মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দরকার কার্যকর পদক্ষেপ
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
প্রকাশ: ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছাত্র-জনতার গৌরবদীপ্ত জুলাই ২০২৪ গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী সময়ে কিছুকাল দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ দৃশ্যমান ছিল। কিন্তু স্বল্পসময়ের ব্যবধানে দেশের বাজারে আলু, ভোজ্যতেল, চিনি, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার পণ্যের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণের পাশাপাশি কিছু পণ্যের শুল্ক-কর কমিয়েছে। আমদানির অনুমতিও দেওয়া হয়েছে কিছু পণ্যের। তাছাড়া টিসিবির পণ্য বিক্রি বাড়ানো, বাজার তদারকি সংস্থাগুলোর অভিযান বৃদ্ধি, সরবরাহ নিশ্চিতে সহযোগিতা এবং জেলায় জেলায় টাস্কফোর্স গঠনসহ বিভিন্ন ইতিবাচক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এতৎসত্ত্বেও নিত্যপণ্যের বাজারব্যবস্থায় সিন্ডিকেটের কারসাজিসহ বিভিন্ন অদৃশ্য কারণে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করা যাচ্ছে না। এটি অনস্বীকার্য যে, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়লে দেশের বাজারেও এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু দেশে পণ্যের বাজারে কোনো ঘাটতি না থাকা সত্ত্বেও দাম বাড়ার যৌক্তিকতা কতটুকু, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে।
বস্তুত মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন-আয়ের মানুষের জীবনযাপন নাজুক অবস্থায় নিপতিত। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় দেখা যায়, মূল্যবৃদ্ধির জন্য পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করছেন। সুখের বিষয় হচ্ছে, গত ডিসেম্বরে দেশে মূল্যস্ফীতি কিছুটা হলেও কমেছে। বাজারে শীতের শাকসবজির দাম সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। ৬ জানুয়ারি গণমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, ডিসেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৯২ শতাংশ এবং সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে হয়েছে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। কিন্তু মূল্যস্ফীতির এ দুই হার এখনো দুই অঙ্কের ঘরে থাকার মানে হলো নির্দিষ্ট আয়ের মানুষকে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিদায়ি বছরের পুরো সময় দেশের মানুষ উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে প্রচণ্ড চাপে ছিল। শহরের চেয়ে বেশি ভুগেছে গ্রামের মানুষ। ডিসেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি শহর অঞ্চলের তুলনায় বেশি ছিল গ্রামীণ এলাকায়।
অতিসম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ফল, জুস, বেভারেজ, তামাকপণ্য, রেস্তোরাঁসহ ৯০টিরও বেশি পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে নির্দেশনা জারি করেছে। নির্দেশনা অনুযায়ী, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক গন্তব্যের বিমান ভাড়া অনেকটা বাড়ানো হয়েছে। পটেটো ফ্লেকস, বিস্কুট, আচার, চাটনি, বিভিন্ন ধরনের পেস্ট, এলপিজি, পাইকারিভাবে আমদানি করা পেট্রোলিয়াম বিটুমিন, ফেরো-ম্যাঙ্গানিজ, ফেরো-সিলিকো-ম্যাঙ্গানিজ অ্যালয়, ফেরো-সিলিকন অ্যালয়, এইচআর কয়েল থেকে সিআর শিট, বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, চশমার প্লাস্টিক ফ্রেম এবং ইনডেন্টিং ব্যবসার ভ্যাটের হার আগের ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। কিচেন-হ্যান্ড টাওয়েল, নন-এসি হোটেল এবং স্থানীয় ব্র্যান্ডের পোশাক পণ্যে ভ্যাট আগের ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ এবং কিছু কিছু পণ্য ও সেবার ভ্যাট হার ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। মোবাইল টকটাইম ও ইন্টারনেট, আমদানি করা ফল, ফলের জুস, পেইন্ট ও বার্নিশ, চামড়া ও জুতার কাঁচামাল, ডিটারজেন্ট এবং নন-কার্বোনেটেড কৃত্রিম স্বাদযুক্ত পানীয়সহ ৪১টি পণ্য ও পরিষেবার জন্য সম্পূরক শুল্ক ৫০ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি করা হয়েছে। কার্বোনেটেড, নন-কার্বোনেটেড পানীয়ের ওপর নতুন করে ৩০ ও ১৫ শতাংশ হারে এবং ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী বা আইএসপির ওপর ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। তাছাড়া ওষুধ, এলপিজি ও স্থানীয় ব্যবসায় ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এমন একটি সময়ে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যখন মূল্যস্ফীতি নিয়ে দেশের জনগণ ইতোমধ্যেই চাপে রয়েছে। এখন শুল্ক ও কর বাড়ানোর ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বৃদ্ধি পাবে। কর ও শুল্ক বৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষের অবস্থা আগের চেয়েও কঠিন হবে; বিশেষ করে স্বল্প-আয়ের মানুষের জন্য তা অতিরিক্ত বোঝা হিসাবে দাঁড়াতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে কার্যকর গবেষণা ও বিশ্লেষণ ছাড়া ভ্যাট হার বৃদ্ধির সুফল অর্থনীতিতে নাও আসতে পারে। বরং এর ফলে অর্থনীতিতে তৈরি হতে পারে ঝুঁকি। এরই মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংস্থা ও ব্যবসায়ী সংগঠন থেকে মূল্যস্ফীতি-দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সৃষ্ট জনদুর্ভোগ কমাতে ভ্যাট-সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছে। ব্যবসায়ীদের দাবি-যেসব পণ্য-সেবায় ভ্যাট, সম্পূরক ও আবগারি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে, এর মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থাকায় স্বাভাবিকভাবেই মানুষের ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। একই সঙ্গে ক্রয়-বিক্রয়েও পড়বে এর প্রভাব। ফলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
প্রসঙ্গত, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর চট্টগ্রাম বিভাগের নেতারা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছেন, সীমিত ও প্রান্তিক আয়ের মানুষ এমনিতেই নিত্যপণ্যের ক্রমাগত দাম বৃদ্ধি নিয়ে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি, সেখানে এই ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির কারণে অসাধু ব্যবসায়ীরা আরেক দফা তাদের পণ্য ও সেবার মূল্য বাড়িয়ে জনজীবনে নতুন করে অস্থিরতা তৈরি করবে। আগামী মার্চে রমজান উপলক্ষ্যে এখন থেকেই নিত্যপণ্যের দাম, বিশেষ করে তেল, ডাল, চিনি, ছোলা, মাছ, মাংস, মসলাসহ অনেক পণ্যেরই দাম বাড়ানো ও মজুত করা শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা। শীতের ভরা মৌসুমে শীতকালীন সবজির দাম কিছুটা কম থাকলেও ক্রমাগতভাবেই বাড়ছে চালের দাম। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের নানাবিধ উদ্যোগ চলমান সত্ত্বেও এর সুফল জনগণ পাচ্ছে না। সরকার ইতঃপূর্বে ২৯টি পণ্যের ভ্যাট ও আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করলেও ভোক্তা পর্যায়ে এর কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। সরকারের উচিত রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য বিদ্যমান ভ্যাট নেটের আওতা বাড়ানো, সহজীকরণ করা, কর ফাঁকি বন্ধ করা, এনবিআরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। অর্থনীতিবিদদের অনেকেই ভ্যাট ও কর বৃদ্ধির যত যৌক্তিক কারণই থাকুক না কেন, এ বিষয়ে বিকল্প কিছু ভাবার পরামর্শ দিয়েছেন। তাদের মতে, রোজার বাকি আর মাত্র দেড় মাস। ফলে এ চাপ রমজানের বাজারে পড়তে পারে।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট বাড়ানো হলেও সেটি সামগ্রিক মূল্যস্ফীতিকে তেমন প্রভাবিত করবে না। এতে পণ্যের দামও বাড়বে না বা সাধারণ মানুষের জীবনযাপনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। গত ২ জানুয়ারি সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির মূল ওয়েটের ইন্ডিকেটরগুলো হলো চাল, ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। অত্যাবশ্যকীয় জিনিসের শুল্ক জিরো করে দিয়েছি। আমরা যেসব জিনিসপত্রের দাম বাড়াচ্ছি, এগুলো আমাদের মূল্যস্ফীতি বাড়ানোর ক্ষেত্রে খুবই কম গুরুত্বপূর্ণ।’ সাধারণ মানুষের কষ্ট হবে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ‘জনগণের স্বস্তি না পাওয়ার তো কোনো কথা না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইটি খাতে আমরা বরাদ্দ কমাব না, বরং বৃদ্ধি করব। কিন্তু আমাদের রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। ধার করে বেশিদিন চলা যায় না। আর আমাদের রাজস্ব গ্যাপ এত বেশি, আমি তো বড় করে ডেফিসিট ফাইন্যান্সিং করে এগোতে পারব না।’
সার্বিক পর্যালোচনায় এটি স্পষ্ট যে, দেশে কতিপয় অসাধু-অনৈতিক ব্যবসায়ীর লোভ এখনো নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। দ্রুততম সময়ের মধ্যে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করা প্রয়োজন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ বিভিন্ন কারণে দিনমজুর, শ্রমিক বা নিম্ন-আয়ের কর্মজীবীরা দৈনন্দিন জীবনযাপনে অপরিমেয় সংকটে ভুগছে। পোশাকশিল্পসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অরাজকতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্রের বিষয়টিও বহুল আলোচিত। ক্ষেত্রবিশেষে অশুভ শক্তির তৎপরতা সম্পর্কেও জনশ্রুতি রয়েছে। সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাসহ দেশপ্রেমিক জনগণের সম্মিলিত চেষ্টায় এসব কর্মকাণ্ড নির্মূল করা না গেলে সংকট আরও বাড়বে। অসাধু ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। অন্যথায় দেশবাসীর হতাশা অধিকতর অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরিতে সহায়ক হবে।
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী