সংস্কারের প্রাসঙ্গিক প্রশ্নগুলোর উত্তর জরুরি
দিলীপ কুমার সরকার
প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী শাসনের অবসানের পর একটি অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রপরিচালনা করছে। এ সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা, রাষ্ট্রব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের পর একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। জনআকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে ১১টি সংস্কার কমিশন করার ঘোষণা দিয়েছে। এ ১১টির মধ্যে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, সংবিধান সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন ও পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন ইতোমধ্যে কার্যক্রমও শুরু করেছে। স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন, শ্রমিক অধিকারবিষয়ক সংস্কার কমিশন ও নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনপ্রধানদের নাম ঘোষণা করা হলেও এখনো কমিশনগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে গঠিত হয়নি এবং গেজেটও প্রকাশ করা হয়নি। স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন গঠনের ঘোষণা দেওয়া হলেও কমিশনপ্রধানের নাম ঘোষণা বা গেজেট কোনো কিছুই করা হয়নি।
উপরোল্লিখিত কমিশনগুলোর মধ্যে ছয়টি সংস্কার কমিশনের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে সুপারিশসংবলিত প্রতিবেদন পেশ করার কথা। তারপর সরকারের পক্ষ থেকে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে সংস্কারের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করাসহ সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। এ সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কতটা সময় লাগবে, তা এখনো আমাদের অজানা।
রাষ্ট্র সংস্কারের ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো আমাদের সামনে উঠে এসেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক নির্বাচনব্যবস্থা প্রবর্তন, নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণ ও প্রত্যক্ষ নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য টার্ম লিমিট নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার; বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন বাতিল করে নতুন করে আইন প্রণয়ন এবং অনুসন্ধান কমিটিতে সরকারি ও বিরোধী দলের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা, নির্বাচন কমিশনের জনবল নিয়োগের ক্ষমতা কমিশনের ওপর ন্যস্ত করা, নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তিত না হলে ‘না’ ভোটের বিধান পুনঃপ্রবর্তন, হলফনামার ছকে পরিবর্তন এনে এতে তথ্য বিভ্রাট দূর করা; জনপ্রশাসনকে সম্পূর্ণরূপে দলীয়করণমুক্ত করে রাষ্ট্রের কাছে দায়বদ্ধ করা, পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করে এবং মেধাকে প্রাধান্য দিয়ে সব ধরনের নিয়োগ স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পন্ন করা; পুলিশ প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে দলীয়করণমুক্ত করা; বিচারব্যবস্থা সংস্কারে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের যথাযথ বাস্তবায়ন, বিচারপতিদের নিয়োগের জন্য আইন প্রণয়ন ও বিচার বিভাগের আওতায় পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা; দুর্নীতি দমন কমিশনকে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব বলয় থেকে মুক্ত করা; স্বাস্থ্যসেবাকে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হিসাবে গণ্য করা ও সব নাগরিকের জন্য স্বাস্থ্যবিমা চালু করা; গণমাধ্যম যাতে ভীতিমুক্ত পরিবেশে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, তা নিশ্চিত করা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা পরিপন্থি সব নিবর্তনমূলক আইন বাতিল করা; ন্যূনতম মানসম্পন্ন জীবনযাপন ও পুষ্টিচাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ, শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার পরিপূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান ও কারণে-অকারণে শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ করা; অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের মধ্যদিয়ে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষ্যমের অবসান ঘটানো; সাংবিধানিক আকাঙ্ক্ষার আলোকে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সমন্বিত আইন প্রণয়ন, স্থানীয় সরকারের কর্মকাণ্ডে সংসদ সদস্যদের হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধকরণ, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন নির্দলীয় ভিত্তিতে সংসদীয় পদ্ধতিতে আয়োজন; ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে নারীদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণ ইত্যাদি।
আমরা যদি বর্তমান সংবিধানের আলোকে ভাবি, সে ক্ষেত্রে দেখা যায়, রাষ্ট্র সংস্কারের উপরোক্ত বিষয়গুলোর মধ্যে এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যা রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমেই করা সম্ভব এবং কিছু বিষয় রয়েছে, যার জন্য সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন। আবার একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংবিধান সংশোধনের এখতিয়ার আছে কিনা, তা নিয়েও বিস্তর আলোচনা হচ্ছে।
কোনো কোনো রাজনৈতিক দল মনে করে, ‘গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার উচ্চ আদালতের পরামর্শ অনুযায়ী, সংবিধানের নির্দেশনা মোতাবেক রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ নিয়েছে। সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা এ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেই’। কারও কারও ভাষ্যমতে ‘এটি একটি বিপ্লব। বিপ্লবের পর পূর্ববর্তী সংবিধান রক্ষার শপথ কার্যকর থাকে না। তাই বর্তমানে কোনো সংবিধান নেই। এখন সংবিধান পুনর্লিখন করতে হবে এবং সেই এখতিয়ার সরকারের রয়েছে।’ ১০ নভেম্বর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে আরও তিনজন উপদেষ্টা রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ গ্রহণ করার পর এ ধারণা পালটেছে কিনা, তা জানা যায়নি।
সংবিধানকে সমুন্নত রেখে যারা পরিবর্তনের কথা ভাবেন, তারা মনে করেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মূল কাজ যথোপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা এবং নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। এজন্য যতটুকু সংস্কারের ক্ষমতা সরকারের রয়েছে, তা এ সরকার করবে এবং সংবিধান সংশোধনসহ অন্যান্য সংস্কার করবে নির্বাচিত সরকার’। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অধ্যাদেশ জারির মধ্যদিয়ে কোনো আইন প্রণয়ন করা হলেও পরবর্তী সংসদের প্রথম অধিবেশনে তার অনুমোদন প্রয়োজন হবে।
সংবিধান পুনর্লিখন করতে হলে প্রথমে সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান রচনা করতে হবে। এজন্য গণপরিষদ গঠন করতে হবে। সেই গণপরিষদ সংবিধান প্রণয়ন করবে এবং প্রণীত সংবিধান অনুযায়ী পরবর্তী নির্বাচন আয়োজনসহ রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। সংবিধান পুনর্লিখনের পথে হাঁটলে তার জন্য দীর্ঘ সময় প্রয়োজন। কিন্তু একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা কি সব রাজনৈতিক দল মেনে নেবে? কোনো কোনো রাজনৈতিক দল অন্তর্বর্তী সরকারকে সংস্কারের জন্য পর্যাপ্ত সময় দিতে রাজি। কেউ কেউ বলছেন, যৌক্তিক সময়ের কথা। আরেকটি অংশ সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করে দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। তাদের বক্তব্য, এখনই সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করুক সরকার।
নাগরিকদের একটি অংশের মধ্যে এমন ধারণাও আছে, সরকার বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকতে চায় বলেই সংস্কারের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করার ব্যাপারে মনোযোগী হচ্ছে না। ছাত্রদের উদ্যোগে একটি কিংস পার্টি গঠনের আলোচনাও আছে সচেতন মহলে। এ কারণেও নির্বাচন বিলম্বিত হতে পারে বলে অনেকের ধারণা।
আমরা জানি, আমাদের নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনকে প্রকৃত অর্থেই নির্বাচন বলা যায় না। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় নির্বাচন ছিল একতরফা, যাতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল অংশ নেয়নি। এ নির্বাচনে ৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে ১৫৩টিতেই ক্ষমতাসীন দল ও জোটের প্রার্থীরা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ভোটের আগের রাতেই মোট ভোটের উল্লেখযোগ্য অংশ প্রদানের জোরালো অভিযোগ ওঠে। ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন ছিল একপাক্ষিক। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো এ নির্বাচন বর্জন করেছিল। অধিকাংশ আসনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল মূলত আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে। দীর্ঘদিন ভোটদানের অধিকার বঞ্চিত থাকার কারণেই সাধারণ মানুষের মধ্যে ভোটদানের আকুতি যেমন রয়েছে, তেমনই রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কারের আকাঙ্ক্ষাও রয়েছে সচেতন মহলে।
জাতীয় নির্বাচন সম্পর্কে আরেকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা আছে, তা হলো, কেমন হবে এ নির্বাচন। এ নির্বাচন কি অংশগ্রহণমূলক হবে? এ নির্বাচনে কি আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ পাবে? তারা যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ না পায়, তাকে কি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলা যাবে? অতীতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও তার মিত্ররা অংশগ্রহণ না করায় সেই নির্বাচন সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা যদি অংশ নেওয়ার সুযোগ না পায়, তবে সে নির্বাচন কি সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে? তা কি সুষ্ঠু নির্বাচনের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণ করতে পারবে? আমি মনে করি, সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার অন্দোলনসহ অতীতে যারা হত্যাকাণ্ড ও অপরাধকর্মের সঙ্গে জড়িত, তাদের চিহ্নিত করে অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। তবে ব্যক্তি বা দলের নেতৃত্বের দায় পুরো রাজনৈতিক দলের ওপর চাপানো কি যৌক্তিক? সবাইকে মনে রাখতে হবে, অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে মানুষ চিরদিনের জন্য কর্তৃত্ববাদের অবসান চেয়েছে। কারও মধ্যেই তারা কর্তৃত্ববাদী আচরণ দেখতে চায় না; কেননা কর্তৃত্ববাদ গণতন্ত্র ও সুশাসনের শত্রু।
একজন সাধারণ নাগরিক হিসাবে মনে করি, আগে রাষ্ট্র সংস্কার, না আগে নির্বাচন, এ বিতর্কে না গিয়ে সংস্কার ও নির্বাচন ভাবনাকে কয়েকটি ধাপে ভাবা যেতে পারে। প্রথমত, সংস্কার কমিশনগুলো কর্তৃক অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে প্রতিবেদন পেশ; দ্বিতীয়ত, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক অংশীজনদের সঙ্গে সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে আলোচনাক্রমে সংস্কারের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিতকরণ; তৃতীয়ত, কোন সংস্কারগুলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার করবে এবং কোন সংস্কারগুলো নির্বাচিত সরকার করবে, তা নির্ধারণ; চতুর্থত, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এখতিয়ারভুক্ত সংস্কারগুলো সম্পন্ন করার মধ্যদিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি; পঞ্চমত, নির্বাচিত সরকার কর্তৃক কোন সংস্কারগুলোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে, এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি জাতীয় সনদ বা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর-যাতে যে দল সরকার গঠন করবে, তারা যেন সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করতে বাধ্য হয় এবং বিরোধী দলগুলোও যেন তাতে সমর্থন দিতে বাধ্য থাকে। আমাদের মনে রাখতে হবে, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। নির্বাচনের আগে যেমন সংস্কার প্রয়োজন, নির্বাচনের পরেও তা চলমান রাখতে হবে।
দিলীপ কুমার সরকার : রাজনৈতিক বিশ্লেষক