Logo
Logo
×

বাতায়ন

প্রয়োজন ঐক্য, বিভাজন নয়

Icon

ড. আলী রেজা

প্রকাশ: ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রয়োজন ঐক্য, বিভাজন নয়

ফাইল ছবি

বর্তমান সরকার জাতীয় ঐক্যের কথা বললেও নির্বাচনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ছাত্রসমাজ, রাজনৈতিক দল ও সরকারের মধ্যে এক ধরনের বিভাজনের লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সরকারিভাবে জুলাই আন্দোলনের ঘোষণাপত্র জারি করার কথা বলে সরকার ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা থেকে সমন্বয়কদের বিরত রেখেছে। ছাত্রদের দ্বারা গঠিত সরকারের সঙ্গে ছাত্রদেরই যদি দূরত্ব সৃষ্টি হয়, তাহলে সরকার নিজেদের অবস্থানে নিজেরা দুর্বল হয়ে পড়বে। এক্ষেত্রেও ঐক্যের বদলে বিভাজন সৃষ্টির পথ তৈরি হবে। কিছুদিন আগে ভারতীয় আধিপত্য ও বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সরকার জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানালে সেখানে বেশ সাড়া পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু ছাত্র-সমন্বয়কদের জুলাই ঘোষণাপত্র ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমত সৃষ্টি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সে পরিস্থিতি দৃশ্যত বদলে যাচ্ছে। সরকার গঠনের পাঁচ মাস পর জুলাই আন্দোলনের ঘোষণাপত্র কতটা জনসমর্থন পাবে-সে ব্যাপারেও অনেকে সন্দিহান।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সংবিধান সমুন্নত রেখেই রাষ্ট্র পরিচালনা করে যাচ্ছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। সংস্কারের মাধ্যমে সরকার একটি জনবান্ধব ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে একটি জাতীয় নির্বাচনের একটি সময়সীমা নির্ধারণ করেছে সরকার। এ সময়সীমা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানা প্রতিক্রিয়া থাকলেও একটি নির্বাচনি ফ্লেভার নিয়ে তারা গণসংযোগে নামতে শুরু করেছে। এ বাস্তবতায় জুলাই আন্দোলনের ঘোষণাপত্র নির্বাচনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে-এ আশঙ্কা থেকে ঘোষণাপত্রের প্রাসঙ্গিকতা, প্রয়োজনীয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হতে দেখা যাচ্ছে। তারা মনে করছেন, সরকার গঠনের পাঁচ মাস পর এ ধরনের ঘোষণাপত্রের কোনো প্রয়োজন নেই। যতদূর জানা গেছে, জুলাই আন্দোলনের ঘোষণাপত্র জারির মাধ্যমে ছাত্র সমন্বয়করা বাহাত্তরের সংবিধানকে চ্যালেঞ্জ করতে চান। কিন্তু এ বিষয়ে ছাত্র সমন্বয়করা সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন পাবেন বলে মনে হয় না। একাত্তরের সঙ্গে চব্বিশের তুলনা হতেই পারে না। একাত্তরের বিজয় একটি স্বাধীন রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছিল। আর চব্বিশের বিজয়ে একটি সরকারের পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সাম্য, ন্যায়নীতি ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য বাহাত্তরের সংবিধান বাতিলের কোনো প্রয়োজন নেই। বিদ্যমান সংবিধানকে সমুন্নত রেখেই সাম্য, ন্যায়নীতি ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। সংবিধানের সংশোধনীগুলো বাতিল করে আওয়ামী লীগ বাহাত্তরে প্রণীত মূল সংবিধানে ফিরে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। আওয়ামী লীগের সে প্রচেষ্টার প্রতিবাদ বা কাউন্টার হিসাবে সমন্বয়করা যদি বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল করতে চান, সেটিও বর্তমান বাস্তবতায় সম্ভব নয় বলে মনে করে অভিজ্ঞমহল।

বর্তমান সরকার এ সংবিধানের অধীনেই রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য শপথগ্রহণ করেছে। এখন জুলাই আন্দোলনের ঘোষণাপত্র জারি করে সেই মোতাবেক রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হলে সাংবিধানিক সংকট দেখা দেবে এবং সরকারের বৈধতা বিষয়েও প্রশ্ন দেখা দেবে। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াত শুরু থেকেই এ সরকারকে সমর্থন জানিয়ে আসছে। এ কারণে সরকারের একটি গণভিত্তি তৈরি হয়েছে। এ গণভিত্তি টেকসই রাখার জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো বিকল্প নেই। সে বাস্তবতা থেকেই সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে নির্বাচনের পথে অগ্রসর হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। দেশের সর্বস্তরের মানুষ ও রাজনৈতিক দলগুলোও নির্বাচনের দিকেই তাকিয়ে আছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বারবার জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। জাতীয় সংকট কেটে গেলে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা সহজে সম্ভব হয় না। জাতীয় সংকট কেটে গেলে সব পক্ষই তখন নিজ নিজ সংকট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ৫ আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই যদি জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি জাতীয় সরকার গঠন করা হতো, তখন সর্বস্তরের মানুষ সে সরকারকে গ্রহণ করতে দ্বিধাবোধ করত না। তখন জুলাই আন্দোলনের যে কোনো ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন করাও সহজ হতো। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কোনো জাতীয় সরকার নয়। এ সরকার নির্দলীয় নিরপেক্ষ হিসাবে গঠিত হয়েছে। তবে জনমনে এ সরকারের বিরুদ্ধে বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর প্রতি আনুকূল্য দেখানোর অভিযোগও আছে। যতই দিন যাচ্ছে, এ অভিযোগ তত বেশি প্রকাশ পাচ্ছে। তাই এখন সরকারের পক্ষেও জুলাই আন্দোলনের ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে।

সমন্বয়কদের কিছু কিছু কথা ও কাজে রাজনৈতিক দলগুলো একমত পোষণ করতে পারছে না। জুলাই আন্দোলনের পর অনেক ছাত্র সমন্বয়ক ক্লাসে ফিরে গেছেন। অনেক সমন্বয়কের বিরুদ্ধে অনৈতিক কাজের অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশ হতে দেখা গেছে। ফলে সমন্বয়করা এখন আর সর্বস্তরের মানুষের জনসমর্থন পাচ্ছেন না। কিন্তু তারা এখনো নিজেদেরকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে মনে করছেন।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকার উৎখাতের আন্দোলনে সমন্বয়কদের একক কৃতিত্ব স্বীকার করছে না রাজনৈতিক দলগুলো। প্রকৃতপক্ষে ছাত্রদের একক আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে-একথা সর্বাংশে সত্য বলে দাবি করা যায় না। ছাত্ররা একটি বড় শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হলেও শেষ পর্যায়ে আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল সব রাজনৈতিক দল ও সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ। ফলে ছাত্র আন্দোলন গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। দীর্ঘদিন সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলন-সংগ্রাম করে এ গণ-অভ্যুত্থানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল। চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে ছাত্ররা প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানেও ছাত্রসমাজের ১১ দফা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনে ছাত্রসমাজের বিরাট ভূমিকা ছিল। তাই বলে আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে ছাত্রসমাজ রাজনৈতিক দলের ভূমিকাকে ছোট করে দেখেনি। কিন্তু এবার ছাত্র সমন্বয়কদের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাকে গৌণ করে দেখার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ছাত্রসমাজের দূরত্ব বাড়ছে।

এ বাস্তবতায় জাতীয় ঐক্যের বদলে রাজনৈতিক বিভাজনের দিকেই কি এগিয়ে যাচ্ছে দেশ? সংস্কার ইস্যুতেও সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সমন্বয়কদের দূরত্ব বাড়ছে বলে মনে হয়। অন্যদিকে একটি গোষ্ঠী দাবি তুলছে, ফ্যাসিস্টদের বিচারের আগে কোনো নির্বাচন নয়। এক্ষেত্রে বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন-এ তিনটি বিষয় সরকারকে তিনদিক থেকে চাপে ফেলতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোর মতে, বিচার ও সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। বিচার ও সংস্কার চলমান রেখেই নির্বাচন করা সম্ভব এবং সরকারকে সেদিকেই মনোযোগ দেওয়া উচিত। কিন্তু ছাত্র সমন্বয়করা রাজনৈতিক দলগুলোর এ মনোভাবকে খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তারা মনে করছেন, ৫৩ বছরে রাজনৈতিক দলগুলো ব্যর্থ হয়েছে। ভবিষ্যতেও সংস্কার ও বিচারের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো ব্যর্থ হবে। ছাত্র সমন্বয়কদের এ মনোভাব রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন।

ছাত্রসমাজ ও রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে বিভেদ সৃষ্টি হলে তা সরকারের জন্যও একটি অস্বস্তির বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। এ বাস্তবতায় সরকারকে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। পরস্পরবিরুদ্ধ দুটি দাবি একসঙ্গে পূরণ করা সম্ভব নয়। ফলে বাস্তবতার নিরিখে করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। সমস্যা যতই জটিল হোক, আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের একটি পথ বের করা অসম্ভব নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে সব পক্ষকে নিয়ে একসঙ্গে বসার কোনো বিকল্প নেই। অন্তর্বর্তী সরকার এমন কোনো সুবিধাজনক অবস্থানে নেই যে, চাপিয়ে দেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত সব পক্ষকে মানতে বাধ্য করতে পারবে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন তাদের সময় বাড়িয়ে নিয়েছে। অন্যদিকে নির্বাচনের আগেই বিচারকার্য সম্পন্ন করার দাবি জোরালো হচ্ছে। সরকার নির্বাচনের একটি রূপরেখা প্রকাশ করলেও সংস্কার ও দ্রুত বিচারের দাবি পূরণ করতে হলে সে রূপরেখা অনুযায়ী চলা কঠিন হয়ে যাবে। আবার নির্বাচন পেছানোর কোনো যুক্তিই মানবে না রাজনৈতিক দলগুলো। দেশ কি তাহলে একটি রাজনৈতিক সংকটের দিকে এগিয়ে যাবে? জাতীয় ঐক্যের বদলে কি বিভাজনই জোরালো হয়ে উঠবে? তেমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হোক-সেটি কেউ চায় না। জুলাই আন্দোলনের পর দেশের সর্বস্তরের মানুষ একটি সাম্য, ন্যায়নীতি ও মানবিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছে। সরকার সব পক্ষকে নিয়ে সেই স্বপ্ন পূরণের দিকে এগিয়ে যাক-এটাই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা।

ড. আলী রেজা : সহকারী অধ্যাপক, শহিদ জিয়া মহিলা কলেজ, ভূঞাপুর, টাঙ্গাইল

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম