কে শুনবে আমাদের অসহায়ত্বের কথা?
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
মনজু আরা বেগম
প্রকাশ: ০৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
![কে শুনবে আমাদের অসহায়ত্বের কথা?](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2025/01/06/70-677ae82809616.jpg)
আমরা- এ দেশের সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত অপেক্ষায় থাকি দুঃসংবাদের। দুঃসংবাদ আমাদের পিছু ছাড়ছে না। সুসংবাদ যেন আমাদের জীবন থেকে দূরে সরে গেছে। দৈনিক যুগান্তরে ৩ জানুয়ারি পিলে চমকানো দুঃসংবাদ ছাপা হয়েছে- আইএমএফের চাপে ৬৫টি পণ্যসেবায় ভ্যাট বৃদ্ধি। এতে সংসার খরচ আরও বাড়বে। যে ৬৫টি পণ্য ও সেবার মূল্যবৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, এলপি গ্যাস, গুঁড়াদুধ, বিস্কুট, ফলমূল, সাবান, ডিটারজেন্ট ইত্যাদি। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে এমনিতেই চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে প্রাত্যহিক জীবন অতিবাহিত করছি, তার ওপর আইএমএফের চাপে যদি আবার মূল্য বৃদ্ধি পায় জীবন রক্ষাকারী ওষুধের- যা না খেলে শুধু অসুস্থতা বাড়বে তা-ই নয়, জীবন বিপন্ন হওয়ার শতভাগ আশঙ্কাও রয়েছে। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে আমরা কোথায় যাব? আমাদের অসহায়ত্বের কথা কাকে জানাব? শুধু তা-ই নয়, ঋণ দিতে আইএমএফ আমাদের কর জিডিপির অনুপাত দশমিক ২ শতাংশ বাড়ানোর শর্ত দিয়েছে। টাকার অঙ্কে যা ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি। আরও জানা যায়, উপদেষ্টা পরিষদ ইতোমধ্যে নতুন ভ্যাট হারের বিষয়টি অনুমোদনও দিয়েছে, কয়েক দিনের মধ্যে প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার কথা রয়েছে। এমনিতেই ইতঃপূর্বে আইএমএফের ঋণের কিছু শর্ত বাস্তবায়নের ফলে দেশের অর্থনীতি বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ঋণের সুদহার বৃদ্ধি, জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করা, ডলারের দাম বাড়ানো, মূল্যস্ফীতির হার কমাতে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করার ফলে বেসরকারি খাতের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ খাতে বিনিয়োগ কম হচ্ছে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগও ইতোমধ্যে কমে গেছে। বেসরকারি খাত দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টির অন্যতম খাত। কিন্ত আইএমএফের দেওয়া বিভিন্ন শর্তের ফলে বেসরকারি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ফলে দেশের এ খাতের উদ্যোক্তারা মনে করছেন আইএমএফের শর্ত বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য উপযোগী নয়।
জানা যায়, বাংলাদেশের অর্থনীতি সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে বিগত অর্থবছরে বৈদেশিক খাতে সবচেয়ে অস্থির সময়ের মুখোমুখি হয়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমানো হয়েছে। আমদানি রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করায় শিল্প খাতের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত খাদ্য নিরাপত্তাবিষয়ক হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, করোনাভাইরাসের শেষ সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রতি মাসে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ৫ থেকে ৩০ ভাগ পর্যন্ত। দীর্ঘসময় ধরে মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের ওপরে থাকলেও পরে তা আরও বৃদ্ধি পেয়ে এখন ডাবল ডিজিটে অবস্থান করছে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে মূল্যস্ফীতি কমলেও বাংলাদেশে তা বেড়েই চলেছে। মানুষের আয় বাড়ছে না, কিন্তু ব্যয় বেড়েই চলেছে। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের জীবন এমনিতেই বিপন্ন হচ্ছে তার ওপর যদি আবারও আইএমএফের শর্ত পূরণ করতে হয় তাহলে আমরা যাব কোথায়? সামনে পবিত্র রমজান। অসাধু ব্যবসায়ীরা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসা তো দূরের কথা পূর্ববর্তী মূল্যের চেয়ে আরও কয়েকগুণ বেড়ে মানুষের নাভিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে। খেটে খাওয়া শ্রেণির পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। কোথাও লাগাম টেনে ধরার লক্ষন নেই।
এদিকে সমাজে ধনী গরিবের বৈষম্য আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে এ বৈষম্য আরও বেশি স্পষ্ট হচ্ছে। দুবছরেরও বেশি সময় নিত্যপণ্যের অব্যাহত ঊর্ধ্বগতির কারণে এমনিতেই নিম্ন আয়ের মানুষই শুধু নয়, মধ্যবিত্ত শ্রেণিও কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হচ্ছিল। তার ওপর বর্তমানে আরও কয়েক দফা মূল্যবৃদ্ধির কারণে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবনযাত্রা দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার পণ্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণের পাশাপাশি কিছু কিছু পণ্যের শুল্ককর হ্রাস করেছে, কিছু পণ্যের আমদানির অনুমতি দিয়েছে। সাতটি নিত্যপণ্যের ওপর শুল্ক হ্রাস করায় ২০০০ কোটি টাকা সরকার ছাড় দিয়েছে। অথচ এ শুল্ক ছাড়ের জন্য জনগণ কোনো সুবিধা পাচ্ছে না। অর্থাৎ বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়ছে না। তদারকি সংস্থাগুলো বাজারে অভিযান পরিচালনা করছে। টাকার প্রবাহ হ্রাস, সুদের হার বৃদ্ধি ও বাজার তদারকি জোরদারকরণ - এসব পদক্ষেপ নেওয়ার পরও সামগ্রিকভাবে বাজারে এগুলোর কোনো প্রভাব পড়েনি। লক্ষ করা যাচ্ছে, কোনো কারণ ছাড়াই ক্রমাগত বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য। ফলে খেটে খাওয়া নিম্নবিত্ত শ্রেণি, নিম্ন-আয়ের চাকরিজীবীসহ প্রবীণ জনগোষ্ঠীর একটা বিরাট অংশ নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ভোক্তার ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। এর বিপরীতে আয় বেড়েছে মাত্র ৮ শতাংশ। অর্থাৎ আয় ও ব্যয়ের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ শতাংশ। ফলে ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। ভোক্তাকে জীবনযাপনের জন্য বাড়তি অর্থ ঋণ বা ধার করতে হচ্ছে। বাজারে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য যে এখন পর্যন্ত সক্রিয়, তা এসব তথ্য থেকে সহজেই বোঝা যায়। আমরা লক্ষ করেছি, বিগত ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে মূল্যস্ফীতির হার বাড়তে থাকে। মূল্যস্ফীতির হার বাড়ায় অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকেও এর প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে খাদ্য ও স্বাস্থ্য খাতে মূল্যস্ফীতির হার ডাবল ডিজিট অতিক্রম করায় এ খাতে মানুষের খরচ অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। কারণ যে দুটি অপরিহার্য খাতে মানুষের ব্যয় সবচেয়ে বেশি হয় তা হলো, খাদ্য ও চিকিৎসা। ২০২২ সালে বিশ্বমন্দা শুরুর আগে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ছিল সাড়ে ৫ শতাংশের মধ্যে। বিশ্বব্যাপী মন্দার প্রভাবে এ হার বাড়তে শুরু করে। ফলে এর নেতিবাচক প্রভাব আমাদের দেশেও পড়েছে।
লক্ষ করা যাচ্ছে, যেসব পণ্য আমদানিনির্ভর নয়, দেশেই উৎপাদন হয়, সেগুলোর দামও ঊর্ধ্বমুখী। ব্যবসায়ীদের অতিমুনাফালোভী মানসিকতা ও চাঁদাবাজির কারণে মূল্যস্ফীতিতে বাড়তি চাপ পড়ছে। এভাবে অসাধু ব্যবসায়ীরা ভোক্তার পকেট কেটে জনজীবনকে বিপন্ন করে তুলছে। বিগত কয়েক বছর ধরে মূল্যস্ফীতির অত্যাধিক চাপে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবনযাত্রার মান কমে গেছে। বিবিএস এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অর্থ সংকটে বাড়ি ভাড়া, স্বাস্থ্য, পরিবহণ, বিনোদন খাতসহ অনেক খাতে মানুষ ব্যয় কমিয়ে দিয়েছেন। খাদ্যদ্রব্যের তালিকা কাটছাঁট করায় পুষ্টিহীনতার শিকার হচ্ছেন প্রবীণ জনগোষ্ঠীসহ মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষ। বিগত বছরে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে বাংলাদেশের ৭১ শতাংশ পরিবার উদ্বিগ্ন রয়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সীমিত বা নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস করছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার ফলে জনসংখ্যার একটি অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে আসতে বাধ্য হয়েছে। এ শ্রেণির মানুষ তাদের আয়ের প্রায় সবটুকু খাদ্যপণ্যের জন্য ব্যয় করেও পুষ্টিকর খাবার খেতে পাচ্ছেন নাা। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বেকার সমস্যাও প্রকট আকার ধারণ করেছে। দেশে মাথাপিছু গড় আয় বাড়লেও তা সব শ্রেণির মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। দেশ থেকে একটা বিশাল পরিমাণে অর্থ পাচার, ঋণখেলাপি, ব্যাংক ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি, বেসরকারি বিনিয়োগ হ্রাস, ডলারের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি, রিজার্ভের পরিমাণ কমে যাওয়া ইত্যাদি মিলিয়ে দেশের অর্থনীতিতে এক অশনিসংকেতের সৃষ্টি হয়েছে। এর থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ আশু প্রয়োজন। মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। এর সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির দিকে নজর দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে যেসব বাধা-বিঘ্ন রয়েছে তা দূর করতে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষ একটা হতাশাজনক কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এমনি এক অবস্থায় আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়ন কতটা যৌক্তিক তা ভেবে দেখা প্রয়োজন।
মনজু আরা বেগম : সাবেক মহাব্যবস্থাপক, বিসিক
monjuara2006@yahoo.com