শুদ্ধিকরণ ছাড়া কোনোভাবেই পুলিশ বাহিনীকে জনগণের পুলিশে রূপান্তর করা সম্ভব নয়। একেবারেই নয়। এবার এক বিশাল সুযোগ এসেছে পুলিশ বাহিনীকে ‘জনগণের পুলিশে’ রূপান্তর করার। এ মুহূর্তে সম্পূর্ণ ছাঁটাইয়ের মাধ্যমে নতুন পুলিশ বাহিনী গঠন বাস্তবসম্মত নয় বিধায় অভ্যন্তরীণ সংস্কার প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই শুদ্ধিকরণ এগিয়ে নিতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে, যাদের হাতে জনগণের রক্ত লেগে আছে, যারা গুম, ছিনতাই, রাহাজানি ও কালোটাকা অর্জনের সঙ্গে জড়িত, তাদের কোনোভাবেই পুনর্গঠিত পুলিশ বাহিনীতে রাখা যাবে না! তাহলে শুদ্ধিকরণের উদ্দেশ্যই হবে ব্যর্থ। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে জনগণের পুলিশ বাহিনীতে রূপান্তরিতকরণে কালক্ষেপণ না করে শুদ্ধিকরণে নিম্নবর্ণিত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
১. আট পুলিশ পুনর্গঠন কমিটি গঠন (প্রতি বিভাগে দুটি)। বিশেষ প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে চার সদস্য বিশিষ্ট-পুলিশে কর্মরত একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, মনস্তাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞ ও একজন ছাত্র প্রতিনিধি (নতুন প্রজন্মের সমাজবিজ্ঞান, মনস্তাত্ত্বিক বিজ্ঞানে অধ্যয়নরত) সমন্বয়ে গঠিত হবে। ২. পরিকল্পনা অনুযায়ী কমিটিগুলো দেশের সব থানা (নির্দিষ্ট কমিটি নির্দিষ্ট জেলার থানাগুলো) পরিদর্শন করে প্রত্যেক পুলিশ সদস্যের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করবেন। এখানে উল্লেখ্য, আলোচনা পর্ব শুরুর আগেই এক ‘তথ্যপত্র’ সব থানার পুলিশ/কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হবে। তথ্যপত্রে মূলত তিনটি বিষয় উল্লিখিত থাকবে: ক) জুলাই বিপ্লবকালে তার অবস্থান ও কর্ম সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা; খ) নামে বা বেনামে সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের বিশদ বিবরণ; গ) পুলিশে মুক্তিযোদ্ধা পোষ্য হিসাবে যোগদান তথ্য।
পুলিশের সব সদস্য নিজ স্বাক্ষরিত তথ্যপত্র ইলেকট্রনিক মাধ্যমে নির্ধারিত কমিটির সুরক্ষিত ডাটা-ব্যাংক বরাবর প্রেরণ করবেন। (এখানে উল্লেখ্য, মিথ্যা তথ্য থাকলে তা চাকরিচ্যুতি, জরিমানা ও সম্পদ বাজেয়াপ্তের কারণ হতে পারে)! কমিটি তথ্যপত্রের প্রাথমিক অনুসন্ধানের দায়িত্বে থাকবেন!
দ্বিতীয় পদক্ষেপ : নির্দিষ্ট কমিটি নির্দিষ্ট থানাগুলো পরিদর্শন করে বাহিনীর প্রত্যেকের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করবে!
তৃতীয় পদক্ষেপ : তথ্যপত্র ও আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবেন পুলিশ সদস্য/কর্মকর্তা পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত থাকার প্রাথমিক যোগ্যতা রাখেন কিনা?
থানা পরিদর্শন শেষে কমিটি সামগ্রিক রিপোর্ট দেবেন। যেখানে উল্লিখিত তিন ক্ষেত্র (ক, খ, গ) বিশ্লেষণ সাপেক্ষে কমিটি অগ্রহণযোগ্য কর্মকাণ্ডে জড়িত কর্মকর্তা ও সদস্যদের পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানোর তালিকায় সন্নিবেশিত করবেন এবং যথাযথ প্রক্রিয়ায় আইনগতভাবে বিচার (পুলিশ বাহিনী থেকে বহিষ্কার) করার পদক্ষেপ নেওয়ার সত্যায়ন করবেন! এ পুরো প্রক্রিয়া দ্রুত ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে হতে হবে, যেখানে প্রত্যেক পুলিশ/কর্মকর্তার অগ্রহণযোগ্যতার কারণগুলো লিপিবদ্ধ থাকবে। পুলিশ প্রশাসন উক্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে পুলিশ সদর দপ্তরে সন্নিবেশিত পুলিশ/কর্মকর্তার বিচার (সর্বোচ্চ দুই মাসের মধ্যে) শেষ করার পদক্ষেপ নেবে।
এ প্রক্রিয়া স্পর্শকাতর বিধায় এর গোপনীয়তা নিশ্চিতে কমিটির দায়বদ্ধতা রয়েছে। তথ্যপত্র সংগ্রহ হতে বিচার অবধি শুধু নির্দিষ্ট কমিটির সদস্য ও নির্ধারিত কর্মকর্তাই ডাটা ব্যাংকে প্রবেশ করতে পারবেন। এ কার্যক্রমে স্বচ্ছতা প্রতিস্থাপনের নিমিত্তে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো তারা অনলাইন নোটিফিকেশনের মাধ্যমে অবহিত হবেন।
পুলিশ বাহিনীর তথ্যানুসারে, বিগত সরকারের আমলে প্রায় এক লাখ (পুলিশের প্রায় ৫০ শতাংশ) ‘দলকানা’ সদস্য নিয়োগ হয়েছে, যা জনকল্যাণমূলক পুলিশ বাহিনী পুনর্গঠনে বিশাল বাধা। উপরন্তু অনেকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ দিয়ে বা পোষ্য হিসাবে ভর্তি হয়েছেন। তাই তথ্যপত্রের গ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী: ১. গত ১৬ বছরে বা আগে কারা মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযোদ্ধার পোষ্য পরিচয়ে পুলিশে যোগদান করেছেন, তার অনুসন্ধান। ২. যারা ভুয়া সনদ ব্যবহার করে পুলিশে যোগ দিয়েছেন, তাদের অবিলম্বে চাকরি থেকে বহিষ্কার। এক্ষেত্রে নির্বাহী আদেশই যথেষ্ট।
এছাড়া বর্তমানে পুলিশ সদস্য/কর্মকর্তার ঘাটতি পূরণে যে পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, তা হলো : ১. বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ক্যাডেটদের যোগদানে উৎসাহিত করা যেতে পারে (যাদের ইতোমধ্যে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ রয়েছে)। আনুমানিক প্রায় ৫০ হাজার ক্যাডেট প্রাথমিক বিবেচনায় যোগ্য হতে পারে; ২. জুলাই বিপ্লবে আগ্রহী আহতদের (প্রাথমিক যোগ্যতাসম্পন্ন) বিশেষ ব্যবস্থাপনায় নিয়োগ করা যেতে পারে; ৩. সম্পূর্ণ যোগ্যতার ভিত্তিতে বৈষম্যহীনভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া অতি দ্রুত সম্পন্ন করা।
নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর বিশেষ ব্যবস্থাপনায় স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে (যেমন স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণ। পরবর্তীতে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা) তাদের নিয়োগ দিয়ে জনবলের ঘাটতি মোকাবিলা করা যেতে পারে।
পুলিশ বাহিনীর প্রাথমিক শুদ্ধিকরণ ও নতুন প্রজন্মের অংশীদের যোগদানের মাধ্যমে নতুন ধারার পুলিশ বাহিনী গঠন সম্ভব, যে বাহিনী হবে জনকল্যাণমূলক ও জনবান্ধব। যদিও নতুন ধারার পুলিশ বাহিনী গড়তে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ জরুরি, যেমন-
১. পুলিশ বাহিনীকে একটা আলাদা কমিশন অথবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি বিশেষায়িত বিভাগের অধীনস্থ করা, যা পুলিশ সংক্রান্ত সব নীতিমালা প্রণয়ন, পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করার দায়িত্বে থাকবে! এ কমিশন বা বিভাগ তাদের সব কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহিতার আওতায় থাকবে। এ ব্যাপারে সিঙ্গাপুর পুলিশের অভিজ্ঞতা ও সহযোগিতা কাজে আসবে। ২. পুলিশের সব সদস্য একমাত্র যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্বাচিত হবেন! এ ব্যাপারে কেউ হস্তক্ষেপ করলে তাকে সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনা হবে। ৩. পুলিশের সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত, চৌকশ ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সদস্যদেরই পুলিশ একাডেমির প্রশিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দিতে হবে। তাদের জন্য বিশেষ ভাতা ও সুবিধাদির বন্দোবস্ত করতে হবে, যাতে চৌকশ সদস্যরা একাডেমিতে কাজ করায় আগ্রহী হন! ৪. পুলিশকে জনবান্ধব বাহিনীতে রূপান্তরিত করতে এক সুচিন্তিত, বাস্তবসম্মত ও গঠনমূলক প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল প্রস্তুত করতে হবে; যা প্রতিবছর পর্যালোচনা ও প্রয়োজনের তাগিদে সংযোজন, বিয়োজন ও আধুনিকীকরণ করা হবে। ৫. পুলিশ প্রশিক্ষণের বর্তমান সূচি এখনকার প্রেক্ষাপটে বাস্তবসম্মত নয়। এখানে আধুনিক প্রশিক্ষণ বিষয়ের অপ্রতুলতা, প্রশিক্ষণ পদ্ধতির নবায়ন বিমুখতা বিরাজমান। প্রশিক্ষণে মানবিকতা, জনসম্পৃক্ততা সংক্রান্ত কর্মসূচির অভাব প্রকট। তাই পুরো প্রশিক্ষণ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন জরুরি। ৬. পুলিশের কাজ দেশের মানুষের সঙ্গে যুদ্ধ নয়। পুলিশ প্রশিক্ষণে গুরুত্ব দিতে হবে-মানবিকতা, নৈতিকতা ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ক্ষমতা। সমাজ ও জনগণের আস্থা অর্জন, নৈকট্য বিধান এবং জনগণের সেবক হওয়ার দিকনির্দেশনামূলক শিক্ষা। একইসঙ্গে শারীরিক গঠন ও আত্মরক্ষামূলক প্রশিক্ষণের প্রয়োজন অবশ্যই থাকবে। ৭. প্রশিক্ষণে সর্বোচ্চ মেধা ব্যবহারে প্রয়োজনে সমাজের নানা স্তরে, যথা-বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সমাজবিজ্ঞানী, মনস্তাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞ, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বিশেষজ্ঞ, জনসংযোগে অভিজ্ঞ ব্যক্তি এবং অতীতে পুলিশের উচ্চপদে কর্মরত সৎ অফিসারদের প্রশিক্ষণ-সেমিনার বা গোলটেবিল আলোচনায় আমন্ত্রণ জানানোর নিমিত্তে একটি বিশেষজ্ঞ তালিকা প্রণয়ন করা যেতে পারে। ৮. পুলিশের উৎকর্ষ বিধানে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেসব সংগঠনের সঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর যোগাযোগ রয়েছে, প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে তাদের সাহায্য চাওয়াও সম্ভব। অনেক বন্ধু রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক সংগঠন এক্ষেত্রে এগিয়ে আসবে বলে বিশ্বাস। পাশাপাশি বিদেশে কর্মরত এ সংক্রান্ত বিষয়ে অভিজ্ঞ প্রবাসীদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।
পুলিশ বাহিনী শুদ্ধিকরণের অন্যতম উপায় উন্নততর প্রশিক্ষণ; যেখানে জনকল্যাণমূলক পুলিশিংবিষয়ক দক্ষতাকে সমৃদ্ধ করার দিকনির্দেশনা থাকবে। শুদ্ধিকরণ যাত্রায় মানবিকতা, নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে। পাশাপাশি প্রশাসনিক, দাপ্তরিক, বিধি-বিধান, কার্য-প্রণালিগত সংস্কার, পরিবর্তন বা আধুনিকরণ করা হবে, যেমন-
১. পুলিশ বাহিনীর কার্যপ্রণালি বিধিতে এক সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা থাকবে, যা সংশোধিত সংবিধান, পুলিশের নীতি, আদর্শ ও গঠনতন্ত্রের আলোকে বর্ণিত। ২. পুলিশ বাহিনীর কর্মে অদক্ষতা, অক্ষমতা, সাবধানহীনতা ও মাত্রাতিরিক্ত শক্তি ব্যবহারের জন্য ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত দায়বদ্ধতা থাকবে। ৩. পুলিশ নিয়োগকালে মানবিক ও মানসিক অবস্থা নিরীক্ষা সংক্রান্ত পরীক্ষা অন্তর্ভুক্তি। ৪. সমন্বিত ও সৌহার্দপূর্ণ পদ্ধতির ব্যবহার-যেখানে কর্ম-পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনাগত সমস্যা সমাধান ও দিকনির্দেশনা নিজেরাই ঠিক করবে ও জবাবদিহিতার আওতায় থাকবে। ৫. পুলিশের ওপর অন্য বিভাগ কর্তৃক খবরদারি এবং তদবির বিশেষ অপরাধ বলে বিবেচিত হবে! ৬. পুলিশের শক্তি ব্যবহার সম্পর্কিত এক হ্যান্ডবুক বা নির্দেশনা পুস্তিকা প্রস্তুত/নবায়ন/আধুনিকরণ (সাংবিধানিক এবং পুলিশ নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ)। ৭. সর্বক্ষেত্রে পুলিশ প্রশাসনকে জবাবদিহিতামূলক বেষ্টনীতে রাখার রূপরেখা এবং সে অনুযায়ী পরিচালনা। ৮. পুলিশ সহযোগিতামূলক পদ্ধতির ওপর নির্ভর করবে, যেখানে ব্যক্তির মর্যাদায় সম্মান থাকবে ও সমস্যা সমাধানে সমাজ বা এলাকার বাসিন্দাদের বিশ্বাসের ওপর গুরুত্ব প্রদান করবে। ৯. পুলিশের অপরাধ হ্রাসের প্রক্রিয়ায় কাঠামোগত ও পরিবেশগত কৌশলগুলোর ওপর নির্ভর করবে। যেমন বিশেষ দুর্যোগময় এলাকায় সিসিটিভি, পর্যাপ্ত আলো, পরিত্যক্ত ভবনগুলো সুরক্ষিত করা ইত্যাদি। নির্দিষ্ট অপরাধ মোকাবিলায় এলাকাভিত্তিক অংশীদারত্ব গড়ে তোলা (যেমন সাম্প্রতিক ছিনতাই, ডাকাতিসংক্রান্ত অপরাধ)। ১০. তথ্যপত্রগুলো ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষণের ও গোপনীয়তা রক্ষার আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড মেনে পরিচালনা করা। পুলিশ কর্মকর্তাদের স্বাক্ষরিত তথ্যাবলি অনলাইনে রাখা, যেখানে সরকারি তদন্তকারী কমিটি ও গুটিকয়েক ঊর্ধ্বন কর্মকর্তার প্রবেশাধিকার থাকবে এবং এ বিষয়ে সব গৃহীত পদক্ষেপ/পরিবর্তন লিপিবদ্ধ থাকবে। ১১. জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ভিডিও রেকর্ডিং ব্যবহার করা, যেমন-পুলিশ এবং আসামি/সন্দেহজনক ব্যক্তির সঙ্গে কথোপকথন বা জিজ্ঞাসাবাদ। ১২. জননিরাপত্তাজনিত বিশেষ অভিযান পরিচালনায় বডি ক্যামেরা বা ভিডিও চিত্র গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা এবং এডিটিং ব্যতিরেকে ভিডিওটি অপারেশন সমাপ্তির পরপরই সুরক্ষিত হস্তান্তর করা। ১৩. পুলিশিং মানদণ্ড বাধ্যতামূলক করা, জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে আইনপ্রণয়ন বা আধুনিকায়ন করা, যাতে নাগরিক ও মানবাধিকারের প্রতি অধিকতর সম্মান নিশ্চিত হয়। ১৪. পুলিশ বাহিনীর সামরিকীকরণ বন্ধ। পুলিশ এলাকার নিরাপত্তা বিধানে এলাকাবাসীর সমর্থনে কাজ করবে। আইন প্রয়োগের উদ্দেশ্যে উপযুক্ত নয়, এমন সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহ ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করবে। ১৫. প্রতি জেলা-সদর থানায় (কেন্দ্রীয় তথ্যপ্রযুক্তি ও ডাটা বিশ্লেষণ বিভাগের পাশাপাশি) এক বিশেষায়িত সেল গঠন করা, যা তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজে ক্ষত সৃষ্টিকারীদের প্রতিরোধ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়তা করবে। ১৬. বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুলিশের বেতন কাঠামোর পর্যালোচনা করা। যাতে পুলিশ/কর্মকর্তা অসৎ উপায় অবলম্বনে নিরুৎসাহিত থাকেন (পাশাপাশি আইন-ভঙ্গে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা)। ১৭. পোশাক এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর পুলিশের ভাবমূর্তি অনেকাংশে ভূলুণ্ঠিত। সেই ভূলুণ্ঠিত ভাবমূর্তিকে আস্থার প্রতীকে রূপান্তরিত করা এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। তাই নতুন ধারার পুলিশের নতুন পোশাক বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে। এ পোশাক পরিবর্তনে জনগণকে সম্পৃক্ত করে (পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে) একটি নকশা/ডিজাইন প্রতিযোগিতার আয়োজন হলে উদ্দীপনার সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। বেশ খরচের ব্যাপার হলেও সঠিক উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে অনেক পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এ খরচের অংশীদার হতে এগিয়ে আসবেন বলে বিশ্বাস। পোশাক তৈরিকারক প্রতিষ্ঠানের নাম স্বাভাবিকভাবে বিভিন্ন তথ্য মাধ্যমে প্রচারিত হবে, যা ব্র্যান্ড হিসাবে পরিচিতি পাওয়ার ক্ষেত্রে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাহায্য করবে।
পরিশেষে, বিশ্বের সেরা পুলিশ বাহিনী কঠোর প্রশিক্ষণ, উন্নত প্রযুক্তি এবং জনসেবার প্রতি অঙ্গীকারের মতো বৈশিষ্ট্যগুলো ভাগ করে নেয়। প্রতিটি বাহিনীরই স্বতন্ত্র কাঠামো এবং আইন প্রয়োগের পদ্ধতি রয়েছে, যা দেশের ইতিহাস এবং আইনি ব্যবস্থা দ্বারা পরিচালিত। সেইসঙ্গে দেশের শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বজায় রাখার কঠিন কাজে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাই আমাদের প্রত্যাশা, পুলিশ জনগণের নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার পাশাপাশি এলাকাবাসী/কমিউনিটির সঙ্গে পারস্পরিক বিশ্বাস, ইতিবাচক সম্পর্ক ও সম্মানের সঙ্গে কাজ করবে।
সেদিন হয়তো দূরে নয়, যেদিন আমরা গর্ব করে বলতে পারব-আমাদের দেশের পুলিশ ফিনিশ, সুইডিশ, নরওয়েজিয়ান বা সিঙ্গাপুরিয়ান পুলিশের চেয়ে কম নয়। দেশের মানুষ বলবে পুলিশকেই তারা সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে। বাংলাদেশ পুলিশ হয়ে উঠবে জনগণের আস্থার প্রতীক।
ড. মনজুর আলম : সহযোগী অধ্যাপক, হেলসিংকি বিশ্ববিদ্যালয়, ফিনল্যান্ড; শাসনতান্ত্রিক সংস্কার বিশেষজ্ঞ, ইইউ উন্নয়ন প্রকল্প