ওষুধ বিপণনে উপঢৌকন প্রদান বন্ধ করা উচিত
ড. মো. আব্দুল মুহিত
প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
নীলক্ষেতের বইয়ের দোকান এলাকায় গেলে আজকাল দেখতে পাবেন, ফুটপাতে নানারকমের উপহারপণ্য বিক্রি করছে কিছু মৌসুমি বিক্রেতা। চা, কফি, মসলা, ঘড়ি, পারফিউম, বডিলোশন, কলম, প্যাড, বেল্ট, ছুরি, প্লেট, গ্লাস, সাবান, শ্যাম্পু থেকে শুরু করে বাদাম, কিশমিশসহ বাহারি সব পণ্য। এসব পণ্যের গায়ে দেখবেন বিভিন্ন ওষুধের ব্র্যান্ডের নাম। মূলত এ নিত্যব্যবহার্য পণ্যসামগ্রী ওষুধ কোম্পানি থেকে চিকিৎসকদের জন্য উপহার হিসাবে দেওয়া হয়। সেগুলো চিকিৎসকদের হাত থেকে বিভিন্ন মৌসুমি বিক্রেতা কিনে এনে এখানে বিক্রি করছেন। ওষুধ হলো এক ধরনের কেমিক্যাল, যার সঠিক ব্যবহারে মানুষ সুস্থ হতে পারে। অন্যদিকে অযৌক্তিক ব্যবহারে মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। তাই ওষুধের সঠিক ও নিরাপদ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রাথমিকভাবে চিকিৎসকদের প্রদত্ত প্রেসক্রিপশনের ওপর আস্থা রাখতেই হবে। তাই জাতীয় ওষুধনীতিতে আইন করে ওষুধের ব্যবহারে চিকিৎসকদের ভূমিকা মুখ্য হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। যেহেতু চিকিৎসকরাই প্রেসক্রিপশন দিতে পারেন, সেহেতু ওষুধ কোম্পানি চিকিৎসকদেরই তাদের প্রাথমিক কাস্টমার হিসাবে মনে করে। চিকিৎসকদের মাধ্যমেই তাদের ব্যবসায় টিকে থাকা এবং উন্নতি উভয়ই সম্ভব। ফলে কারখানায় ওষুধ উৎপাদনের পাশাপাশি তা চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশনে তোলার কাজটি কোম্পানির বিপণন বিভাগের হাতে ন্যস্ত। অর্থাৎ ওষুধের বিপণনের ওপর নির্ভর করছে কোম্পানির সার্বিক উন্নতি।
ওষুধের বিপণনের সঙ্গে অন্যান্য পণ্যের বিপণনের ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। ওষুধ বিপণনের প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে চিকিৎসকদের মাঝে ওষুধ এবং চিকিৎসাবিষয়ক জ্ঞান বিতরণ প্রক্রিয়া। প্রতিনিয়ত সারা বিশ্বে ওষুধ ও রোগ বিষয়ে নিত্যনতুন জ্ঞান সৃষ্টি হচ্ছে। আবিষ্কৃত এসব জ্ঞান চিকিৎসকদের মাঝে অবহিতকরণের উদ্দেশ্যে কোম্পানির বিপণন বিভাগ বিপণন কর্মীর মাধ্যমে শো-কার্ড, লিটারেচার, প্যাড, পোস্টার, লিফলেট, বুকলেট ইত্যাদি প্রদান করে থাকে। কখনো কখনো সেখানে তাদের কোম্পানির ওষুধ কেন উন্নতমানের, তা ব্যাখ্যা করা থাকে। অর্থাৎ ওষুধ কোম্পানি তাদের উৎপাদিত ওষুধের গুণাগুণ ও ব্যবহার সম্পর্কে চিকিৎসকদের অবহিত করে থাকে। এছাড়া কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের জ্ঞান সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য চিকিৎসকদের নিয়ে সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম বা কনফারেন্স আয়োজন করা হয়। প্রচলিত বিপণন বলতে আমরাও তা-ই বুঝি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে ওষুধের বিপণনের মাত্রা ও ধরনে পরিবর্তন এসেছে।
এদেশে প্রায় ৩০০ ওষুধ কোম্পানি সফলভাবে ব্যবসা করছে। সব কোম্পানিকেই তাদের উৎপাদিত ওষুধের বিপণন করতে হচ্ছে। ফলে বিপণন প্রক্রিয়া দিন দিন জটিল ও ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে। এরই সঙ্গে রোগীর স্বার্থের বিঘ্ন ঘটে চলেছে। বর্তমানে সবাই এক অসুস্থ বিপণন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার জন্য ওষুধ কোম্পানিগুলো গুণগত মানসম্পন্ন ওষুধ উৎপাদনের পাশাপাশি চিকিৎসকদের নানা ধরনের উপঢৌকনও উপহার হিসাবে দিচ্ছে। প্রথমে কলম দিয়ে শুরু হয়েছিল। পরে টিস্যুবক্স, গ্লাভস, ওষুধের ফ্রি চিকিৎসক স্যাম্পল দিতে দেখা গেছে। বর্তমানে এসব পণ্যসামগ্রীও প্রদান করা হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, একজন চিকিৎসককে গৃহস্থালির কোনো পণ্য আর বাজার থেকে কিনতে হবে না। এছাড়া কোনো কোনো ব্যস্ত চিকিৎসকদের বাসার ফ্রিজ, টিভি, এসি থেকে শুরু করে বাথরুমের সাবান, শ্যাম্পু সব পণ্যই উপহার হিসাবে দেওয়া হচ্ছে। আবার এও শোনা যায়, কোম্পানি ও চিকিৎসকের মাঝে অর্থের লেনদেন হয়ে থাকে। অর্থাৎ কিছু কিছু চিকিৎসককে কোম্পানির পক্ষ থেকে মাসিক এককালীন টাকা প্রদান করা হয়ে থাকে। বিনিময়ে চিকিৎসক মহোদয় সেই কোম্পানির নির্দিষ্ট একটি বা দুটি ওষুধ তার প্রদত্ত প্রেসক্রিপশনে লিখে দেন। যদি কোম্পানিটির উৎপাদিত ওষুধ নিুমানের হয়ে থাকে, ব্যাপারটি তাহলে কি ভয়ংকর দাঁড়ায়, ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। রোগীর সুস্থ হওয়ার পরিবর্তে নিুমানের ওষুধ খেয়ে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে যেতে পারে।
বস্তুত উপহারসামগ্রী প্রদান ওষুধ বিপণনের একটি অনৈতিক পদ্ধতি, যার মাধ্যমে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ তাদের ওষুধের ব্র্যান্ড নাম চিকিৎসকদের কাছে তুলে ধরেন। আমরা মনে করি, এটি একটি অগ্রহণযোগ্য পদ্ধতি। কারণ, এটি যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা রীতিমতো মহামারি আকার ধারণ করেছে। কল্পনা করুন, শত শত ওষুধ কোম্পানির হাজার হাজার ওষুধের ব্র্যান্ড নাম চিকিৎসকদের কাছে পৌঁছানোর জন্য কত ধরনের উপহার প্রতিনিয়ত প্রদান করতে হচ্ছে। অনিবার্যভাবেই এর সঙ্গে খরচের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, যা প্রকৃতপক্ষে জনসাধারণকে ওষুধের দামের সঙ্গে প্রদান করতে হয়। সাধারণত ওষুধ কোম্পানি তাদের একটি ওষুধের প্রকৃত দামের ১৫ শতাংশ অর্থ বিপণনে ব্যয় করে থাকে। তবে অসুস্থ এ প্রতিযোগিতার যুগে এর পরিমাণ বেশিই হবে। এ বিনিয়োগকৃত অর্থ প্রকৃতপক্ষে আমাদের সাধারণ রোগীদের পকেট থেকেই যাচ্ছে। তাই চিকিৎসকদের জন্য প্রদত্ত উপহার আসলে গরিব রোগীদের অনেক কষ্টার্জিত অর্থ। এ অতিরিক্ত অর্থ খরচের কোনো যৌক্তিকতা নেই এবং তা অনৈতিকও বটে।
ওষুধ উৎপাদন, বিক্রয়, বাজারজাতকরণ, সংগ্রহ, আমদানি, রপ্তানি, মান-নিয়ন্ত্রণ ও বিতরণের জন্য ওষুধ ও কসমেটিকস আইন ২০২৩ প্রণয়ন করা হয়েছে। খুব আশ্চর্যের বিষয় হলো, ওষুধ বিপণনের জন্য কোনো নিয়মনীতি সেখানে নেই। স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে, এর কারণ কী? এর পেছনে কি চিকিৎসকদের স্বার্থ জড়িত রয়েছে? জাতীয় ওষুধনীতির ২২(২) উপধারা মোতাবেক সব ওষুধের মার্কেটিং অথোরাইজেশন সনদ গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু সেখানে বিপণনের জন্য কী কী পদ্ধতি অবলম্বন করা যাবে, সে বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। অর্থাৎ ওষুধ বিপণনের পদ্ধতি বা অনৈতিকতার শাস্তি সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। অন্যদিকে ওষুধনীতির ২৫নং ধারায় ওষুধের গুণগতমান সন্তোষজনক না হলে সে ওষুধের নিবন্ধন বাতিলের কথা বলা হয়েছে। নিবন্ধনকৃত ওষুধ মানুষের দেহে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করলে তাৎক্ষণিকভাবে বাজার থেকে প্রত্যাহারের কথাও ২৬নং ধারায় বলা হয়েছে। কিন্তু ওষুধের বিপণনে অনৈতিকতার চর্চা হলে সেটা অপরাধ বলে বিবেচিত হবে কিনা, তা কোথাও বলা হয়নি। ৭১নং ধারায় লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ওষুধের বিজ্ঞাপন বা প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফলে চিকিৎসকদের মাঝেই শুধু ওষুধবিষয়ক বিপণন সীমাবদ্ধ রয়েছে। কিন্তু বিপণনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধের কোনো আইন আপাতত নেই।
কাজেই অতিদ্রুত স্বল্পস্থায়ী উদ্যোগের অংশ হিসাবে পরিপত্র জারি করে ওষুধের বিপণন নীতিমালা ঠিক করা জরুরি হয়ে পড়েছে। আর পর্যায়ক্রমে চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশনে ওষুধের জেনেরিক নাম লেখার আইন করা উচিত বলে মনে করি। ওষুধের দাম ইদানীং সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। কোনো কোনো ওষুধের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় ওষুধ ক্রয় কঠিন হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে এ অনৈতিক বিপণন প্রতিযোগিতা বন্ধ হলে ওষুধের দাম কমপক্ষে ১৫ শতাংশ কমবে বলে আমার বিশ্বাস। এছাড়া গুণগত ওষুধ প্রেসক্রিপশনের বিষয়টি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
ড. মো. আব্দুল মুহিত : অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি ও ফার্মাকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়