সময়ক্ষেপণের সুযোগ নেই
এ টি এম মোস্তফা কামাল
প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
যে বিষয়গুলো অনুমোদনের জন্য সংসদে উপস্থাপনের আবশ্যকতা রয়েছে, সে বিষয়গুলো নিয়ে এ সরকারের মনোযোগী হওয়ার দরকার নেই। কারণ মনোযোগ দিতে গেলে অযথা সময় নষ্ট হবে এবং অন্য গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো দৃষ্টির অন্তরালে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা জোরালো হবে। যেমন, আওয়ামী লীগ সরকার দেশের স্বার্থবিরোধী যেসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছিল, সেগুলো জনসম্মুখে প্রচার, সংসদের অনুমোদন ছাড়া কার্যকর না করা কিংবা অকার্যকর-বাতিল ঘোষণা করা, দেশে সর্বক্ষেত্রে সুশাসন কায়েমের কৌশল নির্ধারণ করা, চাঁদাবাজি বন্ধে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি।
ফখরুদ্দীন সাহেবের তত্ত্বাবধায়ক সরকার স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালী করার ওপর অনেক জোর দিয়েছিল, কমিশন গঠন করেছিল, কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার কমিশন গঠনের জন্য অধ্যাদেশ জারি করেছিল, ফয়জুর রাজ্জাক সাহেবকে চেয়ারম্যান করে কমিশন প্রতিষ্ঠা করেছিল, কমিশন ৭-৮ মাস কাজও করেছিল। আমাকে সে কমিশনের সচিব হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচিত সরকার এসে সংসদে সে অধ্যাদেশ অনুমোদন না করায়, সে কমিশনের বিলুপ্তি ঘটেছিল। অন্তর্বর্তী সরকারকে এ বাস্তবতা সামনে রেখে তার কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করতে হবে।
ফার্স্ট রিপাবলিক বলে কি কিছু আছে? আমার জানামতে ফার্স্ট রিপাবলিকের কোনো অস্তিত্ব নেই। ফার্স্ট রিপাবলিক বলতে যদি ১৯৭২ সালের সংবিধানমতে ঘোষিত প্রজাতন্ত্রকে বোঝানো হয়ে থাকে, তাহলে যে ভৌগোলিক সীমানা নিয়ে ফার্স্ট রিপাবলিক সৃষ্টি হয়েছিল, সে ভৌগোলিক সীমানা অটুট থাকাবস্থায় সেকেন্ড রিপাবলিক গঠনের যৌক্তিকতা কী এবং সেই চিন্তাভাবনা কার্যকর করা হবে কী করে? ফার্স্ট রিপাবলিক থেকে সেকেন্ড রিপাবলিককে পৃথক করা হবে কী করে? অধিকন্তু, সেকেন্ড রিপাবলিকের ভাবনা কার্যকর করা গেলে, কোনো এক সময় সামান্য কোনো ইস্যু নিয়ে থার্ড রিপাবলিকের ইস্যুও সৃষ্টি হতে পারে।
সংবিধান বাতিল করা হবে কী করে? সংবিধান বাতিলের জন্য তো সংসদে আইন পাশ করতে হবে। তাছাড়া সংবিধান বাতিল করা হলে তো সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে। সংবিধান বাতিল করা হলে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কী করে? সংসদ-সদস্য পদের যোগ্যতা, অযোগ্যতা, সংসদের মেয়াদকাল ইত্যাদি নির্ধারিত হবে কী করে? পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন কোন আইনে? সংবিধান বাতিল করা হলে সংবিধান প্রণয়নের জন্য তো Constituent Assembly গঠন করতে হবে। সেটার জন্যও নির্বাচন অনুষ্ঠানের আবশ্যকতা রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার কি সে পথে হাঁটবে এবং সেরূপ জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলা করবে? আমি মনে করি অন্তর্বর্তী সরকারের এ ধরনের বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই।
অধিকন্তু, মন্ত্রিপরিষদশাসিত সরকার ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে বর্তমান সংবিধানের ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। তবে কিছু সংস্কারের প্রয়োজন আছে। সেক্ষেত্রে বর্তমান সংবিধানের কোথায়, কী ধরনের পরিবর্তন করা দরকার, সেরূপ একটা সুপারিশ নির্বাচিত সরকারের বিবেচনার জন্য তৈরি করা যেতে পারে। যদি অন্তর্বর্তী সরকার সেরূপ করার ইচ্ছা পোষণ করে।
রাষ্ট্রপতির পদটি প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ পদ। সে পদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করা সব নাগরিকের দায়িত্ব। স্বীয় পদের মর্যাদা রক্ষার তাগিদে রাষ্ট্রপতির পদে আসীন ব্যক্তিরও এমন কোনো কাজ করা উচিত নয়, যা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হতে পারে। সেরূপ কিছু বলার বা করার ইচ্ছা থাকলে রাষ্ট্রপতির পদ ছেড়ে যাওয়ার পর তিনি সেটা করতে পারেন। সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্রপতির পদে আসীন ও সংবিধানের আলোকেই এ পদ থেকে বিদায়-অবসর নেওয়াই সর্বোত্তম পন্থা।
অন্তর্বর্তী সরকারকে স্মরণ রাখতে হবে, তার হাতে সময় খুব কম। প্রতিটি দিন, প্রতিটা ক্ষণ তার কাছে অত্যন্ত মূল্যবান। তাই কোনোরূপ সময়ক্ষেপণ না করে অন্তর্বর্তী সরকারের করণীয় ও লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে তা বাস্তবায়নের কাজ শুরু করে দিতে হবে। কমিশন গঠন করতে ২ মাস, রিপোর্ট পেতে ৩ থেকে ৬ মাস, রিপোর্ট মূল্যায়ন করতে ৬ মাস-এত সময় তো অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে নেই। তাই কমিশন গঠন করে সময়ক্ষেপণের কৌশল নেওয়া হলে, মূল কাজ করার সময় হাতে পাওয়া যাবে না। ছাত্ররা নবীন ও শিক্ষার্থী। তাদের মনে অনেক ভাবনার উদ্রেক হতে পারে। তারা সেটা প্রকাশও করতে পারেন। গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হলে অন্তর্বর্তী সরকার সেটা বাস্তবায়ন করতে পারেন; কিন্তু যেটা অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়, সেটা করার জন্য চাপ প্রয়োগ করা সমীচীন নয়।
অন্তর্বর্তী সরকারকে তার কর্তৃক বাস্তবায়নযোগ্য কর্মকৌশল নির্ধারণ করে এগিয়ে যেতে হবে। যে সমস্যাগুলো অতীতের নির্বাচিত সরকারগুলো বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি; কিন্তু বাস্তবায়ন করা অত্যাবশ্যক ছিল, সেগুলো সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বাস্তবায়নের কাজ শুরু করে দেওয়া দরকার। যেমন, The Land Holding Limitation Order, 1972 (পরিবারপিছু ১০০ বিঘা সিলিং), ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশ-১৯৮৪ ও ভূমি সংস্কার আইন-২০২৩ (পরিবার পিছু ৬০ বিঘা সিলিং) মাঠপর্যায়ে কার্যকর করা; প্রজাতন্ত্রের সম্পত্তি থেকে (খাল-বিল-নদী-নালা-বন বিভাগের সম্পত্তি-পার্বত্য এলাকার খাস সম্পত্তি) অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ, ঢাকা শহরের যানজট নিরসন কল্পে ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ড-এর ৩০০-৫০০ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ি চালু করে নন-এসি গাড়ির চলাচল নিষিদ্ধ করে আদেশ জারি করা; সারা দেশের জেলা, উপজেলা, বিভাগীয় শহরের সরকারি হাসপাতালগুলো কার্যকর করতে সব সরকারি ডাক্তার ও মেডিকেল স্টাফদের বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে প্রাইভেট প্র্যাকটিস নিষিদ্ধ করে আদেশ জারি করা-রেজিমেন্টাল ফোর্সের মতো সব ডাক্তারের কর্মস্থলে উপস্থিতি নিশ্চিত করা-কেউ প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে চাইলে কর্মস্থলের সরকারি হাসপাতালে বসে তা করার সুযোগ প্রদান করে আদেশ জারি করা; জার্মান-অস্ট্রেলিয়া-যুক্তরাজ্যের আদলে শিক্ষানীতি-শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়ন করে আমাদের যুব সমাজকে গ্লোবাল সিটিজেন হিসাবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া; সর্বস্তরে দুর্নীতি-চাঁদাবাজি-সিন্ডিকেট ব্যবসাকে কঠোর হস্তে দমন করা; ব্যাংক কোম্পানি আইন এবং ঋণ প্রদান নীতিমালা সংশোধন করে ব্যাংকে গচ্ছিত পাবলিক মানি আত্মসাতের পথ রুদ্ধ করা, সংবিধানের আলোকে শুধু অনগ্রসরদের জন্য কোটার হার নির্ধারণ করে পরিপত্র সংশোধন করা; সংবিধানের আলোকে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতার বিষয়টি রিভিউ করা, ১৯৭১ সালে যাদের বয়স ১২ বছরের কম ও ১৯৭১ সালের পর যাদের জন্ম-এ রকম কারও নাম বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় থেকে থাকলে, তা বাতিল করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা; বড় বড় ব্যবসায়ীর করপোরেট কর মওকুফ নিষিদ্ধ করা ইত্যাদি।
বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা চীনকে মডেল হিসাবে বিবেচনা করতে পারি, কারণ চীন তার নিজস্ব স্বার্থ রক্ষা করে বিদেশি বিনিয়োগের চুক্তির শর্তাবলী নির্ধারণ করেছে। চীনের শর্তাবলীর অনুকরণে আমরা আমাদের শর্তাবলী নির্ধারণ করে নিতে পারি। আমার জানামতে, চীনে যে কোনো বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে স্থানীয় একজন সহ-উদ্যোক্তা থাকার আবশ্যকতা রয়েছে। বিদেশি উদ্যোক্তা তার পুঁজি প্রত্যাহার করে চলে যেতে চাইলে দেশি সহ-উদ্যোক্তা একই পেটেন্ট ব্র্যান্ডে উৎপাদন চালিয়ে যেতে পারবেন, স্থানীয় শ্রমবাজার থেকেও সব শ্রমিক-কর্মচারী নিয়োগ সেখানে বাধ্যতামূলক। চীন পারলে আমরা কেন তা করতে পারব না? অন্যথায় বিদেশি পুঁজি আকৃষ্ট করে আমাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষতি ছাড়া লাভের কিছুই থাকবে না।
অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মসূচি নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমার রচিত ‘রাজনীতি, সুশাসন ও উন্নয়ন’ নামক গ্রন্থটি সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। তাতে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ এবং সংবিধান সংশোধনের কিছু প্রস্তাবনাও রয়েছে।
এ টি এম মোস্তফা কামাল : অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব