্তাই জনগণের সেবক; শাসক নন।

সরকারের প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জেলা ও উপজেলা প্রশাসনিক ইউনিট। কারণ, জেলা ও উপজেলায় কর্মরত সরকারি কর্মকর্তাদের জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে কাজ করতে হয়। জনগণের কল্যাণমুখী কাজ তাদের মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হয়। মাঠপর্যায়ের এসব কর্মকর্তা যথেষ্ট ক্ষমতার অধিকারী হয়ে থাকেন। এজন্য জেলার ডেপুটি কমিশনার বা ডিসি জেলার প্রশাসন, রাজস্ব, বিনোদন, উন্নয়ন, জেলখানা থেকে শুরু করে ৬২টি বিষয় দেখার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। এছাড়া ‘অন্যান্য’ ক্ষেত্রেও দায়িত্বপ্রাপ্ত বলতে একটি বিষয়ও এর মধ্যে রয়েছে। ফলে ওই জেলায় তাদের দায়িত্বের বাইরে কিছু নেই। ডিসি আইনশৃঙ্খলা কমিটিরও সভাপতি। একইসঙ্গে তিনি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। সুতরাং, তার দায়িত্বের বাইরে তেমন কিছু নেই। এটাই হলো ডিসিদের ক্ষমতার উৎস। অপরদিকে একেবারে মাঠপর্যায়ের আমলা, ইউএনওরা উপজেলায় একই ধরনের দায়িত্বে রয়েছেন, যা তার ক্ষমতার উৎস। উপজেলা চেয়ারম্যানদের আইন করে উপজেলায় ১৭ ধরনের সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান করা হলেও তাদের সে ক্ষমতা ইউএনওরা না দিয়ে কুক্ষিগত করে রেখেছেন বলে অভিযোগ। ইউএনওদের ৭২ ধরনের দায়িত্বের মধ্যে পাবলিক পরীক্ষাও রয়েছে। তারা উপজেলার প্রধান নির্বাহী। এগুলো তাদের ক্ষমতাবানও করেছে। ডিসি-ইউএনওরা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ক্ষমতাও রাখেন। ইউএনও একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটও।

প্রশাসন ক্যাডারের পদ ও পদবির নামের বিষয়টিও কর্মকর্তাদের মন ও মানসিকতার ওপর প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে জেলা পর্যায়ের প্রশাসনিক পদ, আমরা বাংলায় যাকে ‘জেলা প্রশাসক’ বলে থাকি, তার শাব্দিক অর্থ কী দাঁড়ায় ‘জেলা প্রশাসক’ শব্দটির এই অর্থ কী দাঁড়ায় না-যিনি এ পদে কাজ করেন, তিনি সেই জেলার প্রশাসক অর্থাৎ তিনি সেই জেলার শাসনকর্তা। আগে এ পদটিকে বলা হতো ‘ডেপুটি কালেক্টর বা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট’। আর এ ‘ডেপুটি কালেক্টর’ বা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট পদের অধিকারকে ‘ডেপুটি কমিশনার’ পদের দায়িত্বও প্রদান করা হয়েছে। এ ডেপুটি কালেক্টর বা ম্যাজিস্ট্রেটকে বাংলা করতে গিয়ে করা হয়েছে ‘জেলা প্রশাসক’। এ ‘প্রশাসক’ শব্দটির ভেতর কেমন ‘শাসক’-এর গন্ধ পাওয়া যায়! এসব আমলা জেলার প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড চালাতে গিয়ে এমন কিছু অগ্রহণযোগ্য আচরণ করেন, যা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এ প্রসঙ্গে উচ্চ আদালতের একটি মন্তব্যের কথা মনে পড়ে গেল। ২০১৯ সালে ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান হত্যাকাণ্ড মামলার এক শুনানি চলাকালে তৎকালীন হাইকোর্ট বেঞ্চ বলেছিলেন, ‘কিছু কিছু ওসি, ডিসি আছেন, যারা নিজেদের জমিদার মনে করেন। এমন ভাব দেখান, তারাই সব।’ জেলা প্রশাসককে আমরা সাধারণত ডিসি বলি। এখন বুঝতে হবে ডিসি মানে কী ডিসি মানে হলো ডেপুটি কমিশনার। এখন প্রশ্ন আসবে, উনি কার ডেপুটি আমরা সাধারণত যাকে বিভাগীয় কমিশনার বলি, ডেপুটি কমিশনার হলেন তারই ডেপুটি, যার বাংলা করতে গিয়ে ‘জেলা প্রশাসক’ করা হয়েছে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকেই বেসামরিক প্রশাসনে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এ অস্থিরতা কিছুটা স্বভাবগত, আবার অনেকটা ইচ্ছাকৃত। শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের সময় পদ ও পদোন্নতি বঞ্চিতদের দাবি-দাওয়া শেষ হতে না হতেই জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে প্রশাসন ও অন্য ক্যাডার কর্মকর্তারা যেভাবে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটিয়েছেন, পৃথিবীর আর কোনো দেশে এমন ঘটনার দ্বিতীয় কোনো উদাহরণ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব আমলা এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করার সাহস পান কোথা থেকে। আসলে গত ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকার বেসামরিক আমলাদের যেভাবে আশকারা দিয়েছে, তাতে তাদের স্বভাবগত আচরণের পরিবর্তন ঘটেছে। দলীয় স্বার্থে আমলাদের যথেচ্ছ ব্যবহারই মূলত এ পরিবর্তনের কারণ। আমলাদের আবার শ্রেণিভেদও আছে। এ শ্রেণিভেদে প্রশাসনিক আমলারাই সবার চেয়ে এগিয়ে। ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় প্রশাসন ক্যাডারের আমলাদের অভিজাত শ্রেণি বলা যায়। তাদের যে সীমাহীন ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ন্ত্রণের উপযুক্ত কাঠামো তৈরি হয়নি। উপরন্তু, শেখ হাসিনা সরকার অভিযুক্ত সরকারি কর্মকর্তাদের বিচার করার ক্ষেত্রে নানাবিধ সীমাবদ্ধতা তৈরি করে রেখেছিল; এমনকি আদালতের হাতও বেঁধে দেওয়া হয়েছে। সিআরপিসি ১৯৭ ধারা অনুযায়ী, কোনো সরকারি কর্মকর্তা সরকারি দায়িত্ব পালনকালে অভিযুক্ত হলে সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোনো আদালত সেই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আমলে নিতে পারেন না। শুধু তাই নয়, কোন আদালতে কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আনা মামলার বিচার হবে, তা-ও সরকার নির্ধারণ করে দেয়। এমন বিধিব্যবস্থার কারণে আমলাদের মানসিকতারও পরিবর্তন হয়েছে। তারা মনে করেন, সরকার তাদের ওপর নির্ভরশীল; কার্যত তারাই সরকার চালায়। পক্ষান্তরে, তাদের এ মানসিকতা সরকারের প্রশাসনিক কাঠামোর ভেতরে সংকট তৈরি করছে।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগেই আমলাতন্ত্রনির্ভরতা বেড়েছে। এ কারণেই বলা যায়, বর্তমানে দেশে যে বিধিব্যবস্থা চালু আছে, তাতে জনগণের সার্বভৌমত্ব পুরোপুরি নিশ্চিত করে না। বাংলাদেশের এমন শাসনব্যবস্থাই ডিসি এবং ইউএনওসহ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের নিজেদের ‘প্রভু’ এবং জনগণকে ‘প্রজা’ মনে করার সুযোগ করে দিয়েছে। এ দেশের মানুষ প্রজা নয়, নাগরিক। এ নাগরিকদের ট্যাক্সের পয়সায় তাদের সংসার চলে। সন্তানদের শিক্ষালাভের সুযোগ হয়। জনগণের টাকায়ই তাদের বিলাসবহুল জীবন চলে। কিন্তু এসব আমলা সাধারণ মানুষের সঙ্গে এমন আচরণ করেন, তাদের আচরণ দেখে মনে হয়, জনগণই তাদের প্রজা এবং তারা জনগণের শাসক। তাতে জনগণের সঙ্গে আমলাদের দূরত্বই বাড়ে। একটা কথা মনে রাখতে হবে, গণতান্ত্রিক দুর্বলতা ও জনবিচ্ছিন্নতা বাড়লে একচেটিয়া ব্যবস্থা কায়েম হয়। আর একচেটিয়া ব্যবস্থা যখন চালু হয়, তখন ক্ষমতার অপপ্রয়োগও হয় বেশি। ফলে, প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গঠিত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সংস্কারসংক্রান্ত যেসব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, তা বেশ আশাব্যঞ্জক। তবে, এতদসত্ত্বেও দেশের নাগরিক হিসাবে আমরা আশা করি, ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম, দুর্নীতি এবং আচরণবিধি লঙ্ঘন করে প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, যা রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর; সরকারের কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ ছাড়াই এমন অভিযোগে অভিযুক্ত আমলাদের প্রকাশ্য বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধিমালাও অন্তর্ভুক্ত হবে। আমলাতন্ত্রের ওপর প্রখ্যাত লেখক ম্যাক্স ওয়েবারের একটি উক্তির উল্লেখ করে লেখাটি শেষ করতে চাই। তার দৃষ্টিতে ‘আমলা হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি নির্দিষ্ট নিয়মকানুন ও নীতির অধীনে নিরপেক্ষতার সঙ্গে কাজ করেন। আমলারা কখনো ব্যক্তিগতভাবে আবেগতাড়িত হন না। তার নিজস্ব কোনো পছন্দ-অপছন্দ থাকে না, তিনি নিয়মের কাছে বাধ্যগত।’

একেএম শামসুদ্দিন : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম