Logo
Logo
×

বাতায়ন

দেশ নিয়ে ভাবনার একমুখী ধারা

Icon

ড. মনজুর আলম

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দেশ নিয়ে ভাবনার একমুখী ধারা

প্রশ্নটা কত না সহজ। কেউ কেউ ভাবছেন, এটা একটা প্রশ্ন হলো? এমন প্রশ্ন কি যুক্তিসম্মত? যুক্তিসম্মত না হলেও প্রশ্নটা কেন যে বারবার মনে আসছে! নিশ্চয় আমার ‘আই কিউ’ নিয়ে আপনাদের সন্দেহ জাগছে। তবুও চলুন প্রশ্নটা করেই ফেলি। রাজনৈতিক নেতারাই যখন আমাদের দেশের ভাগ্য নিয়ে নাড়াচাড়া করেন, দেশের ভালো-মন্দ নিয়ে ভাবেন, তাদেরই প্রশ্নটা আগে করা যাক। যদিও নেতারা প্রশ্নটা শুনেই অট্টহাসি দিয়ে উঠবেন। হাসতে হাসতে তাদের পেটে খিল ধরে যেতে পারে। এটা একটা কথা? দেশ স্বাধীন করেছি আমরা, দেশটা তবে কার? বলিহারি প্রশ্ন! মোসাহেবরা তো হাসতে হাসতে অজ্ঞান। নেতাদের ব্যঙ্গ-হাসি শুনে মন খারাপ করলে কি চলে? নেতাদের কোনোকিছু নিয়েই মন খারাপ চলবে না। চলুন সরকারের বড় আমলাদের প্রশ্নটা করি।

নেতাদের মতো আমলারা প্রশ্নটা শুনে হাসলেন না। কপালের চামড়াটা কুঁচকে বিরক্ত আর অবাক হওয়ার মাঝামাঝি মুখাবয়ব করে তাকালেন। গভীর চোখে একনজরে বুঝতে চেষ্টা করলেন, মশকারি কিনা। ভারিক্কি গলায় বললেন, ‘দুনিয়াতে কত প্রশ্ন আছে, সব ছেড়ে এ কী প্রশ্ন করলেন? দেশটা আমাদের বলেই তো এ চেয়ারে বসেছি। পাকিস্তান আমল হলে বসতে পারতাম? ব্রিটিশ আমলের কথা নাইবা বললাম। অনেক গাড়ি, বাড়ি, ব্যাংকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা, দেশটা আমাদের না হলে হতো? ছেলেমেয়েরা বিদেশ পড়ছে, কনভেন্টে থাকে। তারপরও বলছেন, দেশটা কার? বিদায় হন। বাজেট তৈরি করছি, কোথাকার সব ঝুট ঝামেলা।’

আমলাদের কথায়ও মন খারাপ করতে নেই। ভাগ্য ভালো যে পিয়ন ডেকে গলা ধাক্কা দেননি। দেশের ভাগ্যনিয়ন্তা তো তারাই। রাজনৈতিক নেতাদের কলকাঠি নাড়ান তারা। সুতরাং তাদের ওপর রাগ করা মানে নিজের গালে চড় মারা। তার চেয়ে বরং এগিয়ে যাই, ব্যবসায়ীদের কাছে।

প্রশ্নটা ছুড়ে দিতেই ব্যবসায়ী ভাই একটু ভাবলেন। টাকা বানানোর নতুন আইডিয়া নাকি টাকা পাচারের নতুন ধান্দা! হালকা হাতে কলিংবেল টিপলেন। বেনসনের আনকোরা প্যাকেটের মচমচে পলিথিন মজাছে খুললেন। ততক্ষণে কড়া দুকাপ কফির অর্ডার হয়ে গেছে। বেনসনের প্যাকেটটা বাড়িয়ে নিজেও সিগারেটে আগুন ধরিয়ে সুখটান দিয়ে বললেন, জানেন আপনাকে কেন কফি খাওয়াচ্ছি? অনেকদিন পর আমার সঙ্গে দেখা করতে এসে কেউ কিছু চায়নি। আপনার প্রশ্নটা শুনে অবশ্য পাগল ভেবেছিলাম, তবুও ভাবলাম আপনাকে কফি খাওয়াই।

আপনি জানতে চেয়েছেন দেশটা কার? জীবনে বেশি পরীক্ষা দেইনি। তবে আমার মনে হচ্ছে এর চেয়ে সহজ প্রশ্নের উত্তর কখনো দেইনি, আর দিতেও হবে না। আরে ভাই দেশটা কার, দুনিয়াটা কার? আপনিই বলুন। যার টাকা আছে, তারই তো? যেখানেই যাবেন সেখানেই টাকা বলে কথা। ব্রিটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায়ও টাকা থাকলে ‘সিটিজেনশিপ’। বুঝুন টাকার কেরামতি! আর দু-পয়সার বাংলাদেশ, সেখানে জিজ্ঞেস করছেন, দেশ কার?

এ দেশের নেতারা কাদের টাকায় চলে? মন্ত্রী, এমপি কারা বানায়? দলকে খানা খাওয়ায় কারা? নেতা, আমলাদের বাড়ি-গাড়ি দেয় কারা? কালো টাকা সাদা করে তার ওপর বাড়তি লাভ কাদের ফন্দি? সহজ উত্তরটি জানেন না আর জিজ্ঞেস করছেন ‘দেশটা কার’? কালো টাকা! আমরাই তো নেতা-মন্ত্রী-এমপিদের কালো টাকায় পয়দা করেছি। কালো টাকা না থাকলে তারাই তো নাই হয়ে যাবে। বুঝেছেন কিছু? আসল ক্ষমতাটা কোথায়?

আন্ডারওয়ার্ল্ডের বাসিন্দাদের মতামত জানতে চাই বলে অবাক হলেন। গণতান্ত্রিক দেশে বাস করছি, তারাও তো ভোটার। ‘দেশটা কার?’ প্রশ্ন শুনে সন্দেহের চোখে আপাদমস্তক দেখে বোঝার চেষ্টা নতুন ‘নিরাপত্তা বাহিনীর’ লোক কিনা। পুরোনোদের তো সবাই চেনা। লেনদেনে সমস্যা? বলা নেই, কওয়া নেই, তার ওপর এমন অবাক প্রশ্ন-সন্দেহ তো হবেই। সন্দেহ মিটলেই খোশ মেজাজ, দিল দরিয়া! ‘ভাই সাহেব, এইডা কোন জাতের কথা হইল? দেশের দিকে চাইয়া দ্যাহেন। যেদিক চাইবেন-পেঁয়াজ, রসুন, চাল, ডাল, মাছ, মাংস, মসলা সবই আমাগো। শাড়ি, লুঙ্গি, পায়জামা, পাঞ্জাবি, ছায়া, ব্লাউজ, বাচ্চাদের ড্রেস, যেখানকার মেইড চাইবেন আর পাইবেন। মোটরসাইকেল, বাস, ট্রাক, পিকআপ, মিনিবাস, কার হাজির। কসমেটিকস? কোন দেশের, কোন ব্র্যান্ডের? নেশার অভ্যাস আছে? অন্য কোনো মাল? মেশিনগান থেইক্যা রিভলবার সবই পাইবেন। কাস্টমার চাইলে ট্যাংকভি দিবার পারি। মেইন রোডের ওপর দিয়া চালাইয়া পৌঁছাইয়া দিমু। পাবলিক ভাবব, আর্মির ট্যাংক আর আর্মি ভাবব ইউনিট মুভ করতাছে।’

চোরাচালানির এত খোলামেলা উত্তর শুনে মূল প্রশ্নই ভুলে যাওয়ার জোগাড়! কিন্তু অবাক করে সেই বলে উঠবে, ‘ভাইসাহেব ভাবতাছেন জিগাইলাম কী আর কইতাছে কী! তয় কথা যা কইলাম হেইডার ‘লিংক’ বুঝবার পারছেন? দেশডা আমাগো কন্ট্রোলে। ভাইবা দেখেন, প্রতিডা দিন কী পরিমাণ লেনদেন করতাছি! ট্যাকার হিসাবে আর ডলার-ইউরো একই কথা। এক হাজার কোটি ট্যাকা? এইডা কী কইলেন? এক সেক্টরের ট্যাকাও তো কইলেন না! চেষ্টা ছাড়েন। যাক, যা কইতাছিলাম, এত ট্যাকা লেনদেন যেই হাতে, দেশটা তাইলে কার হাতে-কালাচাঁনের? তয় কথা হইল, ট্যাকা যায় নানা গর্তে। হক্কলে মিইল্যা-মিশা খায়। নেতা, মন্ত্রী, ডিসি, বিডিআর, পুলিশ, আরও আছে। হক্কলেই পয়সার পাগল। স্বাধীনের আগে কয় ট্যাকার ব্যবসা হইছে আর আইজ। আন্দাজ করতে পারতাছেন? পারবেন না। পারলে, বিষম খাইবেন। তাই কইতাছি, ট্যাকার একটা পাওয়ার আছে না? যার কাছে পাওয়ার হেরই তো সব। আপনিই কন অহন দেশটা কার? আমাগোই-ঠিক কিনা?’

আন্ডারওয়ার্ল্ডের চোরাকারবারিদের কথায় আক্কেল গুড়ুম হলে চলবে? টেরোরিস্ট, গডফাদার, সন্ত্রাসী নামে ডাকলেও সবাই পলিটিক্যাল ক্যাডার। প্রশ্নটা শুনেই পিস্তল একেবারে মাথায়, ‘মস্করা করস? দেশটা তোর বাবার? ইন্নালিল্লাহ ... পড়। অন্য দেশে চালান করতাছি।’ তারপরও চাতকের মতো জবাবের অপেক্ষা দেখে একজন এগিয়ে আসে, ‘তাড়াতাড়ি কন। ঘণ্টা পরেই অপারেশন। দুই-মাস পুরা বুক। এখন মরবারও টাইম নাই। নেতা, এমপি, মন্ত্রী, চেয়ারম্যানগো কামের লাইগাই আছি। এইডা হইল সার্ভিস ক্যাডার। আমরা হইলাম হক্কলের ওপরের ক্যাডার, খাশ। বুঝতাছেন, দেশটা কার? একটু আগেই তো গেছিলেন ওইপার। দেশটা তখন কার হইত? নেতারা-আমরা মিল্লাই ঠিক করি কে মরব আর কে বাঁচব? আমরা আছি বইলাই ওনারা আছেন। আবার ওনারা আছেন বইলাই আমরা আছি। অহন কন দেশটা কার?

আন্ডারওয়ার্ল্ডের অনেকের সঙ্গে কথা হলো, চলুন কথা বলি সাধারণ মানুষের সঙ্গে। যারা দেশের চাকা ঘুরাচ্ছেন, দেশের অর্থনীতি সোজা রাখতে নিজের জীবনবাজি রেখে কাজ করছেন, শ্রমিকদের সঙ্গে।

প্রশ্নের উত্তরে শ্রমিক ভাইয়ের নিরানন্দ কণ্ঠে জবাব, ‘দেশ ভাই আমাগো না। দেশ হইল মালিকের। আমরা হইলাম আগাছা। যখন ইচ্ছা তুইলা ফেইলা দিল, ময়লার লাহান। কারও কিছু আইব-যাইব না। কেউ কিছু কইব না। দেশডা হইল বড়লোকের, টাকাওয়ালার। আগে ছিল ‘বাইশ পরিবার’, এখন হইছে ‘দুইশ বাইশ পরিবার’। আগে চুষত আস্তে আস্তে, এহন কম্পিটিশন দিয়া চুষতাছে, চুইষা ছাবলার লাহান ছুইড়া ফেলাইতাছে। আগের দিনের দাস-ভাইরাও আমাগো থাইকা ভালা আছিল। কামের বিনিময়ে খাওন। আজকাইলের নতুন সিস্টেমে ‘কাম করবা ঠিক, খাওনের ভার নিজের।’ সবাইর কত্ত আশা দেশডা স্বাধীন হইলে সব কিছু ভালা হইব। পাকিস্তানিদের দেশ থেইকা খেদানের কাম তো শেষ, কিন্তুক কী হইল? শ্রমিকগো ঠকানোর হাজারো ফাঁকফোকরে ওস্তাদ হইয়া বইল নতুন নতুন মালিক। স্বাধীন হইয়া কী লাভ হইল? আমাগো কষ্টের জীবনে না হইল উন্নতি, না আইল শান্তি। স্বপ্ন স্বপ্নই রইয়া গেল।

শ্রমিকের কথা শুনে মন খারাপ হবেই। যাদের শ্রমে দেশ চলছে, তাদের ন্যূনতম বেঁচে থাকার সুযোগগুলো দিতে পারছি না। অথচ মালিকরা কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা করছে, প্রতিবছর গাড়ির মডেল বদলাচ্ছে। যাদের শ্রমে এদেশ তাদেরই এ দেশ নয়, এ কেমন কথা!

মন খারাপ হলেও চলুন কৃষক ভাইদের কাছে, যারা শীত নাই, গ্রীষ্ম নাই, কঠিন মাঠে লাঙল চালিয়ে, ঘাম ঝরিয়ে ফসল করছেন। আমাদের পাতে খাবার জোগান দিয়ে নিজে অভুক্ত থাকছেন, সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদেরই প্রশ্নটা করি, এ দেশ কার?

প্রশ্ন শুনেই কৃষক ভাই একটুও ভাবলেন না। বললেন, ‘দেশডা কার? এইডা কেমন কথাগো বাজান, দেশ তো আল্লাহর। তয় বাবা বুঝছি তুমি প্রশ্ন ক্যান করলা। আমাগো কথার কোনো দাম নাই বাবা। এই যে দেশ দেখতাছ, আগে কী ছিল বাজান? বয়স হইছে মেলা; কিন্তু এখনো ঠাহর করতে পারি। ব্রিটিশ খেদাইয়া পাকিস্তান আইল। জমিদারি নাই, নীল চাষ নাই, সাহেবগো ধমকানি নাই। আইব খালি সুখ আর সুখ। কিন্তু বাবা স্বপ্ন ভাঙতে দেরি হইল না। মুখের জবান লইয়া টানাটানি। মুসলমান হইয়াও পাকিস্তানি নেতারা কি বেইমানিটাই না করল। আন্দোলন আর আন্দোলন। আশা এইবার দেশডা স্বাধীন হইলে হকল সমস্যার সমাধান। কত মানুষ মরল। কথাডা মনে আইলেই চক্ষুর পানি ধইরা রাখা দায়।

দেশডা স্বাধীন হইল। হগলে ভাবল ব্রিটিশ নাই, পাকিস্তানি নাই, কেউ আর ঠকাইব না, আনন্দ-ফুর্তিতে দিন যাইব। এ স্বপ্নও তাড়াতাড়ি ভাঙে বাজান! স্বাধীন হইল ঠিকই, কিন্তুক লক্ষ লক্ষ মানুষ একবেলা খায়, তো আরেক বেলা উপোস। হাজার হাজার মানুষ কুত্তা-বিলাইর মতো মরল। কাফনের কাপড়ও নাই। পেটের দায়ে সোমত্ত মাইয়া বেচনের যে কী দুঃখ! রাস্তাঘাটে মরা মানুষের লাশ। নাঙ্গা মানুষের কাফেলা।

লঙ্গরখানায় মানুষের কান্দন। সেসব কথা কইতে বাজান বুকটা ভাইঙ্গা যায়। ব্রিটিশ গেল, পাকিস্তানি খেদাইলাম, কিন্তু বাজান নতুন ব্রিটিশ, নতুন পাকিস্তানিগো কেমনে খেদাই? মানুষ না খাইয়া মরে আর আমাগো নেতারা ফুর্তি করে। কী পাষাণ রে বাবা! লঙ্গরখানায় মানুষ আটা গুইলা খায় আর নেতারা রেডক্রসের মাল চুরি কইরা বেইচা দেয়। লঙ্গরখানার মানুষগুলাই তো দেশডা স্বাধীন হোক, চাইছিল বাবা। নেতা হইলে মানুষ এত পাষাণ কেমনে হয় বাবা? লম্বা কইরা আর কী হইব? কত নেতা আইল আর কত নেতা গেল। আমাগো যেই আছলি সেই একই হাল। পোলাপাইন শিক্ষিত হইছে, হেইডা ঠিক। কিন্তু চাকরি হইছে?

শহরের মানুষরা গ্রামের সোজা সরল মানুষের মনে লোভ ঢুকাইয়া দিছে। পাপ সর্বনাশ করতাছে। ইলেকশনে গ্রাম আর গ্রাম থাহে না বাজান। ট্যাকা দিয়া মানুষের অন্তর কিনবার লড়াই। শহর থেইকা গুন্ডারা গ্রামের মানুষরে ডর দেহায়। বুঝ বাবা, আমরাই অহন ব্রিটিশ আর পাকিস্তানি হইয়া গেছি। এগুলারে খেদাইলে হইব না বাজান, এগুলার বীজগুলাও বিষ দিয়া মারণ লাগব। ব্রিটিশরে খেদাইতে পারলে, পাকিস্তানরে হারাইতে পারলে এ আগাছা সাফ করতে পারবা না বাজান? অবশ্যই পারবা। এ বুড়াডার কথা সব্বাইরে জানাইয়া দাও। দেশ বাঁচাইতে হইলে নতুন শয়তানগুলারে ঝাঁটা মাইরা বাইর করনই লাগব। না হইলে শয়তানগুলা হগোলেরে গিল্লা খাইব। দেশডাও খাইব।’

ড. মনজুর আলম : সহযোগী অধ্যাপক, হেলসিংকি বিশ্ববিদ্যালয়, ফিনল্যান্ড; শাসনতান্ত্রিক সংস্কার বিশেষজ্ঞ, ইইউ উন্নয়ন প্রকল্প

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম