পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও হোক সংস্কার
ড. মো. তৌহিদুল ইসলাম
প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে যাওয়া, বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক ঋণে জর্জরিত বাংলাদেশ- এমনই এক ভঙ্গুর অর্থনীতির ওপর নির্ভর করে বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদ, নোবেলজয়ী অধ্যাপক সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণের সদয় সম্মতি জ্ঞাপন করার যে সাহসিকতা দেখিয়েছেন, তা নোবেলজয়ী জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী আইনস্টাইনও দেখাতে পারেননি।
আইনস্টাইনকে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। অভ্যাসগত দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা এবং বার্ধক্যের জন্য ৭৩ বছর বয়সের আইনস্টাইন অপারগতা প্রকাশ করলেও ৮৪ বছর বয়সের আমাদের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা অপারগতা প্রকাশ করেননি।
দেশে এখন চলছে সংস্কারের কাজ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও শুরু হোক সংস্কার। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উপাচার্য, উপ-উপাচার্য এবং ট্রেজারার নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আরও স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা আবশ্যক। এ ক্ষেত্রে সিনিয়র প্রফেসরদের মধ্য থেকে শিক্ষার সব স্তরে ভালো ফলাফলধারী, বিশ্বের নামিদামি কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি, পোস্ট ডক্টোরাল সম্পন্নকারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। তাছাড়া প্রার্থীদের গবেষণার প্রোফাইলও উচ্চ হতে হবে।
বিশ্বমানের জার্নালে পাবলিকেশন, গুগল স্কলার সাইটেশন এবং এইচ ইনডেক্সের উচ্চমাত্রা একজন গবেষকের লেভেলের ইন্ডিকেটর হিসাবে কাজ করে বিধায় এ বিষয়েও বিশেষ গুরুত্বারোপ করা জরুরি। পিএইচডি এবং পোস্ট ডক্টোরাল গবেষণা তত্ত্বাবধানের সংখ্যাটিও সংযোজিত হতে পারে। প্রশাসনিক বিভিন্ন দায়িত্ব যেমন ডিন, হলের প্রভোস্ট, প্রক্টর, ছাত্রবিষয়ক উপদেষ্টা কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেশনাল ইনস্টিটিটের পরিচালক-এসবের যে কোনো একটির অভিজ্ঞতা থাকাও জরুরি।
সর্বোপরি ছাত্র-শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টিকেও আমলে নেওয়া দরকার। উল্লিখিত যোগ্যতাসম্পন্ন একাধিক শিক্ষকদের মধ্য থেকে ছাত্র-শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য নিয়োগ প্রদান করা যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নের জন্য রঙের বিষয়টি যেমন সাদা, নীল, লাল, সোনালি, কালো ইত্যাদিকে গুরুত্ব না দেওয়াই ভালো। কেননা রং কেবল মানুষের মধ্যে প্রতিক্রিয়া বাড়ায় এবং বিভেদ তৈরি করে। মূলত পৃথিবীতে কোনো স্বাভাবিক মানুষই নিরপেক্ষ নয় এবং আশা করাও উচিত নয়। ব্যক্তি নয়, বরং কর্ম হতে হবে নিরপেক্ষ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কারের ক্ষেত্রে শিক্ষক নিয়োগে পুরোপুরি স্বচ্ছতা আনয়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। অধিকতর যোগ্য প্রার্থীকে শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় নিয়োগ প্রদানের জন্য বর্তমানে যে লেকচারার পদটি রয়েছে, সেটিকে আপগ্রেড করে সিনিয়র লেকচারার করার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা এখন সময়ের দাবি। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু হবে সপ্তম গ্রেড থেকে এবং নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা হবে পিএইচডি ডিগ্রি। যদি কোনো কারণে পিএইচডি ডিগ্রিধারী প্রার্থী পাওয়া না যায়, তাহলে মাস্টার্সসহ পাবলিক বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ডিগ্রি কলেজ কিংবা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে দুবছরের শিক্ষকতা বা গবেষণায় অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রার্থীদের বিষয়ে ভাবা যেতে পারে। এ পদের জন্য প্রবেশন পিরিয়ড হবে এক বছর এবং একই সঙ্গে তারা সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হবে। সহকারী অধ্যাপক থেকে পরবর্তী ধাপগুলোয় যেতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে যে নীতিমালা এবং গ্রেড রয়েছে, সেটিই অনুসরণ করার প্রস্তাব করা হলো। উল্লেখ্য, বর্তমানে যারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসাবে নিয়োজিত আছে, তারা দু’বছর পূর্তিতে সিনিয়র লেকচারার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হবেন এবং সব লেকচারার পদোন্নতিপ্রাপ্তির পর বর্তমান লেকচারার পদটি অবলুপ্ত করা যেতে পারে।
সিনিয়র লেকচারার নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের অগ্রাধিকার প্রদান এবং পূর্ববর্তী ফলাফলের জিপিএ শিথিল করা যেতে পারে। প্রস্তাবিত এ সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু হলে শিক্ষকদের পিএইচডিকালীন পূর্ণ বেতনে যে শিক্ষাছুটি প্রদান করা হয়, তা কমে গিয়ে বিশাল অঙ্কের অর্থ সাশ্রয় হবে এবং অধিকতর যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যাবে; তাছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণ বেতনে যে পাঁচ বছর শিক্ষাছুটি রয়েছে, তা কমিয়ে তিন বছর করা যাবে, যা একজন শিক্ষক মূলত গবেষণা যেমন পোস্ট ডক্টোরাল, রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, রিসার্চ ফেলো, সেমিনার, ওয়ার্কশপ ইত্যাদির জন্য উপভোগ করতে পারবেন। তবে এ শিক্ষাছুটি নন-পিএইচডি শিক্ষকরা পিএইচডি করার জন্যও উপভোগ করতে পারবেন। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে লিয়েনের সরকারি পরিপত্রটি আত্তীকরণ করা যেতে পারে। পিএইচডি বা পোস্ট ডক্টোরাল গবেষণার জন্য তিন বছরের বেশি সময় প্রয়োজন হলে তা লিয়েন থেকে নিতে পারবেন। বিদেশি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে চুক্তিভিত্তিক ফ্যাকাল্টি মেম্বার কিংবা দেশে-বিদেশে গবেষণা বা উন্নয়নমূলক কাজে চুক্তিবদ্ধ হলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত লিয়েন প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। যেহেতু লিয়েনের সঙ্গে সরকার বা প্রতিষ্ঠানের কোনো আর্থিক সংশ্লিষ্টতা নেই, সেহেতু তা প্রদানে বাধা থাকার কথা নয়।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বায়ত্তশাসিত বলা হলেও দু’চারটি ব্যতীত বাকিগুলো পুরোপুরি স্বায়ত্তশাসিত নয়, বরং কোনো কোনোটিকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে অভিহিত করা হয় এবং সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী এগুলো পরিচালিত হয়। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষাছুটি ভিসি-পরবর্তী চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়, যা অনভিপ্রেত। এতে প্রার্থীকে ফাইলের পেছনে দৌড়াতে গিয়ে বেশ কিছুটা সময়ও নষ্ট হয় এবং কখনো কখনো হয়রানির শিকারও হতে হয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য শিক্ষাছুটি কিংবা লিয়েন প্রদানের যাবতীয় ক্ষমতা উপাচার্যকে প্রদান করা হোক এবং তিনি নীতিমালা মোতাবেক এক সপ্তাহের মধ্যে প্রার্থীকে শিক্ষাছুটি বা লিয়েন প্রদান করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরি থেকে অবসরের বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে। সর্বশেষ জাতীয় বেতন স্কেলের পরিপত্র মোতাবেক সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে কমপক্ষে ২৫ বছর চাকরি সমাপনান্তে অবসরে যেতে হবে, অন্যথায় পেনশন সুবিধা পাওয়া যাবে না। উল্লেখ্য, ইতঃপূর্বে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বেচ্ছায় অবসরগ্রহণের ন্যূনতম সময় ছিল ১০ বছর। সুতরাং, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের স্বেচ্ছায় অবসরের সময়সীমা ১০ বছর বা সর্বোচ্চ ১৫ বছর করা হোক, যাতে তারা ওই সময়সীমার মধ্যে স্বেচ্ছায় অবসর নিলেও আনুপাতিক হারে পেনশন সুবিধা পেতে পারেন। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতিটি ধাপেই নিয়োগের সুযোগ রয়েছে, সেহেতু এ বিধান আবারও কার্যকর হলেও শূন্যস্থান পূরণে কোনো সমস্যা হবে না। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক দৈন্যদশার কথা বিবেচনা করে প্রস্তাবিত সংস্কারের কোনো স্থানেই ব্যয় বৃদ্ধির আশঙ্কা নেই, বরং শিক্ষাছুটি কমিয়ে অর্থ সাশ্রয়ের বিষয় উল্লেখ রয়েছে বিধায় প্রস্তাবনাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা যেতে পারে।
ড. মো. তৌহিদুল ইসলাম : সহযোগী অধ্যাপক, কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন স্কুল, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
islamtuhin@yahoo.com