Logo
Logo
×

বাতায়ন

মিঠে কড়া সংলাপ

ভারতীয় মিডিয়ার অপপ্রচার বন্ধ হোক

Icon

ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ভারতীয় মিডিয়ার অপপ্রচার বন্ধ হোক

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মিডিয়াসহ সেদেশের একটি গোষ্ঠী অত্যন্ত জোরেসোরে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে নেমেছে। দিন-রাত মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে বাংলাদেশে হিন্দু নিধনের কল্পকাহিনি তারা এমনভাবে প্রচার করছে, যা দেখেশুনে চুপচাপ বসে থাকা যায় না। আর এ কারণেই যুগান্তরে প্রকাশিত এক সংবাদে দেখতে পেলাম, টাঙ্গাইলের গোপালপুর থানার জমিদার বাড়ির উত্তরসূরি ‘খোকন চক্রবর্তী’ ভারতীয় মিডিয়ার প্রোপাগান্ডার প্রতিবাদ করে বলেছেন, ভারতে বসবাসরত তার চার বোনসহ আত্মীয়রা এসব অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে খোঁজখবর নিতে তাকে বারবার টেলিফোন করায় তিনি তাদের জানিয়েছেন, ‘তোমাদের চেয়ে আমরা এখানে ভালো আছি, ভারতীয় মিডিয়া উসকানি দিয়ে আমাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের চেষ্টা করছে’ (যুগান্তর, ১০ ডিসেম্বর)।

বলা বাহুল্য, এক্ষেত্রে খোকন চক্রবর্তী ভারতে অবস্থানরত তার আত্মীয়স্বজনকে সঠিক তথ্য দিয়ে দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছেন। এক্ষেত্রে ‘তোমাদের চেয়ে এদেশে আমরা ভালো আছি’ বলতে তিনি হয়তো বুঝিয়েছেন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে তিনি বা তারা ভালো আছেন। কারণ, আমাদের দেশের মানুষের মাথাপিছু গড়পড়তা আয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম, ত্রিপুরা ইত্যাদি বাংলাদেশসংলগ্ন ভারতীয় রাজ্যের চেয়ে অনেক বেশি। আর ধর্মীয় সম্প্রীতি সম্পর্কে ভারতীয় মিডিয়া যেসব প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে, তা যেহেতু ভিত্তিহীন এবং এখানে যেহেতু কোনো হিন্দু নিধন-নির্যাতন চলছে না, বরং ভারতের কাশ্মীরসহ মিজোরাম ইত্যাদি রাজ্যে সংখ্যালঘু এবং নিুবর্ণের হিন্দুদের উপর অত্যাচার-নির্যাতন চলছে, সুতরাং বাংলাদেশে তাদের ভালো না থাকার কোনো কারণ নেই।

অপরদিকে নড়াইলের একজন হিন্দু রমণী পশ্চিমবঙ্গে অবস্থানরত তার ভাইয়ের ছেলের বিয়েতে গিয়ে বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন, খুন ইত্যাদির যেসব বানোয়াট কাহিনি সেখানকার মিডিয়ার সামনে তুলে ধরেছিলেন, পরে তিনি নিজেই তা প্রত্যাহার করে নিয়ে বলেছেন, ‘ভারতে যাওয়ার পর তাকে ভয় দেখিয়ে এসব বলতে বাধ্য করা হয়েছে, তিনি এসব কথা বলতে চাননি!’ আর এ ঘটনাটিও আমাদের একটি ইলেকট্রনিক মিডিয়া উদ্ঘাটন করায় আমরা তা জানতে পেরেছি।

এখন প্রশ্ন হলো, কে বা কারা কেন, কী উদ্দেশ্যে এতটা বেপরোয়াভাবে অপপ্রচার চালানো শুরু করেছে? যদিও প্রশ্নের উত্তরটা সহজ, কিন্তু অনেক সময়ই এমন একটি সহজ প্রশ্নের উত্তরও সহজভাবে দেওয়া যায় না! কারণ, যে ক্ষেত্রে সময়ে সময়ে আমরা নিজেরাই নিজেদের শত্রু হয়ে উঠি, সেসব ক্ষেত্রে সহজ উত্তরটাও মেলানো কঠিন হয়ে পড়ে। অন্যথায় সেই পাকিস্তান আমল থেকে যে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের সঙ্গে আমাদের আত্মার সম্পর্ক, তাদের সঙ্গে একসঙ্গে ওঠাবসা, চলাফেরা, এমনকি তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে শামিল হওয়া, সেই হিন্দু সম্প্রদায়ের কেউ যদি এদেশ থেকে ভারতে গিয়ে বা এখানে বসে নিজ দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করেন, মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দেন, তাহলে দুঃখের সীমা থাকে না। বস্তুত, দেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য আমরা হিন্দু-মুসলমান কেউই দায়ী নই; এসবের জন্য দায়ী হলো এদেশের অপরাজনীতি। একটি দল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে ভুল, অন্যায় বা অপরাধ করার ফলস্বরূপ গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়েছে। তাদের বড় বড় নেতা ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন এবং ভারত সরকার তাদের আশ্রয় দিয়েছে। কারণ ক্ষমতাচ্যুত দলটির সঙ্গে ভারত সরকারের অত্যন্ত নিবিড় সম্পর্ক ছিল বা আছে। এ অবস্থায় ভারতে বসে ক্ষমতাচ্যুত দলটির নেতারা নানা ফন্দিফিকির বা প্রয়োজনে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করবেন, রাজনীতিতে এমন ঘটনাও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তাই বলে আমাদের দেশের কেউ কেউ তাদের সেসব খেলার দাবার ঘুঁটিতে পরিণত হবেন, এটি কোনোমতেই স্বাভাবিক ঘটনা হিসাবে ধরে নেওয়া যায় না।

জাতি হিসাবে আমরা এতটা দুর্বল নই যে, সীমান্তের ওপার থেকে মিথ্যা প্রচারণা চালালে, সেখানকার লবিস্টরা কিছু মানুষ জোগাড় করে মিছিল করলে বা হুঙ্কার দিলেই আমরা ভয় পেয়ে যাব। সীমান্তের ওপারে বসে যারা এসব অপকর্মে লিপ্ত, তাদেরও জানা উচিত, ১৮ কোটি বাংলাদেশি বীরের জাতি; একটি স্বাধীন-সার্বভৌম জাতি হিসাবে আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচার জন্য এ জাতি যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে পারে। তাছাড়া ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের কারিগর যারা, তাদের আরও জানা উচিত, বাংলাদেশ ও ভারতের ভূ-রাজনীতি একই সমান্তরালে রয়েছে; এখানে কোনোরকম অস্থিরতার চেষ্টা করা হলে ভারতের গায়েও তার ধাক্কা লাগতে পারে। কারণ, ভারতেও ভূ-রাজনীতিগত সমস্যা তথা জাতিগত, ধর্মগত সমস্যার অন্ত নেই। এ অবস্থায় নিজের ঘরের দিকে না তাকিয়ে পরের ঘরে আগুন লাগানোর চেষ্টার ফল কতটা সুবিধাজনক হবে, সে বিষয়টিও ভারত সরকারের ভেবে দেখা দরকার। বিশেষ করে যেক্ষেত্রে উভয় দেশই পরস্পরের ওপর কিছু না কিছু নির্ভরশীল, সেক্ষেত্রে পরদেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা অব্যাহত রাখলে তার ফলাফল ভালো হবে বলে মনে হয় না।

এ অবস্থায় দেশের ক্রান্তিকালে ভারতীয় মিডিয়া-আগ্রাসনের এমন একটি সংকটের সময়ে দেশের কিছু মানুষ মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকলেও বা তাদের কেউ কেউ ভারতে বসে অথবা দেশের অভ্যন্তর থেকে চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের অংশীদার হলেও দেশের অস্তিত্বের প্রশ্নে ১৮ কোটি মানুষের সবাই মুখে কুলুপ এঁটে রাখতে পারে না। দেশের অস্তিত্বের প্রশ্নে বাংলাদেশি হিসাবে এসব অপপ্রচারের বিরুদ্ধে অবশ্যই আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আর এক্ষেত্রে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবাই মিলে সংঘবদ্ধ ও দৃঢ় ঐক্য গড়ে তুলে ভারতীয় মিডিয়া-আগ্রাসনের বিরুদ্ধে হাতে হাত মিলিয়ে, কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে। যেমনটি টাঙ্গাইলের হিন্দু সম্প্রদায় ভারতীয় মিথ্যা প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে বলেছে, ‘ভারতীয় মিডিয়া উসকানি দিয়ে আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের চেষ্টা করছে।’ একইভাবে সনাতন ধর্মীয় অন্যান্য বিভিন্ন সংগঠন, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার বড় বড় হিন্দু ধর্মীয় সংগঠন থেকেও বিবৃতি কাম্য।

বর্তমানে ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী বাংলাদেশি রাজনীতিকদের উদ্দেশেও বলতে চাই, রাজনীতির ময়দানে ভুলত্রুটি, অন্যায়, অপরাধ করেই আপনারা ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিয়েছেন। অন্যথায় দেশ ছেড়ে বিদেশ বিভুঁইয়ে গিয়ে সেখানকার রাজনীতিক ও লবিস্টদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হতো না বা দেশের বাড়িঘর ছেড়ে বিদেশে পড়ে থাকতে হতো না; আপনাদের সৎকর্মই আপনাদের রক্ষা করতো, দেশের মানুষ পাশে থাকলে আপনাদের কেউ কিছু করতে পারতো না। এ অবস্থায় আবারও যদি ভুল করেন, ভারতীয় গণমাধ্যমসহ সেদেশের রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডাকারীদের অপ্রপ্রচারে ইন্ধন জোগান, তাহলে কিন্তু স্বদেশের মানুষ আপনাদের আরও দূরে ঠেলে দেবেন। নিজ দেশের মানুষ যা পছন্দ করেন না বা করছেন না, তা করতে যাওয়া ঠিক হবে কি না বা ঠিক হচ্ছে কি না, সে বিষয়টিও একবার ভেবে দেখুন। আপনারা বরং নিজের কৃতকর্মের দিকে ফিরে তাকান।

বর্তমান সরকারের প্রতি আহ্বান থাকবে, দেশে গণগ্রেফতার, গণমামলা এসব বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিন। কারণ এসব ঘটনায় পতিত সরকারের সমর্থকরা সুবিধা পেয়ে যাবেন। নিরীহ-নির্দোষ মানুষের নামে মামলা দিলে, ধরে ধরে তাদের জেলে ঢোকালে, এমনকি সেসব নির্দোষ মানুষ আওয়ামী লীগার হলেও জনসাধারণের সহানুভূতি কিন্তু তাদের পক্ষে চলে যাবে। এক্ষেত্রে সম্প্রতি দেশের পুলিশপ্রধান এবং ঢাকার পুলিশ কমিশনারের একটি বক্তব্য প্রণিধাণযোগ্য। ৬ ডিসেম্বর পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আইজিপি বাহারুল আলম বলেছেন, ‘সরকার বলছে, কোন নিরীহ মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হন, উদ্ভূত ঘটনায় অনেক মামলা হয়েছে, আসামির সংখ্যা অনেক। অনেক নিরীহ লোকজনকে আসামি করা হয়েছে। এসব মামলা নিয়ে অনেকে বাণিজ্য করছেন; সমাজে তারাও প্রভাবশালী। একদিকে তারা বাদীকে প্রলোভন দিচ্ছেন, অন্যদিকে টাকা নিচ্ছেন!’

এ ধরনের ঘটনা বন্ধে বর্তমান সরকার ব্যর্থ হলে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের লোকজন কিছুটা লাভবান হতে পারে বলে ধরে নেওয়া যায়; কারণ দেশের মানুষের সামনে তারা মামলাবাজির বর্তমান চিত্রও তুলে ধরতে পারবেন। আবার ভারতে বসে থাকা অপপ্রচারকারীরাও এসব ঘটনা থেকে সুবিধা গ্রহণ করতে পারবেন।

উপসংহারে বলতে চাই, বাংলাদেশের যেসব রাজনৈতিক ব্যক্তি বর্তমানে ভারতে বসে আছেন, তাদের উচিত হবে সেদেশের মিডিয়ার মিথ্যাচারে ইন্ধন জোগানো বন্ধ করে এই মুহূর্তে নিজ দেশের মানুষ কী চায়, সে বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া। বর্তমান অবস্থায় ধৈর্যধারণ করাসহ দেশে ফিরে তারা আইনের মুখোমুখী হলে সেসব পদক্ষেপ বুদ্ধিমানের কাজ বলে বিবেচিত হতে পারে। অন্যথায় বিদেশে বসে ভারতীয় মিডিয়ায় এদেশে হিন্দু নিধনের গুজবে ঘি ঢালা হলে তা বিগত সরকারের লোকজনের জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষ ভারতীয় মিডিয়ার এসব মিথ্যা অপপ্রচারের কাছে মাথানত করবেন না, এমন অন্যায়ের বিরুদ্ধে তারা রুখে দাঁড়িয়ে ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে দেবেন।

ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম