Logo
Logo
×

বাতায়ন

অসষ্ণিুতা ও গুজবের প্রকোপ

Icon

মো. মুজিবুর রহমান

প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অসষ্ণিুতা ও গুজবের প্রকোপ

ছবি: সংগৃহীত

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এবং সরকারের দৈনন্দিন ও নির্বাচনমুখী কার্যক্রমকে প্রশ্নের মুখে ফেলতে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন মহল নানা ধরনের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কার কার্যক্রম যাতে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা না যায় এবং সরকার যাতে নির্বিঘ্নে একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে না পারে, এ উদ্দেশ্যে নানামুখী তৎপরতা চোখে পড়ার মতো। বিভিন্ন মহলের এসব তৎপরতাকে অপতৎপরতা হিসাবেই বর্ণনা করা বোধকরি বেশি যুক্তিযুক্ত হবে। কারণ যখন কোনো তৎপরতা দেশের জনগণের বিরুদ্ধে চলে যায়, যখন এসবের প্রতি সাধারণ মানুষের কোনো সমর্থন থাকে না, তখন তাকে অপতৎপরতা ছাড়া আর কী বলা যায়? যারা এসব অপতৎপরতা নিয়ে দিবানিশি মাথা ঘামাচ্ছেন এবং যারা এসব নিয়ে নিজেদের নিদ্রা ত্যাগ করে সবসময় অঘটন ঘটানোর চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছেন, তারা হয়তো ধরেই নিয়েছেন, তাদের এ অপতৎপরতার বিষয়টি দেশের জনগণ বুঝতে পারছে না। কিন্তু তাদের এ ধরনের অপতৎপরতা যে কত বড় বিভ্রম, তারা নিজেরাও সেটা অনুধাবন করতে পারছেন বলে মনে হয় না। গত ৫ আগস্টের পর থেকে দেশে কয়েকশ আন্দোলন-অবরোধ হয়েছে এবং এখনো এ ধরনের নানামুখী ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে খুবই তুচ্ছ কারণে সড়কপথ, রেলপথ অবরোধ করার মতো ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। এর সবকিছুই যে হচ্ছে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে, সেটিও জনগণ বুঝতে পারছে।

কিছুদিন আগে (৬ ডিসেম্বর বিকালে) রাজধানীর খিলগাঁওয়ের তিলপাপাড়া এলাকায় একদল যুবকের ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া জামালপুরগামী যমুনা এক্সপ্রেস ট্রেন লক্ষ্য করে পাথর নিক্ষেপ করার খবর বেরিয়েছে। এতে ট্রেনের কিছু যাত্রী মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন। খবরে জানা যায়, ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনার প্রায় এক সপ্তাহ আগে ওই এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় একজনের আহত হওয়াকে কেন্দ্র করে দায়েরকৃত মামলায় গ্রেফতারকৃত এক আসামিকে জামিনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এরই প্রতিবাদে নাকি ওই যুবকরা ক্ষুব্ধ হয়ে ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ করে যাত্রীদের আহত করেছে! কী অদ্ভুত দাবি এবং কী হঠকারী প্রতিবাদ!

কোনো আসামিকে জামিন দেওয়া বা না দেওয়ার বিষয়টি যেখানে সম্পূর্ণরূপে আদালতের এখতিয়ারভুক্ত, সেখানে দুর্ঘটনায় একজন আহত হওয়ার মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জামিনে ছেড়ে দেওয়ার প্রতিবাদে কোনোরূপ পূর্বাপর না ভেবে ট্রেনে আক্রমণ করা হয়েছে। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে একদিকে জামিন দেওয়ার ক্ষেত্রে আদালতের এখতিয়ারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টার, অন্যদিকে তাদের নিজেদের সংঘবদ্ধভাবে বেআইনি কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়ার প্রমাণও পাওয়া যায়। এটি একটি ছোট পরিসরের ঘটনা হলেও এর মাধ্যমে রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির দিকটি প্রমাণের এক হীন চেষ্টা ছিল বললে বাড়িয়ে বলা হয় না। এমন ঘটনা যে শুধু এই একটিই ঘটেছে তা নয়, পত্রপত্রিকায় নজর রাখলে এ ধরনের তুচ্ছ আরও অনেক ঘটনা ঘটার খবর জানা যায়, যা নিয়মিতই ঘটছে। এসব ঘটনার মাধ্যমে কিছু মানুষের মধ্যে অসহিষ্ণুতার প্রকাশ লক্ষ করা যায়; যা রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অনুকূলে নয় মোটেই। প্রকারান্তরে এসব ছোট ছোট ঘটনার মধ্য দিয়ে যে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর চেষ্টা থাকে, তা নতুন করে বলার দরকার পড়ে না। এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে গুজব ছড়ানোর বিষয়টি জড়িত থাকে স্বাভাবিকভাবেই।

আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, দেশে প্রতিনিয়ত বহুমুখী অসহিষ্ণু ঘটনা ঘটানোর পাশাপাশি নানা ধরনের গুজব ও অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে অত্যন্ত সুকৌশলে। এগুলো যে শুধু দেশের অভ্যন্তরেই ঘটছে, তা নয়। বরং গণমাধ্যমে খবর বের হয়েছে, বাংলাদেশ নিয়ে দেশের বাইরে থেকে বিভিন্ন ধরনের ভুয়া খবর ও গুজব ছড়ানো হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তথ্য যাচাই সংস্থা রিউমার স্ক্যানারের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যম বাংলাদেশ নিয়ে ভুয়া খবর ও গুজব ছড়িয়েছে বলে দেশের প্রচারমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। এ নিয়ে যুগান্তরের প্রথম পাতায় প্রকাশিত এক খবরের শিরোনাম ছিল, ‘রিউমার স্ক্যানারের অনুসন্ধান : বাংলাদেশ নিয়ে ভুয়া খবরের ছড়াছড়ি ভারতীয় গণমাধ্যমে’ (০৭.১২.২০২৪)। রিউমার স্ক্যানারের বরাত দিয়ে যুগান্তরের ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ভুল তথ্য ছড়িয়ে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। দেশটির গণমাধ্যম বাংলাদেশবিরোধী একের পর এক ভুয়া খবর প্রচার করছে।’ এমন ভুয়া খবর প্রচারের তালিকায় ভারতের অন্তত ৪৯টি গণমাধ্যমের নাম উঠে এসেছে তথ্য যাচাইকারী ওই সংস্থার এক প্রতিবেদনে। বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত রিউমার স্ক্যানারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১২ আগস্ট থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতের এসব গণমাধ্যমে অন্তত ১৩টি ভুয়া খবর প্রকাশিত হয়েছে। দেশ কিংবা বিদেশ যেখান থেকেই ভুয়া খবর ছড়ানো হোক না কেন, দেশকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই যে এসব করা হয়, সেটা না বোঝার কোনো কারণ নেই। কিন্তু যেসব গোষ্ঠী, সংস্থা বা গণমাধ্যম ভুয়া খবর ছড়ায়, তারা যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জেনেশুনেই এমনটি করে, তা স্পষ্ট। এসব খবর যতই গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হোক না কেন, এগুলোর সত্যতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন থেকেই যায়। আর জনগণের কাছে একবার কোনো খবর অসত্য বা ভুয়া বলে প্রতিপন্ন হলে পরবর্তীকালে ওই প্রচারমাধ্যমের প্রতি তাদের আর আস্থা ও বিশ্বাস থাকে না। ভুয়া তথ্য ও গুজব ছড়ানোই প্রচারমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাসের অন্যতম কারণ। পরিতাপের বিষয় হলো, দেশে হোক কিংবা বিদেশে, এ অমোঘ সত্যটি ভুয়া খবর প্রচারকারী গণমাধ্যম অনুধাবন করতে পারে বলে মনে হয় না।

এদিকে আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে শনিবারও স্কুল খোলা থাকবে মর্মে গত কয়েকদিন আগে হঠাৎ করেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়ে। পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর জানিয়েছে, স্কুল খোলা রাখার বিষয়ে ছড়িয়ে পড়া তথ্যটি সঠিক নয়। এ প্রসঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, ‘শনিবার স্কুল খোলা থাকবে এমন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। নতুন কোনো সিদ্ধান্ত হলে তা সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হবে।’ একইসঙ্গে গুজবে কান না দেওয়ার অনুরোধও জানানো হয়েছে। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কে বা কারা এ ধরনের গুজব ছড়িয়ে দিল, সেটা খুঁজে বের করা দরকার। কারণ বর্তমানে শনিবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকছে। তাই আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে শনিবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা নিয়ে সিদ্ধান্তের সঙ্গে দেশের হাজার হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, লাখ লাখ শিক্ষার্থী ও অভিভাবক এবং বিপুলসংখ্যক শিক্ষকের আবেগের বিষয়টি জড়িত। মানুষের এ আবেগকে পুঁজি করে গুজব ছড়ানোর মাধ্যমে সরকারের প্রতি বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি করা যে কোনো মহলের বিশেষ উদ্দেশ্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ধরনের অপতথ্য ও গুজব ছড়ানোর ঘটনা বিচ্ছিন্ন হলেও এর মাধ্যমে যে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে জনমনোভাব উসকে দেওয়ার একটি হীন প্রবণতা রয়েছে, সেটাও নতুন করে বলার দরকার পড়ে না।

দেখা যাচ্ছে, আজকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অবাধ ব্যবহারের সুযোগে ভুয়া তথ্য ও গুজব খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। কোনো খবরের সত্যতা যাচাই না করে অনেকেই ওই খবরের পেছনে ছুটে চলে একরকম দুর্বার গতিতে। ফেসবুকে কে কার আগে ওই খবরটি শেয়ার করবে, তার এক প্রকাশ্য প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। তবে কোনো খবর ভুয়া নাকি সত্য, সাধারণ মানুষের পক্ষে তা যাচাই করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে সচেতন হতে হবে। যে কোনো খবর যতই চটকদার হোক না কেন, সেটি বিশ্বাসযোগ্য কিনা তা নিয়ে ভাবতে হবে গুরুত্বের সঙ্গে। এছাড়া কোনো তথ্য দেখলেই তা দ্রুত শেয়ার করার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সরকারকেও এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে দ্রুত। বিশেষ করে ভুয়া ও অসত্য খবর এবং গুজব ছড়ানোর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই।

মো. মুজিবুর রহমান : অধ্যাপক (শিক্ষা) ও সাবেক অধ্যক্ষ, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ

mujibur29@gmail.com

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম