এসব ক্ষেত্রে কি পরিবর্তন আসবে না?
গাজী মিজানুর রহমান
প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
যখন কোনো একটি জনকল্যাণমুখী কাজ করতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তখনই একটা না একটা অজুহাত এসে হাজির হয়। সড়কের ওপর ভ্যান রেখে শাকসবজি বিক্রেতারা রাস্তার অর্ধেকটা দখল করে চলাচলের অনুপযোগী করে ফেলছে। তাদের সরিয়ে দিতে গেলে বলা হয়, এভাবে একজন নিম্নবিত্ত মানুষ নিজের সংসার চালায়, উঠিয়ে দিলে তার বেঁচে থাকার পথে অন্তরায় সৃষ্টি হবে। রাজধানী থেকে রিকশা সরাতে গেলে একই অজুহাত। ফুটপাতে যেসব হকার বসে, তাদের জন্য অন্যত্র মার্কেট বানিয়ে দিয়ে তাদের সরে যেতে বললে তারা যায় না। তাদের পক্ষে কথা বলেন যারা, তাদের যুক্তি-মানবিক কারণে ওদের থাকতে দেওয়া দরকার। মানবিক কারণকে মানবিকতা দিয়ে মোকাবিলা করাই শ্রেয়। ভ্যানে করে তরকারি বিক্রি করে বা ফুটপাতে হকারি করে সংসার চালায় যারা, তাদের অভাব মোকাবিলার জন্য ন্যায়সংগতভাবে তাদের কর্মসংস্থান হোক-এটা সবার কাম্য। কিন্তু জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে নয়। নিয়মশৃঙ্খলার ব্যত্যয় ঘটিয়ে তাদের অভাব মোচন করার দায় সমাজের কাঁধে না চাপিয়ে অন্য কিছু ভাবতে হবে।
ভ্যানযোগে সড়কের ওপর যেভাবে তরিতরকারি বিক্রি করা হয়, তাতে বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ঢাকা শহরে নিত্যপণ্য কেনাবেচার জন্য বাজার রয়েছে। সেখানে ব্যবসা করার জন্য যারা বসে, মহল্লায় মহল্লায় ভ্যানে পণ্য বিক্রির কারণে বাজারে তাদের মালামাল বিক্রি কম হয়। বেশি পণ্য বিক্রি করতে পারলে বাজারের দোকানদাররা চাতাল ভাড়া, পরিবহণ ব্যয় ইত্যাদি পুষিয়ে নিয়ে একটা মার্জিনাল লাভ করলেই তাদের অসুবিধা হতো না। কিন্তু ভ্যানে ভ্যানে মহল্লার রাস্তায় মালামাল বিক্রির ফলে বাজারের দোকানদারদের পণ্য বিক্রি কমে যাওয়ার কারণে তাদের লাভের মার্জিন বড় করতে হয়। অন্যদিকে ভ্যানের বিক্রেতাদের অল্প পুঁজিতে অল্প পণ্য বিক্রি করতে হয় বলে তারা বেশি দামে তরকারি বিক্রি করে। বেশি দাম সত্ত্বেও মানুষ তাদের কাছ থেকে তরকারি কেনে এজন্য যে, হাতের কাছে প্রয়োজনীয় পণ্য পায়। হেঁটে বাজারে যাওয়ার ‘ঝক্কি’ থেকে রেহাই পেতে তারা বেশি দামে পণ্য কেনে। এভাবে দ্রব্যমূল্য উভয় স্থানে বেড়ে যায় আর সাধারণ ক্রেতারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মহল্লায় মহল্লায় ভ্যানের ওপর পণ্য রেখে যারা ব্যবসা করে, তারা সড়ক আটকে অবৈধ ব্যবসা করে বলে কাউকে না কাউকে চাঁদা দেয়। এ চাঁদা তাকে পণ্যের দাম বাড়িয়ে পোষাতে হয়। ভ্যানগুলো গাড়ি চলাচলে ও পথচারীদের যাতায়াতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং সেই সঙ্গে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করতে উৎসাহিত করে। এভাবে দুদিক থেকে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একদিকে সড়কের একাধিক স্থানে ভ্যান রেখে পণ্য বিক্রির ফলে সড়কগুলোয় যান চলাচল ব্যাহত হয়, যানজটে গাড়ির ফুয়েল বেশি পুড়ে; অন্যদিকে মানুষ ফুটপাত সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে না, কারণ বেচাকেনার জন্য জটলা সৃষ্টি হয়ে যায়। এসবের ফলাফল কোনো পক্ষের জন্যই মঙ্গলজনক নয়।
যারা ঢাকায় এসে এ ধরনের ক্ষুদ্র ব্যবসা করে বেঁচে থাকে, তারাও যে খুব ভালো আছে তা নয়। একজন রিকশাওয়ালা বা হকার মাসে ১৫-২০ হাজার টাকার বেশি আয় করতে পারে না। এ দিয়ে কোনোরকমে একটা থাকার জায়গা করে ডালভাত খেয়ে বেঁচে থাকে তারা। অথচ তারা গ্রামে থাকলে কৃষিকাজ বা অন্য কোনো কাজ করতে পারত। সেখানে খুব যে খারাপ থাকত, তা নয়। তবু ঢাকায় পড়ে থাকে এজন্য যে, রাজধানীতে থাকা একটা মোহ। ঢাকার বড় বড় সড়ক, সুদৃশ্য মার্কেট, চোখ ধাঁধানো বাড়িঘরের সান্নিধ্য-এসব থেকে ওরা মেকি শান্তি পায়। রাজা-উজির মারার গল্প শুনে তৃপ্তি পায়। ঢাকা মানেই তো দেশের ইতিহাস। ওরা ইতিহাসের অংশ হতে চায়।
এ সবই বাস্তবতা, তবু আমাদের কারও পক্ষে কিছু করা খুবই কঠিন। একটা রিকশা নামিয়ে মালিক দৈনিক ১২০ টাকা আয় করে। ইঞ্জিনযুক্ত করার ফলে এখন ৪৫০ টাকা পায়। আগে রিকশা চালাতে চালকদের কষ্ট হতো, কঠোর পরিশ্রমী লোক ছাড়া রিকশা চালাতে আসত না। এখন রিকশায় ইঞ্জিন লাগানোর পর মালিকের আয় বেড়ে যাওয়ায় নতুন নতুন রিকশা নামানো হচ্ছে। চালাতে পরিশ্রম নেই দেখে অধিকসংখ্যক যুবক এগুলো ভাড়া নিয়ে চালাচ্ছে। ফলে প্রয়োজনের তুলনায় রিকশা অনেক বেড়ে গেছে। যাত্রী থাকে দিনের বিশেষ বিশেষ সময়ে। অন্য সময় যাত্রীর আশায় খালি রিকশা নিয়ে চালকরা রাস্তা প্রদক্ষিণ করে বেড়ায়। এতে সড়কের ওপর চাপ বাড়ে। আবার যারা ভ্যানে করে তরকারি বিক্রি করে, সড়ক থেকে তাদের সরাতে গেলে যারা চাঁদা পায় তারা এসে মানবতার কথা বলে বাধা দেয়। আসল কথা মাসিক বন্দোবস্ত হাতছাড়া হওয়ার ভয়।
এই যে দুষ্টচক্র, এটা ভাঙতে বড়সড়ো ঝাঁকুনি দেওয়া দরকার। সে ঝাঁকুনি রাজনৈতিক সরকার দিতে চায় না, কারণ মধ্যস্বত্বভোগীরা দলেরই লোক। ওরা পরিবর্তনে বাধা দেয়। এখন যে নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকার, নিম্ন পর্যায়ে তার কর্মী বাহিনী না থাকায় বাধা এলে বাধা অপসারণের জন্য তাদের পক্ষে সম্মিলিত হাতের সংখ্যা কম। তাহলে স্থিতাবস্থাই একমাত্র ভরসা-যা আছে তার চেয়ে যেন খারাপ না হয়! কিন্তু এরও তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। কোনো কিছু ভালো হয় একটু একটু করে; কিন্তু খারাপ হতে একদিন বা এক রাতের ব্যাপার মাত্র। তাহলে ভরসা কীসে? নিয়তিই একমাত্র ভরসা। যদি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভালো কিছু ঘটে যায়? সেই ভালো রোধ করার ক্ষমতা কারও নেই, এই যা আশার কথা।
গাজী মিজানুর রহমান : সাবেক যুগ্ম সচিব ও প্রবন্ধকার