Logo
Logo
×

বাতায়ন

শিক্ষায় অর্থায়ন ও ফোর্তালেজা সমাবেশ

Icon

কাজী ফারুক আহমেদ

প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষায় অর্থায়ন ও ফোর্তালেজা সমাবেশ

জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক বিশেষায়িত সংস্থা ইউনেস্কোর মহাপরিচালক আঁদ্রে আজুলের উদ্যোগে ব্রাজিলের ফোর্তালেজায় বিশ্ব শিক্ষা সমাবেশ শুক্রবার শেষ হয়েছে। বিভিন্ন দেশের সরকার, সিভিল সোসাইটি, শিক্ষক, ছাত্র ও যুবসমাজের প্রতিনিধি এবং শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ও উন্নয়ন সহযোগীরা এতে অংশ নিয়েছেন। শিক্ষার জন্য রাজনৈতিক সংঘবদ্ধতার একটি বিশেষ মুহূর্তে এ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হলো, যা শিক্ষার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য-৪ বাস্তবায়নে অগ্রগতি ও অবশিষ্ট চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেতে সুযোগ করে দেবে। এ সমাবেশ বিশ্ব শিক্ষা সমাজকে কার্যকর কৌশলগুলোয় ঐক্যবদ্ধ করবে, যাতে শিক্ষা সবার জন্য বাস্তবতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, সমসাময়িক চ্যালেঞ্জগুলো দক্ষতার সঙ্গে সামাল দেওয়া যায়। কারণ শিক্ষা হলো অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত সব অগ্রগতির মূল ভিত্তি-এতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তাদের চারপাশের বিশ্বকে আরও ভালোভাবে অনুধাবন ও গঠনের পন্থা সম্পর্কে যথাযথ ধারণা দেয়। সমাবেশে অর্থায়নের কেন্দ্রীয় প্রশ্ন; শিক্ষার জন্য তহবিল বৃদ্ধির লক্ষ্যে উদ্ভাবনী সমাধান খুঁজে পাওয়া এবং শিক্ষাকে ভবিষ্যতের জন্য সেরা বিনিয়োগ হিসাবে সক্রিয় বিবেচনা বিশেষ গুরুত্ব পায়। বিশ্ব সমাবেশের লক্ষ্য হচ্ছে ফোর্তালেজা ঘোষণাপত্র গ্রহণ করা, যা ২০৩০-পরবর্তী শিক্ষা কর্মসূচিতে একটি যৌথ দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তি তৈরি করবে।

এশিয়া সাউথ প্যাসিফিক অ্যাসোসিয়েশন ফর বেসিক অ্যান্ড অ্যাডাল্ট এডুকেশন শুরু থেকেই ব্রাজিলের ফোর্তালেজা কর্মসূচিতে অংশীজনের ভূমিকা পালন করে আসছে। ফোর্তালেজা সমাবেশ থেকে বিশ্বব্যাপী শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশ পাওয়া যায়। এ সমাবেশ উপলক্ষ্যে ইউনেস্কো মহাপরিচালকের ধারণাপত্রে বলা হয়েছে-শিক্ষা একটি মৌলিক মানবাধিকার, যা অন্যান্য মানবাধিকারকে সক্ষম ও অগ্রসর করে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য-৪-এর দৃষ্টিভঙ্গি (অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ন্যায়সংগত মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং সবার জন্য আজীবন শেখার সুযোগ উন্নীত করা) হলো শিক্ষার মাধ্যমে জীবনকে পরিবর্তন করা। মানসম্মত শিক্ষা এবং জীবনব্যাপী শিক্ষা অপরিহার্য; কারণ এটি মানসম্পন্ন এবং অর্থপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য মানবিক মূল্যবোধ, জ্ঞান এবং দক্ষতা দিয়ে সজ্জিত করে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পেরিয়ে অগ্রগতির ইঞ্জিন হলো শিক্ষা। অন্যান্য সিডিজি পরিবেশগত, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট প্রদান করে শিক্ষায় অবদান রাখে, যা শিক্ষা, উন্নয়ন এবং সুস্থতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে টেকসই উন্নয়ন ২০৩০-এর লক্ষ্য অর্জনের আর মাত্র ছয় বছর বাকি থাকতে লক্ষ্যমাত্রার ১৭ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে, ৩৫ শতাংশ স্থগিত বা বিপরীতমুখী। অন্যদিকে প্রায় ২৫০ মিলিয়ন শিশু এবং যুবক স্কুলের বাইরে। অনুমান করা হয়, প্রায় ৪০ শতাংশ প্রাথমিক স্কুল বয়সি শিশুর বিশ্বব্যাপী প্রাথমিক পড়ার দক্ষতার অভাব রয়েছে। আমাদের অবশ্যই শিক্ষার জন্য একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে। তবে পাঠ্যক্রমের বিষয়বস্তু, শিক্ষাদান এবং শেখার পদ্ধতিগুলোকে পুনর্বিবেচনা ও পুনর্নবায়ন করতে হবে।

বাংলাদেশ প্রেক্ষিত

এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফরম, বাংলাদেশের গত বছর প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের উন্নয়ন আখ্যান ও সমান্তরাল বাস্তবতা: পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ভাবনা’ শীর্ষক পুস্তিকার অংশবিশেষ উপস্থাপন সমীচীন মনে করছি : বর্তমানে শিক্ষায় কোনো আনন্দ নেই; শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় পাশ করার জন্য পড়ছে। ফল খারাপ হলে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। শিক্ষক বা অভিভাবক কেউ শিক্ষার্থীদের কোনো উৎসাহ দেয় না, বরং তাদের ওপর পরীক্ষার বোঝা চাপিয়ে দেয়। কিছু ক্ষেত্রে ওপরমহল থেকে অনৈতিকভাবে শিক্ষার্থীদের নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এর ফলে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা প্রকৃত জ্ঞানের প্রতিফলন নয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে পরীক্ষার খাতা ওজন করে নম্বর দেওয়ার কথাও শোনা যায়। শিক্ষা খাতে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা কম। বেশির ভাগ শিক্ষকই সৃজনশীল প্রশ্ন কাঠামোর সঙ্গে এখনো নিজেদের মানিয়ে নিতে পারেননি। চলতি বছর থেকে শুরু হওয়া নতুন পাঠ্যক্রম অনুযায়ী, পাঠদানের প্রয়োজনীয় উপকরণ ও নির্দেশনার অভাব রয়েছে। বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও, শিক্ষকরা ঠিকমতো বেতন পাচ্ছেন না। অধিকাংশ আদিবাসী শিশু দারিদ্য বা অর্থের অভাবে শিক্ষার ওপরের স্তর পর্যন্ত উঠতে উঠতেই ঝরে পড়ে। দেশে শিক্ষার হার বাড়লেও শিক্ষার মান নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থা মূলত কোচিং সেন্টারভিত্তিক হয়ে পড়ছে। সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থার সুযোগ-সুবিধায় বিশাল ফারাক। শিশুর সামগ্রিক শিক্ষার জন্য একটি বিদ্যালয়ে কী কী সুযোগ-সুবিধা থাকা প্রয়োজন, তা আগে থেকে নির্ধারণ করা আছে; কিন্তু বিদ্যালয়গুলোয় সেসব সুযোগ-সুবিধা প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। শিশুর নানামুখী প্রতিভা বিকাশের জন্য বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ, ইনডোর গেমসের ব্যবস্থা ও অন্যান্য সহশিক্ষা কার্যক্রমের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই।

বর্তমানে শিক্ষা কার্যক্রম কেবল পরীক্ষা নেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় পাশ করার জন্য নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করছে মাত্র। এতে করে খণ্ডিত শিক্ষা নিয়ে তারা বেড়ে উঠছে। অথচ এসডিজির অন্যতম অভীষ্ট হচ্ছে মানসম্মত শিক্ষা। প্রতিটি এলাকায় অনেক স্কুল হচ্ছে; কিন্তু সেগুলোর ওপর কোনো নজরদারি নেই। এ নজরদারি না থাকার কারণে স্কুলগুলোয় গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত হচ্ছে না। এগুলো এক ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। সরকারি-বেসরকারি উভয় ধরনের স্কুলে ভর্তিবাণিজ্য হচ্ছে। এ বাণিজ্যের সঙ্গে কেবল স্কুলের শিক্ষকরাই জড়িত নন, বরং এখানে অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করেন বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিপত্তির কারণে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটিতে এমন ব্যক্তি ঢুকে যাচ্ছেন, যাদের শিক্ষা সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা নেই। ফলে তারা সবকিছুকেই নিজেদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসাবে ব্যবহার করতে চাইছেন। তাদের মাধ্যমে বিদ্যালয়ের পাঠদানের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বিতর্ক, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের মতো নানা ধরনের সহশিক্ষা কার্যক্রমও নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির অভিভাবক প্রতিনিধি বা কোনো অভিভাবক যদি বিদ্যালয়ের কোনো অনিয়মের বিষয়ে কথা বলেন, তাহলে পরবর্তী সময়ে ওই শিক্ষার্থীকে টিসি দিয়ে বের করে দেওয়া হয়। সে কারণে কোনো অভিভাবক বিদ্যালয়ের অনিয়মের বিষয়ে কোনো কথা বলেন না। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেতনও অনেক কম। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভেদে শিক্ষকদের বেতন কাঠামোয় যথেষ্ট ব্যবধান রয়েছে। বিদ্যালয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকের সংখ্যা বাড়লেও, নির্ধারিত সময়ে তাদের বেতন পরিশোধ করা হচ্ছে না; সরকারি-বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন ও জীবনযাত্রার মানে স্পষ্ট ব্যবধান রয়েছে। সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের দুই ঈদে পুরো বোনাস দেওয়া হয়, যেখানে বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকরা তাদের মূল বেতনের ৫০ শতাংশেরও কম উৎসব বোনাস হিসাবে পান। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নেই। সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে চাকরি পেতে শিক্ষকদের ঘুস দিতে হয়। দেশের জনগণের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে; তবে সবার ক্ষেত্রে তা একরকম নয়। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ এ উন্নয়নের সুবিধাভোগী। বরং আয়-বৈষম্য আগের চেয়েও বেড়েছে। ন্যূনতম আয় আগের চেয়ে বাড়লেও, বাড়তি ব্যয়ের কারণে সঞ্চয় থাকছে না। ফলে গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দারা অর্থনৈতিক সচ্ছলতার আশায় শহরমুখী হচ্ছেন। সমাজের নিম্ন-আয়ের পরিবারের শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়ে শিশুশ্রমে বাধ্য হচ্ছে। বাংলাদেশের সরকার বা শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কারও পক্ষেই ফোর্তালেজার প্রস্তাব বা নির্দেশনা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার উপায় নেই।

লেখাটি শেষ করব জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তেনিও গুতেরেসের উদ্ধৃতি দিয়ে : ‘শিক্ষা হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একক বিনিয়োগ, যা যে কোনো দেশের পক্ষে সম্ভব। এ বিনিয়োগ তার জনগণ ও তাদের ভবিষ্যতের জন্য। এ নিয়ে আমাদের এখনই আলোচনা শুরু করা দরকার। আসুন শিক্ষার বৈশ্বিক সংকট নিরসনে সবাই ঐক্যবদ্ধ হই।’

অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ : ব্যক্তি-সদস্য, এশিয়া সাউথ প্যাসিফিক অ্যাসোসিয়েশন ফর বেসিক অ্যান্ড অ্যাডাল্ট এডুকেশন; সদস্য, এডুকেশন ওয়াচ

principalqfahmed@yahoo.com

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম