Logo
Logo
×

বাতায়ন

হুমকির মুখে নিঝুম দ্বীপের জীববৈচিত্র্য

Icon

আবু তাহের খান

প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

হুমকির মুখে নিঝুম দ্বীপের জীববৈচিত্র্য

সাধারণ মানুষের মধ্যে এ তথ্য এখনো প্রায় অপ্রচারিত যে, সুন্দরবনের পর বাংলাদেশের বৃহত্তম লোনা পানির বনাঞ্চল হচ্ছে নিঝুম দ্বীপের বন। বঙ্গোপসাগরের বুকে মেঘনা নদীর মোহনায় গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের গোড়ায় জেগে ওঠা এই দ্বীপ সুন্দরবনের মতোই প্রায় সম জীববৈচিত্র্যসম্পন্ন। অনুকূল আবহাওয়া ও জলবায়ুর কারণে এ দ্বীপে মানববসতি গড়ে ওঠা, বৃক্ষরাজির জন্মলাভ এবং অন্য প্রাণিকুলের আবির্ভাব সবই ঘটেছে তুলনামূলকভাবে অনেকটাই দ্রুতগতিতে। এখানে মানববসতি শুরু হয় ১৯৫০-এর দশকের গোড়ায়, যদিও ১৯৭০-এর ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের অব্যবহিত পর সেখানে আর কোনো জীবিত মানুষকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সেখানে আবারও মানুষের বসবাস শুরু হয় এবং একই ধারায় বাড়তে থাকে গাছগাছালি ও পশুপাখির সংখ্যা। কিন্তু চরম হতাশা ও দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, কতিপয় লুটেরা ও ক্ষমতার আশীর্বাদপুষ্ট মানুষের লোভ ও নিষ্ঠুরতার কারণে এ ত্রিপক্ষীয় (মানুষ, বন ও পশুপাখি) বৃদ্ধির ধারা খুব বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি।

নিঝুম দ্বীপের বনকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও চিত্রা হরিণের অভয়ারণ্য হিসাবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল ২০০১ সালে এবং তখন ওই বনভূমির আয়তন ছিল ৪০ হাজার ৩৯০ একর। কিন্তু ওই ঘোষণার অতি অল্প সময় পর থেকেই এ বনের ধ্বংস প্রক্রিয়া শুরু হয়, যে প্রক্রিয়ার আওতায় গাছপালা ও পশুপাখি দুই-ই স্থান পায়। আর এরই ফলে সেখানকার বনভূমির পরিমাণ গত আড়াই দশকের ব্যবধানে ৫০ শতাংশেরও বেশি কমে গেছে। বন নিধনের এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী আড়াই দশকের মধ্যে বাকিটুকুও বিলুপ্ত হয়ে গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। অথচ নিঝুম দ্বীপের এই বন সিডর (২০০৭), আইলা (২০০৯), ফনি (২০১৯) ইত্যাদির মতো ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি থেকে নোয়াখালী উপকূলের মানুষসহ বিশাল প্রাণিকুল, গাছগাছালি, বাড়িঘর ও অন্যান্য সম্পদকে বাঁচাতে বিশাল প্রতিরোধক দেওয়াল হিসাবে কাজ করেছে। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলা এবং ঝড়-উত্তর ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে যে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হয়, নিঝুম দ্বীপের মতো সমুদ্র উপকূলীয় বনাঞ্চলগুলোকে নামমাত্র ব্যয়ে পাহারা ও যত্ন দিয়ে সংরক্ষণ করতে পারলে ওই অর্থের সিংহভাগই সাশ্রয় করা সম্ভব। কিন্তু রাষ্ট্র সে পথে না হেঁটে হেঁটেছে ধ্বংসের পথে।

নিঝুম দ্বীপের সবচেয়ে বড় প্রাণিসম্পদ হচ্ছে চিত্রা হরিণ। ১৯৮৫ সালে সেখানকার বনে প্রথমবারের মতো দুই জোড়া চিত্রা হরিণ অবমুক্ত করার পর পরবর্তী ২৫ বছরে অর্থাৎ ২০১১ সাল নাগাদ সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪০ হাজারে। কিন্তু অত্যন্ত হতাশা ও পরিতাপের বিষয় এই যে, ২০১১-পরবর্তী এক যুগের ব্যবধানে ওই হরিণের সংখ্যা ৪০ হাজার থেকে কমে মাত্র ৪-৫ হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে। কী সর্বনাশা তথ্য! এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সবার চোখের সামনে এমন সর্বনাশা ঘটনাগুলো ঘটছে কেমন করে? মাত্র এক দশকের ব্যবধানে চিত্রা হরিণ নিধনের এসব সর্বনাশা ঘটনার সঙ্গে কারা কারা জড়িত? রাষ্ট্রের পক্ষে এ বনভূমি ও প্রাণিকুল রক্ষার দায়িত্বে কি কেউই ছিলেন না? আপাত বক্তব্যে এখানে হরিণ নিধনের যে সংখ্যার কথা বলা হলো, এক্ষেত্রে প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি।

নিঝুম দ্বীপে চিত্রা হরিণের বংশগতির ধারা ও প্রবণতা বিশ্লেষণপূর্বক প্রদত্ত বিশেষজ্ঞ অভিমত অনুযায়ী ২০২১ সাল নাগাদ সেখানে হরিণ থাকার কথা ন্যূনপক্ষে ৯০ হাজার। তার মানে, চিত্রা হরিণ নিধনজনিত দৃশ্যমান ও কথিত ক্ষতির তুলনায় এক্ষেত্রে প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বেশি।

চিত্রা হরিণ এবং এ ধরনের অন্যান্য প্রাণী শুধু যে নিঝুম দ্বীপেই অবাধ নিধনের শিকার হচ্ছে তাই নয়, সুন্দরবনসহ দেশের অন্য বনাঞ্চলগুলোতেও এ ধরনের ঘটনা প্রায় একই মাত্রায় ঘটে চলেছে। আর দেশজুড়ে ঘটা এসব ক্ষতির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মোট পরিমাণকে যদি সমন্বিতভাবে উপস্থাপন করা হতো, তাহলে যে চিত্র দেখা যেত, তা সম্প্রতি ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে অর্থনীতির ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ সংক্রান্ত শ্বেতপত্রেও উঠে এসেছে। কিন্তু রাষ্ট্রের নীতি ও সিদ্ধান্ত প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় বিদ্যমান রাজধানীকেন্দ্রিক চর্চার কারণে দেশের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে কী ঘটছে, রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা তার তেমন কোনো খোঁজই রাখেন না এবং খোঁজ রাখার কোনো তাগিদও তাদের মধ্যে কখনো অনুভূত হয় না। আর সে কারণেই স্থানীয় ও জাতীয় উভয় পর্যায়ের তথাকথিত জনপ্রতিনিধিরা নিঝুম দ্বীপ, সুন্দরবন, পার্বত্য চট্টগ্রাম, ভাওয়াল ও মধুপুরের বনাঞ্চল রক্ষার মতো কাজে বিন্দুমাত্র তাগিদ অনুভব করেন না।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে দেখা যাচ্ছে, নিঝুম দ্বীপের চিত্রা হরিণের মাংসে বনবিভাগের কর্মচারী, বিভিন্ন স্তরের জনপ্রতিনিধি, জনপ্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ অনেকেরই রসনা বিলাস ঘটছে। আর বনের গাছগাছালি উজাড় হচ্ছে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও বনবিভাগের স্থানীয় কর্মচারীদের যোগসাজশে। অবশ্য দরিদ্র মৎসজীবী ও স্থানীয় বেকারদের একটি বড় অংশও এ নিধন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। তবে তাদের এ সম্পৃক্ততার অনেকটাই ঘটেছে জীবিকার প্রয়োজনে সামান্য আয়ের আশায়। রাষ্ট্র তাদের জন্য কর্মসংস্থান করতে পারেনি বলেই ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় এবং বুঝে বা না বুঝে এসব অন্যায় কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। এসব ঘটনার মূল কুশীলব আসলে রাজনীতির আশীর্বাদপুষ্ট স্থানীয় ক্ষমতাধররা। এদের হাত থেকে নিঝুম দ্বীপকে বাঁচাতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষের প্রতি রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের উপেক্ষাসুলভ দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। ভৌগোলিক অবস্থানগত প্রান্তিকতার কারণে নিঝুম দ্বীপ যতদিন নীতিনির্ধারকদের চোখের আলোর বাইরে থেকে যাবে, তথা উপেক্ষার শিকার হয়ে থাকবে, ততদিন পর্যন্ত সেখানে বন উজাড় ও হরিণ নিধন চলতেই থাকবে।

এ পরিস্থিতিতে পরিবেশবাদীরা কি দেশের প্রান্তিক জনপদগুলোর জীববৈচিত্র্য তথা পরিবেশ রক্ষার দিকে আরেকটু মনোযোগী হবেন? কপ-২৯ সম্মেলনে উন্নত বিশ্বের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায়নি বলেই কি নিঝুম দ্বীপ, সুন্দরবন ও অন্যান্য প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকাগুলো কিংবা পরিবেশ ঝুঁকিতে থাকা অনুরূপ অন্য এলাকাগুলো নীরব ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাবে? দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থ ও পরিবেশসম্মত টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা ভেবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও মনোযোগের কিছুটা কি এ মুহূর্তে নিঝুম দ্বীপের মতো সংকটাপন্ন এলাকাগুলোর জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য বরাদ্দ করা যায় না? এ সূত্রে বলা প্রয়োজন যে, এক্ষেত্রে সম্পদ সংস্থানের চেয়েও অধিক জরুরি হচ্ছে রাষ্ট্রের মনোযোগকে এ কাজের প্রতি নিবিষ্টতাপূর্ণ করে তোলা। আর সে মনোযোগ শুধু তখনই নিশ্চিত হতে পারে, যখন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্তরা জনমানুষের কষ্ট, প্রয়োজন ও উপলব্ধিকে ধারণ করবেন।

আবু তাহের খান : সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম