Logo
Logo
×

বাতায়ন

বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা থাকা উচিত

Icon

ড. আজহারুল ইসলাম

প্রকাশ: ০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা থাকা উচিত

ছবি: সংগৃহীত

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার খবর প্রায়ই শোনা যায়। ‘আত্মহত্যা’ একটি মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা, যা আধুনিক চিকিৎসায় মোকাবিলা করা সম্ভব। জটিল বিষণ্নতায় ভোগা মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নেয়। বিষণ্নতা ছাড়াও অতিরিক্ত চাপ, সামাজিক দক্ষতার ঘাটতি, মাদক ও ইন্টারনেট আসক্তি, হতাশাসহ নানা রকম মানসিক সমস্যায় ভুগে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এসব সমস্যারও রয়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা। শিক্ষার্থীদের মাঝে সেই চিকিৎসা গ্রহণের চাহিদা থাকলেও এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই।

অথচ মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিলে মহামূল্যবান জীবনই শুধু রক্ষা পায় না, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও পরিবেশের উন্নয়ন এবং আর্থিক সাশ্রয় ঘটে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় প্রথম বছরে ঝরে পড়া বা পুনরায় ভর্তি হওয়া একটা পুরোনো সমস্যা। আনুমানিক ৫ থেকে ১০ ভাগ শিক্ষার্থী পুনঃভর্তি হন। শিক্ষার্থীরা প্রথম বছরে অনেকটাই দিশাহারা থাকেন। নতুন পরিবেশে অনেককেই চেনেন না। যে বিষয়ে পড়ছেন, তার ভবিষ্যত নিয়েও সন্দিহান থাকেন। এর ওপর আর্থিক অস্বচ্ছলতা, আবাসস্থলের সংকট, রাজনৈতিক অসহমর্মিতা, বৈষম্য, স্বজনপ্রীতি, যৌন হয়রানি এবং র‌্যাগিং-এসব বিষয় পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। এভাবে সাধারণ মন খারাপ থেকে তীব্র মানসিক যন্ত্রণা সৃষ্টি হয়। ফলে কেউ কেউ ক্লাসে অনিয়মিত হয়ে পড়েন। এ সময় যথাযথ মানসিক কাউন্সেলিং পেলে সেসব শিক্ষার্থীকে ক্লাসে ধরে রাখা সম্ভব হতো। শুধু পুনঃভর্তি কমানোই নয়, সুস্থ মানসিক স্বাস্থ্য একজন শিক্ষার্থীকে ঝরে পড়া থেকে রক্ষা করে, তার মধ্যে অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস কমিয়ে শারীরিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়। তারা তখন অনাকাঙ্ক্ষিত সংঘাতে না জড়িয়ে লেখাপড়াসহ সৃষ্টিশীল ও গঠনমূলক কাজে মনোযোগী হন।

এরপরও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালগুলোতে কার্যত কোনো সমন্বিত মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নেই। যেখানে ৫৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক লাখ ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করছেন, সেখানে মাত্র ৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি, জাবি, শাবিপ্রবি, বুয়েট, জাককানইবি, নোবিপ্রবি,খুবি, বিইউপি) এক বা দুইজন করে মনোবিজ্ঞানী রয়েছেন। শিক্ষার্থীর বিচারে এসব পেশাদারির সংখ্যা একেবারেই অপ্রতুল। অনেক শিক্ষ প্রতিষ্ঠান বছরে একদিন তথাকথিত ‘মোটিভেশনাল বা মানসিক স্বাস্থ্য’ নিয়ে সেমিনার আয়োজন করে। ফলাও করে প্রচার করা এসব সেমিনারে শিক্ষার্থীদের আদতে কোনো উপকার হয় কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।

সমন্বিত মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় প্রয়োজনীয় আর্থিক বরাদ্দও নেই। এ কথা অনস্বীকার্য যে, প্রয়োজনের তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাজেট খুব সীমিত। সেই সীমিত অর্থের সিংহভাগ চলে যায় শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতায়। শিক্ষার্থীদের কল্যাণে বরাদ্দ থাকে সামান্য। এই সামান্য বরাদ্দ থেকে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য কিছু টাকা ব্যয় করা অনেকেই হয়তো যথার্থ মনে করেন না। এটিকে বিলাসিতা মনে করেন। অনাগ্রহের আরেকটা কারণ সম্ভবত মানসিক স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ হলে যে উপকার হয়, তা খালি চোখে দেখা যায় না। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য সমন্বিত কী মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া যায়, সে বিষয়ে জ্ঞাননির্ভর তথ্যের অভাবও একটি বড় বাধা। অনেকের ধারণা, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা একটি জটিল আর ব্যয়বহুল কাজ।

প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি মোটেও জটিল আর ব্যয়বহুল নয়। একটু বাড়তি যত্ন নিলে বিশ্ববিদ্যালগুলো শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারে। যেমন, প্রথম বছরে তাদের সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ স্থাপন করে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সঙ্গে আপন করে নিতে পারলে শিক্ষার্থীদের একাকীত্ববোধ কমিয়ে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি হ্রাস করা যায়। কেননা, যথাযথ যোগাযোগ স্থাপন না হলে বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি তৈরি হয়। মানসিক সমস্যার শুরুটা হয় এই বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি দিয়েই। অন্যভাবে বললে, শিক্ষার্থী যে পরিবেশে বাস করে, তার সঙ্গে, তার নিকটজনের সঙ্গে, সর্বোপরি তার সিস্টেমের সঙ্গে একটি সহমর্মী, স্বচ্ছ ও বিশ্বস্ত সম্পর্ক তৈরি না হলে সে একাকীত্ব ও হতাশা বোধ করে। তার সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা হ্রাস পায়।

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ফলপ্রসূ যোগাযোগ স্থাপন স্নাতক প্রথমবর্ষ থেকেই শুরু করা ভালো। প্রথমবর্ষের একজন শিক্ষার্থীকে পাঁচটি বিষয়ে সহযোগিতা করা যেতে পারে। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয় তার জন্য কী সুযোগ-সুবিধা রেখেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে সাধারণ যেসব নিয়মকানুন মানতে হবে, তার পঠিত বিষয়ের পাঠ্যক্রম কী এবং সেই বিষয়ের ক্যারিয়ার কী হবে-এই চারটি বিষয়ে একজন শিক্ষার্থীকে পরিষ্কার ধারণা দিতে হবে। এর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে তার একটি ছোট্ট পরিচিত মহল গড়ে উঠতে তাকে সহযোগিতা করতে হবে। অতি সাধারণ এ বিষয়গুলো ক্লাস শুরুর প্রথম তিন মাসের মধ্যে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য নিশ্চিত করা গেলে তাদেরকে বিভাগের সঙ্গে শক্ত বন্ধনে আবদ্ধ করা সম্ভব হবে। এতে তাদের আত্মশক্তি বাড়বে এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সমস্যা মোকাবিলার দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। এ কাজটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষক, যেমন ছাত্র উপদেষ্টাদের মাধ্যমে সীমিত খরচে করা সম্ভব। নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে এই পাঁচটি বিষয়কে ছাত্র উপদেষ্টা বা কোর্স শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিলে তারাই সেই প্রাথমিক সেবাটি দিতে পারবে। এরপরও ১০ থেকে ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর পেশাদার কাউন্সেলিং প্রয়োজন হবে; তাদের জন্য চাহিদামাফিক মনোবজ্ঞানীর মাধ্যমে সেই সেবা প্রদান করতে হবে। এমন একটা উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে বড় আকারের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বছরে আনুমানিক ৬০ লাখ টাকা খরচ হতে পারে, যা জোগাড় করা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে খুব কঠিন হওয়ার কথা না। যথাযথভাবে এই সেবা দেওয়া গেলে শুধু প্রথম বছরে পুনঃভর্তি কমিয়ে অন্তত এক কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ব্যয় একটি লাভজনক ব্যয় হিসাবে বিবেচিত হবে।

ড. আজহারুল ইসলাম : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

azharulislam@du.ac.bd

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম