জনগণের আকাঙ্ক্ষার গতি-প্রকৃতি
গাজী মিজানুর রহমান
প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বর্তমানে এক অস্থির সময় পার করছি আমরা। দীর্ঘকাল ধরে একটি দলের নিরবচ্ছিন্ন অনিয়মতান্ত্রিক শাসন দেখে দেখে ভেতরে ভেতরে বীতশ্রদ্ধ হলেও জনগণ ভয়ে কিছু প্রকাশ করতে পারেনি। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের মাধ্যমে আকস্মিকভাবে সেই ভয় দূরীভূত হয়ে গেলে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ ঈপ্সিত ন্যায়ভিত্তিক, সাম্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত শৃঙ্খলাপরায়ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার তাগিদ অনুভব করছে। কিন্তু সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে একের পর এক বাধা আসছে সামনে। নবপ্রতিষ্ঠিত সরকারকে ভেতর এবং বাইর, দুই দিকের বিরোধিতা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। তাই আন্দোলনের কাতারে শামিল জনতা মনের চাওয়া জোরেশোরে বলতে পারছে না। তবু তাদের চেপে রাখা কথা সহজে অনুমান করা যায়, বোঝা যায়, দেশের মানুষ এ মুহূর্তে ঠিক কী চায়।
জনগণের মনের একটা কথা রাতারাতি পূরণ হয়েছে। আন্দোলন চলাকালে সে দাবি পূরণ করতে তখনকার সরকার বাধ্য হয়েছে। চাকরিতে পিতা-মাতা-দাদা-দাদি, নানা-নানির কীর্তির জন্য পুত্র-কন্যা-নাতি-নাতনি উত্তরাধিকারসূত্রে কোনো সুবিধা পাবে না-যার যার কোমরের জোরে তাকে চলতে হবে। সেই সঙ্গে সুবিধাভোগী একটি শ্রেণি তৈরি করে তাদের সহায়তায় সমাজের ভেতরে একটা কোটারি গোষ্ঠী সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের ঐক্য বিনষ্ট করা চলবে না। আন্দোলন আরেকটি বিষয় ফয়সালা করে দিয়েছে। সেটা হচ্ছে, জনগণই সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাধর। জনগণ যদি চারদিক থেকে সমবেত হয়ে আসতে পারে, তাহলে শটগান, রাইফেল, জলকামান, সাঁজোয়া গাড়ি, কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট, কারফিউ, ১৪৪ ধারা কোনো কিছুই সামনে দাঁড়াতে পারে না। জনগণ যেহেতু দেশের সবচেয়ে বড় ইউনিট, তাই জনগণ ন্যায়ের পক্ষে থাকলে সংখ্যার জোরে তারা বিজয়ী হয় এবং অন্যায় পিছপা হতে বাধ্য হয়।
কিন্তু জনগণের আরও অনেক কিছু চাওয়ার আছে। তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে, ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়া। ভোটার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যে কোনো সময় কেন্দ্রে যাবে, গিয়ে দেখবে তার ভোট কেউ দিতে পারেনি। ভোটের বাক্স তার দিকে তাকিয়ে আছে-কখন সে যাবে। যারা নির্বাচনের দায়িত্বে থাকবেন বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকবেন, তারা জানবে, ভোট একজনের ব্যাংক হিসাবের মতো একটা রেকর্ড। পাসওয়ার্ড দিয়ে টাকা তোলার মতো ভোট দিতে হবে। ব্যাংকে কোটি টাকা থাকলেও যেমন কেউ নেয় না, ভোটও হতে হবে এমন নিশ্ছিদ্র। নির্বাচনের অনেক স্তর। সংস্কার কাজগুলো করে জাতীয় নির্বাচন হোক। কিন্তু তার আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে সুষ্ঠু ভোট নিয়ে যোগ্য লোক বসিয়ে দেখাতে হবে, নির্বাচন কমিশন কতটা ভালো ভোট করতে পারে। ভোট যেন আর কাটাকাটি, সিল-মারামারির শিকার না হয়। প্রিসাইডিং আর পোলিং অফিসাররা যেন বিশেষ মহলের ভয়ে কাঁপাকাঁপি করতে করতে জ্বর বাঁধিয়ে নিজের কাজ অন্যদের হাতে তুলে দিয়ে নিরাপত্তার চাদর মুড়ি দিয়ে চোখ ঢেকে না রাখেন।
জনগণ তো অর্থনীতির মারপ্যাঁচ জানে না। কিসে কী হয়, তা বোঝে না। তবে চাল, ডাল, তেল, তরকারি, আলু, পেঁয়াজ কিনতে গেলে যদি পকেটে টান পড়ে, তখন বোঝে, ভালো আছে কী নেই। তাই ৫ আগস্টের আগে যে দ্রব্যের দাম যা ছিল, তার থেকে কমতে হবে, এটাই তাদের আশা। আগে অবৈধ টাকার ঝনাৎকারের কারণে বাজারে যদি আগুন ধরে সবকিছুর দাম বেড়ে থাকে, তাহলে সেসবের অনুপস্থিতিতে এখন সরবরাহ ঠিক রেখে দাম নাগালের মধ্যে কেন আসতে পারবে না? আমাদের এখন চতুর্মুখী বিকল্প উৎস খুঁজে একরৈখিক সরবরাহ ব্যবস্থার ইতি টানতে হবে; না হলে এতদিন যারা একচ্ছত্র বাণিজ্যিক আধিপত্য করেছে, তাদের কাছ থেকে কথায় কথায় রপ্তানি বন্ধের হুমকি আসবে। প্রত্যুত্তরে ওদের পণ্য বর্জন করে শিক্ষা দেওয়া উচিত।
আমাদের জনসংখ্যার প্রায় আট শতাংশের এক শতাংশ ঢাকায় বাস করে। ঢাকা আমাদের রাজধানী। ঢাকার যোগাযোগ, আইনশৃঙ্খলা, জলবায়ুগত পরিবেশ আগের চেয়ে ভালো হতে হবে। আগের সরকার সরে যাওয়ার কিছুদিন আগে রিকশাকে ইঞ্জিন লাগিয়ে চালানোর ফন্দিবাজি করে একটা সমর্থক গোষ্ঠী বানানোর পরিকল্পনা করে গেছে। রিকশা এমনিতেই রাজধানী শহরের সঙ্গে মানানসই নয়, অযান্ত্রিক যানবাহন, ট্রাফিক জ্যাম আর দুর্ঘটনার জন্ম দেয়, তারপর সেই কাঠামোতে ইঞ্জিন লাগানো একটা অবাস্তব পদক্ষেপ। রিকশা উঠিয়ে চালকদের অন্য পেশায় নিয়োজিত হওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে ধাপে ধাপে।
অতি সম্প্রতি একটি বিভাগ থেকে জনগণের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। এটি ভালো পদক্ষেপ। বাস্তবতা হচ্ছে, কতিপয় মানুষ যেভাবে বিভাগটিকে চালিয়েছে, সেভাবে তাদের অধস্তন লোকজন ভয়ে ভয়ে চলেছে। নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ায়, আগের খারাপ কাজের দায় নতুনরা নেবে না। তাই এমন বিবৃতি জনগণের কাছে স্বাগত পদক্ষেপ। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় হচ্ছে, হেরে গিয়ে কিছু খেলোয়াড় রেফারির বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে মাঠ ছাড়তে চাইছে না। তাদের এ মানসিকতা আবারও ম্যাচ অনুষ্ঠানের পথ রোধ করে রাখছে। বিপথগামী খেলোয়াড়ের অসভ্যতা দেখে মাঠের দর্শক কিছু উচ্ছৃঙ্খলতা দেখাচ্ছে। জনগণের রেফারিগিরিকে প্রশ্নের মুখে ফেলে কি ভবিষ্যতে ভালো ফল আশা করা যায়?
জনগণের আরেকটি আকাঙ্ক্ষা মানচিত্র আমাদের যতই ছোট হোক, বিশ্বে জনসংখ্যার বিবেচনায় আমাদের অবস্থান অষ্টম। আমাদের চেয়ে অনেক ছোট দেশ আছে, যাদের চোখের দিকে চেয়ে চোখ রাঙিয়ে কথা বলা যায় না। কেউ বলতে এলে চোখে ঝাঁজ লেগে অনবরত পানি ঝরে। কিন্তু আমাদের চরিত্র নিয়ে কেউ কেউ কথা বলছে, আমরা কিছুই বলতে পারছি না। জনগণ হটকারিতার বশবর্তী হয়ে কিছু করতে বলছে, তা নয়। তবে এ চরিত্রহননের প্রচেষ্টার অবসান হতে হবে। এতদিন তারা যে একতরফা ব্যবসা করে গেছে, সেই সুযোগ নিয়ে কথায় কথায় পণ্য রপ্তানি বন্ধ করে দেবে, চিকিৎসা বন্ধ করে দেবে, সেটি কেমন ভদ্রতা? আমরা তো পয়সা দিয়ে পণ্য কিনে খাই, লঙ্গরখানায় তো খাই না! আবার দাতব্য চিকিৎসালয়ের চিকিৎসা নিতেও যাই না! মালয়েশিয়া যখন সিঙ্গাপুরকে বের করে দিয়েছিল, তখন তাদের অহংকারে আঘাত লেগেছিল। তারা মালয়েশিয়াকে দেখিয়ে দিয়েছে, দেশ ছোট হলেও তাদের সেবা অন্য দেশের চেয়ে উন্নত। আমাদের যদি সিঙ্গাপুরের মতো চেতনাবোধ জাগে, আমরাও চিকিৎসাসেবায় দক্ষিণ এশিয়ার মোড়লখ্যাত দেশকে পেছনে ফেলতে পারি।
গাজী মিজানুর রহমান : সাবেক যুগ্মসচিব ও প্রাবন্ধিক