Logo
Logo
×

বাতায়ন

মাধ্যমিক পাঠক্রমে কোডিং ও এআই প্রযুক্তির প্রাসঙ্গিকতা

Icon

মো. হাসান-উল-বারী

প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মাধ্যমিক পাঠক্রমে কোডিং ও এআই প্রযুক্তির প্রাসঙ্গিকতা

প্রযুক্তির দুনিয়ায় বর্তমানে চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। শুধু চর্চা নয়, বেড়েছে ব্যবহারও। মানবসভ্যতার উন্নয়নে এ প্রযুক্তি কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তা নিয়ে চলছে গবেষণা। আর সেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তারই প্রবেশ ঘটেছে শিক্ষা ক্ষেত্রেও। সেটা ভালো হবে কী মন্দ হবে, তা নিয়ে চলছে অনেক বিতর্ক। তবুও এটি নির্দ্বিধায় বলা যায়, তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর একটি বিশ্ব আমাদের তৈরি হবে। আর সেই বিশ্বে পদচারণা করবে আজকের দিনের নতুন প্রজন্ম; আপনার আমার সন্তানরা। সেই বিশ্বে আমাদের সন্তানরা কেমন করবে, তা অনেকখানিই নির্ভর করবে তাদের ‘ডিজিটাল প্রযুক্তি জ্ঞানের উপর’। তাই বর্তমান বিশ্বের অভিভাবকরা চাচ্ছেন তাদের সন্তানরা যেন শৈশব থেকেই ডিজিটাল প্রযুক্তির ওপর বেসিক কিছু জ্ঞান অর্জন করে।

আজকের দিনে মানুষ বেশিরভাগ সময় মোবাইল এবং কম্পিউটার ব্যবহার করে, কম্পিউটার ও মোবাইলের মধ্যে অ্যাপ্লিকেশন এবং ওয়েবসাইট ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু কীভাবে এ অ্যাপ্লিকেশন এবং ওয়েবসাইটগুলো তৈরি হয় তা অনেকেরই অজানা। তাই আপনাদের জানিয়ে রাখি, এসব কিছু কোডিংয়ের সাহায্যে তৈরি করা হয়ে থাকে। কিন্তু কোডিং সম্পর্কে অনেকের ধারণা খুবই কম।

কম্পিউটার কোডিং হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যার সাহায্যে কম্পিউটারের প্রোগ্রামগুলো ডিজাইন করা হয়। কম্পিউটারে যেসব অপারেশন করা হয়, সেগুলো কম্পিউটার কোডিংয়ের মাধ্যমে বুঝতে পারে। এর কারণ কম্পিউটার শুধু কোডিং ভাষা বোঝে। আমরা যদি কম্পিউটারকে দিয়ে কোনো কাজ করাতে চাই, তাহলে কোডিংয়ের মাধ্যমে কম্পিউটারকে সেটি জানাতে হবে। আজকের দিনে আধুনিক কম্পিউটার, ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, সফটওয়্যার, গেমস, অটোমেশন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স, মেশিন লার্নিং, ওয়েবসাইট, অ্যাপস- সবকিছুর মধ্যেই কোডিং ব্যবহার করা হয়। কোডিংয়ের সাহায্যে নির্দিষ্ট একটি প্রোগ্রাম তৈরি করা হয় এবং এ প্রোগ্রামগুলোর সাহায্যে কম্পিউটার নির্দিষ্ট কাজগুলো সম্পন্ন করে থাকে।

কোডিং কেন শিখতে হবে, তার অনেক কারণ আছে, যার কয়েকটি উল্লেখ করা হলো-১. কোডিং সমস্যা-সমাধানে দক্ষ করে তোলে; ২. চিন্তা করতে শেখায়; ৩. একাডেমিক কর্মক্ষমতা উন্নত করে; ৪. সৃজনশীলতা বাড়ায়; ৫. ভালো কম্পিউটার প্রোগ্রামার হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়; ৬. সফটওয়্যার শিল্পে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হয়; ৭. শিশুদের গণিত শেখা আনন্দদায়ক করে তুলে; ৮. শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করে; ৯. এটি শিখলে পরবর্তী সময়ে কর্মজীবনে দক্ষতার নতুন মাত্রা যোগ করা যায়; ১০. এটি শিখলে পেশাদারদের কাজগুলোও করা যায়, ফলে কাজের দক্ষতা উন্নত হয়।

বিশ্বে ৭০০টিরও বেশি প্রোগ্রামিং ভাষা রয়েছে, যেগুলো বিভিন্ন প্রযুক্তির জন্য তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে জনপ্রিয় কিছু প্রোগ্রামিং ভাষা হলো : C, C++, Java, Python, JavaScript, R, go, Ruby, HTML, CSS, PHP, MYSQL, .NET ইত্যাদি। তবে কোডিং শেখার জন্য, প্রথমে সহজ ও বহুমুখী ভাষা দিয়ে শুরু করা ভালো।

অন্যদিকে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) হলো, মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তাশক্তিকে কম্পিউটারের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা। এটি বিজ্ঞানের জগতে এক অনন্য আবিষ্কার। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে, যন্ত্র বা অ্যাপ্লিকেশনকে মানুষের বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তির আদলে কাজের উপযোগী করা যায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন আমেরিকান কম্পিউটার বিজ্ঞানী জন ম্যাকার্থি। এজন্য তাকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জনক বলা হয়। তারও আগে ১৯৫০ সালে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ অ্যালান টুরিং কোনো যন্ত্রের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যাচাই করার জন্য একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেন, যা ‘টুরিং টেস্ট’ নামে পরিচিত। বলা যায়, বর্তমান পৃথিবীতে এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ নেই। তবে উল্লেখযোগ্য কিছু ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে শিক্ষা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, শিল্প-কলকারখানা, রেস্টুরেন্ট ব্যবসা, যুদ্ধক্ষেত্র, কৃষিকাজ, পণ্য পরিবহণ, দৈহিক শ্রম, চালকবিহীন বিমান বা গাড়ি চালানো, কোডিং লেখা ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে মাইক্রোসফটের সিইও মোস্তফা সুলেমান জানিয়েছেন, এবার শুধু কাজই নয়, এআই মানুষের মতোই কথা বলবে এবং আচরণ করবে। সম্প্রতি জাপানে স্যাটেলাইট টিভিতে সংবাদ উপস্থাপনের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট ব্যবহার করা হয়েছে, যা বেশ জনপ্রিয়তাও পেয়েছে। এদিকে টেক জায়ান্ট গুগলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সুন্দর পিচাই জানিয়েছেন, গুগলের নতুন সব সফটওয়্যার ডেভেলপ ২৫ শতাংশেরও বেশি কোড তৈরি করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)।

বাংলাদেশে কিছু কিছু খাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ব্যবহার শুরু করলেও বিশ্ব প্রেক্ষাপটে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এর জন্য দরকার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও দক্ষ জনশক্তি। বর্তমান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে ডিজিটাল প্রযুক্তির অন্যতম নিয়ামক হচ্ছে ইন্টারনেট স্পিড। মোবাইল ইন্টারনেটের গতিতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১১২তম। ওয়েব সার্ভিস প্রতিষ্ঠান স্পিডটেস্টের মার্চ ২০২৪-এর সূচকে এমন চিত্র উঠে এসেছে। মোবাইল ইন্টারনেটের পাশাপাশি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ১০৮তম, যেটি এআই টুলস ব্যবহারের অন্তরায়।

দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, নিউজিল্যান্ডসহ পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশ, এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও তাদের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা কারিকুলামে কোডিং ও এআই প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত করেছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে আমাদের দেশের শিক্ষা কারিকুলামেও নিম্নমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক স্তরের ডিজিটাল প্রযুক্তি বিষয়ে কোডিং, শিক্ষাসংশ্লিষ্ট এআই টুলস ও ওয়েব ডেভেলপিং ভাষা অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। প্রযুক্তি জ্ঞানে আমরা আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে আর পেছনে দেখতে চাই না। আমাদের দেশের শিক্ষা কারিকুলামে নিম্নমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক স্তরের ডিজিটাল প্রযুক্তি বিষয়ে কোডিং, শিক্ষাসংশ্লিষ্ট এআই টুলস ও ওয়েব ডেভেলপিং ভাষা অন্তর্ভুক্ত করে আমাদের নতুন প্রজন্মকে বিশ্ব নাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করা দরকার।

এ লক্ষ্যে প্রতিবছর সরকারিভাবে উপজেলা পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত স্কুল প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার আয়োজন করা প্রয়োজন। এছাড়াও দেশের সব মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলগুলোতে হাইস্পিড ইন্টারনেট সংযোগসহ আধুনিক কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করে শিক্ষকদের প্রযুক্তিবিষয়ক বিশেষ করে কোডিং ও এআই টুলসসংক্রান্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করা দরকার। একইসঙ্গে স্কুলগুলোর লাইব্রেরিতে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তিবিষয়ক বইয়ের পর্যাপ্ত সরবরাহ করা দরকার। পরিশেষে, আমাদের দেশের স্কুল শিক্ষাথীরা যেন কোডিং তথা লজিকের খেলায় পিছিয়ে না পড়ে, সে আশাবাদ ব্যক্ত করে আজকের লেখা শেষ করছি।

মো. হাসান-উল-বারী : শিক্ষক, মিলেনিয়াম স্কলাস্টিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, জাহাংগীরাবাদ সেনানিবাস, বগুড়া

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম