Logo
Logo
×

বাতায়ন

বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই

Icon

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই

সম্প্রতি প্রকাশিত অর্থনৈতিক অবস্থার শ্বেতপত্রে দেশের আর্থিক খাতের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, গত ১৫ বছরে দেশ থেকে অবৈধ উপায়ে ২৮ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। কদর্য পন্থায় ঋণ প্রদান এবং খেলাপির আড়ালে ব্যাংক ব্যবস্থাসহ আর্থিক খাতের চরম অব্যবস্থাপনা অর্থনীতিকে প্রায় পঙ্গু করে ফেলেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতিতে আর্থসামাজিক পরিস্থিতি নাজুক অবস্থায় নিপতিত হয়। বিগত সরকারের আমলে নানামুখী উন্নয়নের গালগল্পের মাঝে সরকারি সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে প্রকৃত চিত্র উঠে আসেনি। মিথ্যার বেসাতি মূলত বাজার ব্যবস্থার আরও ক্ষতি করেছে। সচেতন জনগণ সম্যক উপলব্ধি করতে পারলেও দমন-পীড়নের ভয়ে তা প্রকাশ করতে অপারগ ছিল। বিভিন্ন গবেষণা-লেখনীতে দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ব্যবসায়ী-আমলাদের কারসাজির অনেক তথ্য উঠে এসেছে। মানুষের ক্ষোভ-যন্ত্রণা যে গণরোষের দিকে ধাবিত হচ্ছে, সে সম্পর্কে অনেকে সতর্ক করেছেন; কিন্তু অর্থ ও ক্ষমতার লোভ শাসকগোষ্ঠীকে এসব আমলে নিতে ন্যূনতম তাগিদ দেয়নি। ফলস্বরূপ, ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। ফ্যাসিস্ট তকমা নিয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে হয় সরকারপ্রধান শেখ হাসিনাকে।

অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে রাষ্ট্র মেরামতের উদ্দেশ্যে যাবতীয় সংস্কারের বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার ফলে অনেক অজানা বা লুকায়িত তথ্য-উপাত্ত-পরিসংখ্যান জনসম্মুখে উন্মোচিত হচ্ছে। যতটুকু ধারণা করা হয়েছিল, তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি দুর্নীতি-লুটপাটের চিত্র উঠে এসেছে। সেতু, জ্বালানি-অবকাঠামো ও অন্যান্য খাতে মেগা প্রকল্প গ্রহণের পেছনে ভয়াবহ দুর্নীতির তথ্য জনগণ অবগত হচ্ছে। বিভিন্ন এক্সপ্রেসওয়ে-টানেল নির্মাণ, বন্দর উন্নয়ন ইত্যাদি লুটপাটের উদ্দেশ্যেই করা হয়েছিল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ধারাবাহিকতায় বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্রমাবনতি লক্ষণীয়। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের নামে যা কিছু হয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা অন্তঃসারশূন্য বলে প্রতীয়মান।

গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা যায়, দীর্ঘ সময় ধরে বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ছিল হতাশাব্যঞ্জক। বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জিডিপির বিপরীতে বাংলাদেশ অনেক রাষ্ট্র থেকে পিছিয়ে ছিল। ২০২৩ সালে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল ৩ বিলিয়ন ডলার। যদিও বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জিডিপির বিপরীতে বাংলাদেশে এ বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ দেড় শতাংশেরও কম। অথচ বিগত সময়ে চরম অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সংকটে দেউলিয়া হওয়া শ্রীলংকায় বিদেশি বিনিয়োগ জিডিপির ২০ শতাংশেরও বেশি। বিনিয়োগকারীদের আয় ফেরত আনার ভোগান্তি, অস্থিতিশীল বৈদেশিক মুদ্রা পরিস্থিতি এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে আগের বছরের তুলনায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে নেট বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে নেট বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে ১ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার; ২০২২-২০২৩ অর্থবছর শেষে যা ছিল ১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ১৪২ মিলিয়ন ডলার।

এ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ আসা পোশাক ও বস্ত্র খাতেও গত অর্থবছরে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ১৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। ওই সময়ে খাতটিতে বৈদেশিক বিনিয়োগ এসেছে ৪৪ কোটি ডলার। এরপর ব্যাংক খাতে ২৩ কোটি, রাসায়নিক ও ওষুধ শিল্পে ১২ কোটি, গ্যাস ও পেট্রোলিয়ামে ১২ কোটি, টেলিকমিউনিকেশনে ১০ কোটি, কৃষি ও মৎস্য আহরণে ৬ কোটি এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যে ৫ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। তন্মধ্যে রাসায়নিক ও ওষুধ, কৃষি ও মৎস্য আহরণ ছাড়া প্রায় সব খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আগের অর্থবছরের তুলনায় কমেছে। তাছাড়া সামগ্রিকভাবে এফডিআই কমে যাওয়ায় কমেছে নতুন বিনিয়োগ (ইক্যুইটি) ও পুনর্বিনিয়োগও। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট ১৪৬ কোটি ডলারের বিনিয়োগের মধ্যে ৪৫ শতাংশ বা ৬৭ কোটি ডলার হচ্ছে নতুন বিনিয়োগ। নতুন বিনিয়োগ আসার হারও গত দুই অর্থবছর ধরেই কমছে। পক্ষান্তরে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৭৯ কোটি ডলারের পুনর্বিনিয়োগের বিপরীতে গত অর্থবছরে পুনর্বিনিয়োগ হয়েছে ৬১ কোটি ডলার।

যে কোনো দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে এবং সংকট উত্তরণে বৈদেশিক বিনিয়োগের অবদান সমধিক। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৮০-এর দশকে লাতিন আমেরিকান আর্থিক সংকট, ১৯৯৪-৯৫ সালের মেক্সিকান সংকট, ১৯৯৭-৯৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকট এবং কোভিড-১৯ মহামারি-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে বৈদেশিক বিনিয়োগের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। বিভিন্ন অভিজ্ঞতালব্ধ গবেষণামতে, বৈদেশিক বিনিয়োগ একটি দেশের মোট বিনিয়োগ ও দক্ষতা বৃদ্ধি, রপ্তানি উদারীকরণ এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করে থাকে। এটি দেশের পুঁজি অর্জন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং মানুষের সক্ষমতা-দক্ষতা বিকাশে ব্যাপকভাবে সহায়ক। তাই বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে বিশ্বের বহু দেশের মধ্যে একে অপরের মধ্যে প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায়। বিগত কয়েক বছরে বৈশ্বিক বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ হ্রাস পাওয়ার ফলে এর মাত্রা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, উচ্চ খাদ্য-জ্বালানি মূল্য ও ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধির কারণে বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগের পরিমাণ ১২ শতাংশ কমে ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলারে উপনীত হয়। ২০২৩ সালে তা ২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা ও মন্থর বিশ্ব অর্থনীতির কারণে। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বিদেশি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে বেশিরভাগ দেশই নতুন করে তাদের জাতীয় নীতি প্রণয়ন করছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের চার মাসের অধিককাল অতিবাহিত হয়েছে। স্বল্প সময়ের মধ্যে দুর্দশাগ্রস্ত এ অবস্থানের দ্রুত পরিবর্তন সম্ভব নয়। এরই মধ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির সুযোগে শিল্পাঞ্চলগুলোয়, বিশেষ করে গার্মেন্ট শিল্পে অরাজকতা আস্থার চরম সংকট তৈরি করেছে। বিগত সেপ্টেম্বর মাসের শুরু থেকেই পোশাক কারখানা অধ্যুষিত এলাকায় শ্রমিক অসন্তোষের কারণে অসংখ্য কারখানার উৎপাদন ও বিপণন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। বহু কারখানা ভাঙচুরের পাশাপাশি দেওয়া হয় আগুন। ফলে কঠিন হুমকির মুখোমুখি দেশের পোশাক খাত। পোশাক খাতসংশ্লিষ্টদের অভিমত, ইতোমধ্যেই এ শিল্পে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। অবিলম্বে শিল্পাঞ্চলে এ শ্রমিক অসন্তোষের অবসান না ঘটলে দেশের রপ্তানি ও বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। শ্রমিক অসন্তোষের পাশাপাশি তীব্র জ্বালানি সংকটে নিপতিত অধিকাংশ কারখানা। কারখানা মালিকদের দাবি, বেশি দামে গ্যাসের মূল্য পরিশোধ করেও তারা চাহিদার মাত্র ৩০ শতাংশ গ্যাস পাচ্ছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনেক বিনিয়োগ পাইপলাইনে থাকলেও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অনেকেই বাংলাদেশে এ মুহূর্তে বিনিয়োগবিমুখ হতে পারেন বলে সতর্ক করেছেন অনেক বিশ্লেষক।

অনেক অর্থনীতিবিদের ভাষ্য হলো, দেশের বৈদেশিক বিনিয়োগ পরিস্থিতি বর্তমানে খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। এটি স্বাভাবিক হওয়া অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার; বিশেষ করে দেশে যখন শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতা চলমান। অনেক কারখানা ইতোমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। এর রেশ ছড়িয়ে পড়েছে ওষুধ, চামড়া ও অন্যান্য খাতেও। ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিশ্চিত পরিবেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আগ্রহী হন না। বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং হ্রাসের প্রভাবও বিদেশি বিনিয়োগ ও অন্যান্য ক্ষেত্রে পড়ছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নেতিবাচক খবরে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা প্রভাবিত হচ্ছেন। ইতিবাচক দিক হলো বর্তমান সরকারের প্রতি পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থন। সরকারকে ওইসব দেশের বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করতে হলে অবশ্যই পরিবেশকে দ্রুত স্থিতিশীলতার দিকে নিতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে আগামী দিনে দেশে খুব একটা বিনিয়োগ না-ও আসতে পারে। অদূরভবিষ্যতে কমতে পারে ভারতীয় বিনিয়োগও। সেজন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। কারণ যখন কোনো দেশে বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস পায়, তখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এর নেতিবচাক দৃশপট তৈরি হয়।

সামগ্রিক পর্যালোচনায় এটি স্পষ্ট যে, যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থাভাজন করা এবং বিনিয়োগে উৎসাহিত করার প্রচেষ্টা একান্ত জরুরি। এক্ষেত্রে একটি আশাজাগানিয়া বিষয় হচ্ছে, বিশ্বের অনেক দেশ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করার পাশাপাশি বিনিয়োগেরও আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সরকারও বৈদেশিক বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে বিনিয়োগকারীদের নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করছে। বিশেষত অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্র্ক এবং ওয়ানস্টপ ডিজিটাল সার্ভিস সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টারই ফসল। তাছাড়া বিনিয়োগকারীদের জন্য সরকার বিভিন্ন রাজস্ব ও অ-আর্থিক প্রণোদনা প্রদান, করপোরেট আয়কর ছাড়/কমানো, মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের ওপর আমদানি কর হ্রাস, ভ্যাট হ্রাস, রপ্তানি ভর্তুকি প্রদান, বিভিন্ন ব্যাংকিং সুবিধা এবং বিশেষাধিকারের ব্যবস্থা করেছে।

এদেশে বিপুলসংখ্যক বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের বিকল্প নেই। বিনিয়োগকারীদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে, বিদেশে অবস্থানরত দূতাবাসগুলোকে সক্রিয় করে বিনিয়োগের নতুন নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কার করা গেলে তা অবশ্যই সংকট উত্তরণে সহায়ক হবে।

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম