উপেক্ষিত গ্রামীণ অর্থনীতি ও কর্মসংস্থান
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
আবু তাহের খান
প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
![উপেক্ষিত গ্রামীণ অর্থনীতি ও কর্মসংস্থান](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2024/12/02/Untitled-22-66f09d5e242b8-674cd51745af4.jpg)
ফাইল ছবি
দেশের উন্নয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় গ্রাম বরাবরই খানিকটা প্রান্তিক বিষয় হয়ে থেকেছে। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন, এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হাতে সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকায় অনেকটা অনুমানের ভিত্তিতেই এ নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। তবে উল্লিখিত তথ্য ছাড়াই সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায়, গ্রামীণ অর্থনীতি নিজে নিজে যতটা এগিয়েছে, তা বস্তুত সেখানকার স্থানীয় অর্থনীতির নিজস্ব সম্ভাবনা এবং সেখানে বসবাসরত ব্যক্তি মানুষের চেষ্টা ও পরিশ্রমেরই ফসল। রাষ্ট্র যদি সেখানে কিছুটা সহযোগিতার হাত বাড়াত, তাহলে সে সম্ভাবনা ও ব্যক্তি উদ্যোগ উভয়ই অনায়াসে আরও অনেক বেশি শক্তিশালী ও কার্যকর হয়ে উঠতে পারত।
২০২০-২১ সাল থেকেই বস্তুত বাংলাদেশে গ্রামীণ অর্থনীতির বর্তমান নেতিবাচক ধারার শুরু। এ সময়ে দেশের শহরকেন্দ্রিক অধিকাংশ শিল্প-কারখানা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে গেলে, সেসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের একটি বড় অংশই বেকার হয়ে দলে দলে গ্রামে ফিরে যায়। কিন্তু কোভিড-উত্তরকালে এ বেকারদের মধ্যকার অনেকেই আর চাকরি ফিরে পাননি কিংবা গ্রামেও তারা নিজেদের প্রত্যাশা ও যোগ্যতা অনুযায়ী তেমন কোনো কাজ জুটিয়ে নিতে পারেননি। অন্যদিকে রাষ্ট্র কর্তৃক উপযুক্ত পুনর্বাসন কর্মসূচি এবং বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান কৌশল গৃহীত না হওয়ায় কর্মপ্রত্যাশী নতুন বেকার ও কোভিডকালীন পুরোনো বেকার- এ উভয় শ্রেণির বেকারত্ব মিলে দেশের এ সংক্রান্ত পরিস্থিতি ইতোমধ্যে এমন এক চরম বিপর্যয়কর অবস্থায় পৌঁছে গেছে, সেটিকে কিছুতেই শুধু বিবিএসের তথ্য-পরিসংখ্যান দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। এরই মধ্যে আবার অধিকতর প্রকট আকার ধারণ করেছে গ্রামীণ বেকারত্ব, যা আগে থেকেই শহরের তুলনায় বেশ খানিকটা নাজুক অবস্থায় ছিল এবং কোভিডকালে শহুরে বেকাররা গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেওয়ার ফলে সেটি আরও বেশি নাজুক হয়ে পড়ে। এর বাইরে ছদ্ম বেকারত্বের প্রকটতা তো বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে সেই বহুকাল ধরেই রয়েছে, যা সাম্প্রতিক সময়ে আরও বেড়েছে।
বিগত সরকারের শাসনামলে দেশের অর্থনীতিতে লুটপাটের নতুন ধারার সূচনা হয়েছিল। কোভিডের সময় ক্ষমতায় থাকা ও ক্ষমতার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা ‘প্রণোদনা’র নামে বিভিন্ন খাতে যেসব নগদ আর্থিক সহযোগিতা গ্রহণ করেছেন, তার বড় অংশটিই ছিল এক ধরনের লুটপাট। পণ্য রপ্তানি না করেই রপ্তানির নামে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কোটি টাকা প্রণোদনা গ্রহণ, টিকা ও অন্যান্য চিকিৎসা উপকরণ ক্রয়ের মূল্য ও পরিমাণ বেশি দেখিয়ে বাড়তি অর্থ আত্মসাৎ, নিয়ম ভেঙে ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে সেটি ও পুরোনো ঋণের কোনোটিই পরিশোধ না করে বরং ঋণ ও সুদ দুটোই মওকুফ করে নেওয়া, অসচ্ছল ব্যক্তিদের মধ্যে খাদ্য ও নগদ অর্থ বিতরণের নাম করে সরকারি দলের লোকজন কর্তৃক বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়া, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের আড়ালে বিদেশে অর্থ পাচার-বস্তুত এগুলোই হচ্ছে কোভিডকালীন লুটপাটের কতিপয় নমুনা। আর এসব অন্যায় ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রলম্বিত প্রভাব অনিবার্যভাবেই দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির ওপরও ব্যাপকভাবে পড়ে এবং সেখানকার রাজনৈতিক সুবিধাভোগী ও ধূর্ত শ্রেণির লোকরা গ্রামে বসেই নানা অন্যায় ও অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনের ফন্দিফিকির খুঁজতে থাকে। ফলে সেখানে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে কম।
এ সময়ের মধ্যে দেশে দ্রব্যমূল্যও ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়, যা সাম্প্রতিক সময়ে আরও বেড়েছে এবং এরই ধারাবাহিকতায় দেশে বাড়ছে সার, বীজ, কীটনাশক ইত্যাদি কৃষি উপকরণের মূল্যও। আর এসবের অবশ্যম্ভাবী ফল হিসাবে কৃষি খাতে বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধির ধারা দুই-ই নেতিবাচক হয়ে পড়েছে।
গ্রামের কৃষি ও অকৃষি খাতে কোথায় কী ধরনের নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে, বিগত পাঁচ দশকে এ দেশের কৃষক, কৃষকের শিক্ষিত সন্তান ও অন্যান্য তরুণরা বাস্তব চর্চার মাধ্যমে সে ক্ষেত্রগুলো মোটামুটি প্রায় চিহ্নিত করেছে। এখন শুধু প্রয়োজন সেসব চিহ্নিত ক্ষেত্রে উন্নততর প্রযুক্তি ও দক্ষতা প্রয়োগের মাধ্যমে নতুন বিনিয়োগ সম্প্রসারণ। কিন্তু উপরোল্লিখিত নানা কারণে বিনিয়োগ সম্প্রসারণের কাক্সিক্ষত সে কাজটি ক্রমেই নেতিবাচক ধারায় রূপ নিচ্ছে। এমনটি কেন হচ্ছে, তা নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা ও সমীক্ষা হতে পারে এবং সেটি হওয়া প্রয়োজনও। তবে প্রাথমিক তথ্য ও প্রবণতার ভিত্তিতে এটুকু বলা যেতে পারে, এর পেছনে দেশে বিরাজমান দুর্নীতি ও রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং উপরে বর্ণিত ব্যাপকভিত্তিক লুটপাট-সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। উল্লিখিত দুর্নীতি ও চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা দূরীভূত না হলে গ্রাম পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য হারে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। বিগত সরকারের আমলে ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদের কার্যক্রমের সঙ্গে সংসদ-সদস্যদের যুক্ত করার মাধ্যমে উল্লিখিত দুই পরিষদকে যেভাবে দুর্বল করে ফেলা হয়েছে, তাতেও গ্রামে কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ ও তৎপরতা বহুলাংশে কমে এসেছে, যার কিছু লক্ষণ ইতোমধ্যে দেখা দিতে শুরু করেছে।
অবশ্য এতকিছুর পরও কৃষি খাতে বাড়তি বিনিয়োগের যে সুযোগ রয়েছে, সেটিকে ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারলে সহসাই গ্রামীণ কর্মসংস্থান পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভব বলে আশা করা যায়। এর জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন ইউনিয়ন পরিষদের হাতে বাড়তি ক্ষমতা ও দায়িত্ব দিয়ে একে আরও শক্তিশালী করা, যাতে ওই পরিষদ গ্রামে কর্মসংস্থান সৃষ্টিমূলক ও উন্নয়নধর্মী বিভিন্ন কর্মকাণ্ড হাতে নিতে পারে।
গ্রামীণ জনগণের নিজস্ব দক্ষতা, সক্ষমতা, ঐক্য ও সংহতির শক্তিতে বলীয়ান হয়ে কখনো কখনো হয়তো কিছুদূর পর্যন্ত এগোতে পারবে। কিন্তু পরক্ষণেই দলীয় ও গোষ্ঠীগত স্বার্থের কারণে তা আবার ম্রিয়মাণ হয়ে পড়বে, যেমনটি এখনো লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাংলাদেশের সংবিধান নির্দেশিত একটি বৈষম্যহীন ও শোষণমুক্ত রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজন তো তেমন ধাঁচের গ্রামোন্নয়ন, যা শুধু টেকসই-ই হবে না, একইসঙ্গে মানবিক ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণও হয়ে ওঠবে। বস্তুত তেমন ধারার গ্রামোন্নয়নের জন্যই এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অপেক্ষা। কিন্তু আর কতকাল?
আবু তাহের খান : সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা (বিসিক)
atkhan56@gmail.com