Logo
Logo
×

বাতায়ন

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাঙালির ঐতিহ্য

Icon

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাঙালির ঐতিহ্য

ছবি: সংগৃহীত

বিগত সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির চার মাস অতিবাহিত হলো। ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ফসল যুগান্তকারী গণ-অভ্যুত্থানের পর বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছেন। বৈষম্যের প্রাচীর ভেঙে সমতার নতুন বাংলাদেশ উপহারে গৃহীত সরকারের সংস্কার উদ্যোগ দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হচ্ছে। ধর্ম-বর্ণ-দল-মত নির্বিশেষে কার্যকর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন অক্ষুণ্ন রাখার উদ্দেশ্যে সরকার ও জনগণের সর্বাত্মক প্রয়াস লক্ষণীয়। যে কোনো রাষ্ট্রে বিপ্লব বা অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলার অবনতি পরিলক্ষিত হয়। বর্তমান বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যমতে, সরকার পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে অতীতের দুর্বৃত্তায়ন নতুন রূপ পরিগ্রহ করে। দুর্বৃত্তদের ভূমিকা কিছু সময় স্তিমিত থাকলেও স্বল্প সময়ের মধ্যেই তাদের বেপরোয়া আচরণে জনগণ আতঙ্কিত। চাঁদাবাজি, দখল বাণিজ্য, লুটপাট, চুরি, ছিনতাই, রাহাজানি, মামলা-হামলা ইত্যাদি কারণে মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।

একই সঙ্গে বিচ্ছিন্নভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির পাঁয়তারাও দৃশ্যমান। দেশ ও সরকারকে বেকায়দায় ফেলে পরিবেশ অস্থিতিশীল করার অশুভ তৎপরতা লক্ষণীয়। দেশবিরোধী চক্রান্তকারীরা বৈশ্বিক যোগসাজশে সংখ্যালঘু আক্রান্তের বিষয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তুচ্ছ বিষয়কে অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপনের মাধ্যমে নৈরাজ্যের দৃশ্যপট তৈরির বিষয়টি সত্যিই দুঃখজনক। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বহু আগে থেকেই এ ধরনের কর্মকাণ্ডের দৃষ্টান্ত রয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত অপপ্রচার পরিত্যাজ্য হলেও কিছু দায়িত্বহীন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এসব প্রচারণায় সক্রিয় থাকে। জনগণ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করাই এর উদ্দেশ্য। কোনো বিচার-বিশ্লেষণ, যাচাই-বাছাই না করে মিথ্যার আশ্রয়ে অপকর্মে জড়িত হওয়া দুর্বৃত্তদের প্রধান কর্তব্যরূপে পরিগণিত।

বর্তমানে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার’ মাধ্যমে ছবি পরিবর্তন করে প্রায়ই অসত্যকে সত্য ঘটনারূপে প্রচার করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে জনগণকে বিভ্রান্ত করে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়, যাতে জনগণের সৌহার্দ-সম্প্রীতির অকৃত্রিম বিশ্বাসেও চিড় ধরে। এহেন পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র সাধারণ মানুষকে বিচলিত করার পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। সচেতন নাগরিকদের ঐক্য এসব ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে শক্তি হিসাবে কাজ করতে পারে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দীর্ঘ ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে যে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে-সেখানে নানা ধরনের অপশক্তি আছে, থাকবে, এটিই স্বাভাবিক। তারা বিভিন্ন ঘটনা ঘটাতে চাইবে। সুতরাং এগুলো প্রতিরোধ করে এগোনোর জন্য সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। প্রসঙ্গত, গত ৫ ডিসেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপে অংশ নেওয়া মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধ ধর্মের শীর্ষ নেতারা জানান, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক কোনো বিভেদ নেই। এখানে সব ধর্মের মানুষ সুখে-শান্তিতে আছেন। কে কোথা থেকে কী প্রচার করল, সেটি নিয়ে চিন্তার কিছুই নেই। বরং দেশবিরোধী যে কোনো ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় দেশের সব শ্রেণি-ধর্মের মানুষ ঐক্যবদ্ধ থাকবে।

বৈঠকে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ধর্মীয় নেতাদের উদ্দেশে বলেন, ‘দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন জেগেছে। সেগুলোর জবাব খুঁজে পাওয়ার জন্যই আপনাদের সঙ্গে বসা। জুলাই অভ্যুত্থানের পরপরই এ সরকার যখন গঠন হয়, তখন আমি বিমানবন্দরে সবার কাছে আন্তরিকভাবে একটা আহ্বান জানিয়েছিলাম যে, আমরা একটা পরিবার। আমাদের নানা মত থাকবে। নানা ধর্ম ও নানা রীতিনীতি থাকবে। কিন্তু আমরা সবাই একই পরিবারের সদস্য, এটাতেই জোর দিয়েছিলাম। আমরা মতপার্থক্য সত্ত্বেও কারও শত্রু নই। সবাই একই কাতারে চলে আসি। আমাদের পরিচয় আছে, আমরা বাংলাদেশি এবং এক পরিবারের সদস্য।’ মাননীয় প্রধান বিচারপতিও পারস্পরিক সহাবস্থান ও সম্প্রীতির মাধ্যমের দেশকে অগ্রগতির পথে নিয়ে যাওয়ার এবং সাম্প্রদায়িক বিভেদ নিরসনের আহ্বান জানিয়েছেন। সম্প্রতি সুপ্রিমকোর্ট মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে তিনি বলেছেন, ‘জাতীয় ঐক্য পরিণত হোক এমন এক প্রাতিষ্ঠানিক ঐকমত্যে, যার ওপর ভর করে রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গ বা স্তম্ভ নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রকৃত অর্থে নিজ নিজ স্বাধীনতা বজায় রাখতে পারে। একইসঙ্গে জাতীয় ঐক্যকে আরও সুদৃঢ় করতে সক্ষম হয়।’

গত ৯ নভেম্বর ইসলামিক ফাউন্ডেশনের খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ে ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা এবং সামাজিক সমস্যা নিরসনে ওলামা মাশায়েখদের করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় মাননীয় ধর্ম উপদেষ্টার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে মন্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। বিভিন্ন ধরনের জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সহাবস্থানই এদেশের বৈশিষ্ট্য। সংবিধানেও দেশের প্রতিটি নাগরিকের ধর্মপালন, ব্যবসা, রাজনীতি, শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে সমানাধিকারের কথা রয়েছে। দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্যমান সম্প্রীতি-সৌহার্দের সম্পর্ক বিনষ্টের জন্য কিছু কায়েমি স্বার্থবাদী দুষ্কৃতকারী অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের প্রতিহত করার জন্য সরকার সজাগ রয়েছে। দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি না থাকলে উন্নয়ন সম্ভব নয়।’

গত ৮ নভেম্বর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কঠিন চীবর দান ও জাতীয় বৌদ্ধ ধর্মীয় মহাসম্মেলন উপলক্ষ্যে ঢাকায় আন্তর্জাতিক বৌদ্ধবিহার পরিদর্শনকালে মাননীয় সেনাপ্রধানের প্রদত্ত বক্তব্যও প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে প্রতিটি ধর্মের নিজ নিজ উৎসব শান্তিপূর্ণভাবে উদযাপনের লক্ষ্যে সেনাবাহিনী প্রয়োজনীয় সব কার্যক্রম গ্রহণে সদা প্রস্তুত। পার্বত্য জেলায় শান্তি ও সম্প্রীতির উন্নয়ন ঘটিয়ে সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে পার্বত্য এলাকায় বসবাসরত পাহাড়ি ও বাঙালিদের সচেষ্ট থাকেত হবে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত পার্বত্য জেলাগুলোতে পর্যটনশিল্পের বিকাশের পাশাপাশি তিনি স্থানীয় ভাষা, সংস্কৃতি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোকপাত করেন। পার্বত্য জেলাগুলোতে আরও স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হলে স্থানীয় শিক্ষার্থীরা তাদের দক্ষতাকে দেশে-বিদেশে কাজে লাগাতে সক্ষম হবে বলে তার প্রত্যাশা।

মূলত বাঙালি জাতির মৌলিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির অবগাহনে সৌহার্দ-সম্প্রীতির বন্ধন অটুট রাখা। বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অসাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনাকে ধারণ ও লালন করে। বাংলার সমাজ ইতিহাস পর্যালোচনায় এটি স্পষ্ট যে, বর্তমান ভৌগোলিক সীমারেখা নিয়ে বাংলাদেশ নামক এ অঞ্চলটি মানবগোষ্ঠীর কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ভাষা, সাহিত্য, ধর্ম, চিন্তাচেতনা এবং ইতিহাসের বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে সংমিশ্রণ, সংযোজন, পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সমন্বয়সাধনের মাধ্যমে আজকের অবস্থানে উপনীত হয়েছে। বস্তুত গাঙ্গেয় এই ব-দ্বীপ এলাকায় বাঙালিরা বসবাস শুরু করে এ অঞ্চলে আর্যদের আগমনের প্রায় ১৫০০ বছর আগে। দ্রাবিড় সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত এ জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যের উৎসে ছিল কৃষিভিত্তিক সংস্কৃতি। আর্যদের দখলে আসার পর রাজনীতি, ভাষা-সংস্কৃতি ইত্যাদির বিষয়ে আর্য ও অনার্যদের মধ্যে সংঘাত শতাব্দীর পর শতাব্দী অব্যাহত থাকলেও শ্রী দুর্গাচন্দ্র সান্যালের ভাষায়-‘বৈদিক যুগ থেকে আর্যরা অনার্য সভ্যতা গ্রহণ শুরু করে।’

মোহাম্মদ আবদুল হাই তার সংকলিত ও সম্পাদিত ‘বাঙালির ধর্মচিন্তা’ গ্রন্থের ভূমিকায় চমৎকারভাবে উল্লেখ করেছেন, ‘মোগল আমলের বাংলা সমাজ প্রধানত হিন্দু, মুসলমান-এ দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অবস্থান তখন প্রায় অবলুপ্তির পথে ছিল। বাঙালি সমাজের এ দুটি সম্প্রদায়ের পরস্পরবিরোধী মৌলিক আদর্শগত বিভাজনটি বিকশিত হয়েছিল ধর্ম, দর্শন, আচার-আচারণ, নিরাকার-আকার, একেশ্বর ও বহুত্ত্ববাদকে কেন্দ্র করে। এ বিভাজনই প্রকৃতপক্ষে বিরোধ, বিদ্বেষ, হিংসা, প্রতিহিংসা ইত্যাদির জাঁতাকলে এ দুই সম্প্রদায়কে আড়ষ্ট করে রেখেছিল। এ উভয় সম্প্রদায়ের সৃজনশীল গোষ্ঠী কেন জানি মনন-চিন্তনের বেড়াজালে নিজেদের আবদ্ধ করে স্ব স্ব ধর্ম ও সমাজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে সচেষ্ট ছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, একদিকে ভীষণ ধরনের ব্যবধান সৃষ্টি হলেও প্রাত্যহিক সমাজজীবনের সহাবস্থান, শ্রেণিচরিত্র, পারস্পরিক লেনদেন, আদান-প্রদান ইত্যাদি এ দুই সম্প্রদায়কে আবার প্রেম-প্রীতি, সৌহার্দ-সম্প্রীতির অপরূপ মেলবন্ধনেও সমৃদ্ধ করেছে। এখানেই এ দুই সম্প্রদায়ের এক অভিনব বৈশিষ্ট্য ভিন্নমাত্রায় প্রবাহিত ছিল।’

বস্তুত গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক চিন্তা-চেতনার ধরন কোনোভাবেই ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। ব্যক্তির মানসিক ও সামাজিক গঠন তার জন্মগত ধর্মকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। ব্যক্তির স্বাধীনতাই এক্ষেত্রে অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কীভাবে তার এ বিশ্বাসের ক্ষেত্রটিকে লালন করবে এবং তার যথাযথ অনুশীলনের জন্য অন্যের কাছে অপ্রিয় হবে না বা একইভাবে অন্য ব্যক্তিও তার এ বিশ্বাস অনুশীলনে কোনো বাধার কারণ হবে না-সেটিই মূলত অসাম্প্রদায়িক ধর্ম-সমাজ চিন্তার মৌলিক নির্যাস। নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে তা সব নাগরিকের উপলব্ধিতে থাকবে-এটিই প্রত্যাশা।

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম