এক জায়গায় সব রোগের চিকিৎসা
ডা. মো. ফয়জুল ইসলাম চৌধুরী
প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আমাদের দেশ একদিকে চিকিৎসাব্যবস্থায় এগিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে বিভিন্ন কারণে চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তায় নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে। চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তায় নতুন মাত্রা যোগ হওয়ার কারণগুলো হলো :
১. আমাদের গড় আয়ু বেড়েছে। অর্থাৎ দেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে রোগব্যাধিও। অন্যদিকে বয়স্ক মানুষের কর্মক্ষমতা কমে যায়। উপার্জনে অক্ষম হয়ে পড়ে। অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় তার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একই স্থানে সব রোগের চিকিৎসা পাওয়া। ‘ইন্টারনাল মেডিসিন ইনস্টিটিউট’ হবে এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে একজন রোগী একসঙ্গে সব রোগের চিকিৎসা পাবে।
২. বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের রোগ একসঙ্গে আসে। এ পর্যন্ত আমরা মুখোমুখি হয়েছি ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়া, বার্ডস ফ্লু এবং কোভিড-১৯ নামক রোগের। চিকনগুনিয়া, ডেঙ্গু ও কোভিডের সংক্রমণ ভুলে যাওয়ার নয়। আমাদের দেশের যে পরিবেশ, তাতে এসব রোগ আরও বড় আকারে আসার সমূহ আশঙ্কা আছে। এ রোগীদের চিকিৎসা করেন ইন্টারনাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞরা। এ ধরনের রোগগুলোর চিকিৎসা হয় বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন ডিপার্টমেন্টে। ওই সময়ে যখন এ ধরনের রোগী ভর্তি হয়, তখন অন্য রোগীরা ভর্তি হতে পারে না। কর্তব্যরত চিকিৎসকদের ট্রেনিংয়েও ঘাটতি দেখা দেয়। তাই এ ধরনের রোগীদের চিকিৎসার জন্য একটি ইন্টারনাল মেডিসিন ইনস্টিটিউট এখন সময়ের দাবি।
৩. যারা একাধিক সিস্টেমের রোগে আক্রান্ত হন, তাদের হয়রানির সীমা থাকে না। যেমন, ধরা যাক আপনি চল্লিশ বছর বয়সের একজন রোগী। আপনার হৃদরোগ আছে। এর সঙ্গে আপনার সিরাম ক্রিয়েটিনিন বেড়ে গেছে। তার ওপর আপনি সম্প্রতি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়েছেন। পক্ষাঘাত চিকিৎসার জন্য আপনি ভর্তি হলেন নিউরোসায়েন্সে। কিন্তু ওখানে থেকে আপনি বাকি দুটি রোগের চিকিৎসা কিভাবে করবেন? একবার যেতে হবে এনআইসিভিডিতে, আরেকবার যেতে হবে নিকডোতে। ভেবে দেখেন আপনার অবস্থা! তখন আপনি অবশ্যই ভাববেন এমন সময় কি আসবে, যখন আমি একই বিছানায় শুয়ে থাকব আর সব ডিপার্টমেন্টের বিশেষজ্ঞরা আমাকে দেখতে আসবে। এমন একটি প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশে এখন প্রয়োজন, যেখানে রোগী একই বেডে থেকে সব বিশেষজ্ঞের চিকিৎসা পেয়ে যাবেন। ওই হাসপাতালে ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থা থাকবে, সিসিইউ থাকবে। হাসপাতালের প্রতিটি ইউনিটে সব ধরনের কনসালটেন্ট থাকবে। সবার ওপর থাকবে অধ্যাপক পদমর্যাদার একজন সিনিয়র চিকিৎসক। এটাই হবে ইন্টারনাল মেডিসিন ইনস্টিটিউট।
আমাদের দেশে অবশ্যই ইনডিভিজুয়াল ইনস্টিটিউটের প্রয়োজন আছে। ইনডিভিজুয়াল ইনস্টিটিউট বলতে আমি বোঝাতে চাচ্ছি হার্টের জন্য এনআইসিভিডি, কিডনির জন্য নিকডো, নিউরোর জন্য নিন্স, এলিমেন্টারির জন্য রাসেল গ্যাস্টো ইনস্টিটিউট, আরও অন্যান্য ইনস্টিটিউট। যদি একটি অর্গানের রোগ হয়, তাহলে সেখানে আপনার চিকিৎসা বাঞ্ছনীয়। যদি মাল্টি অর্গানের রোগ হয়, তাহলে সেই চিকিৎসার জন্য ইন্টারনাল মেডিসিনের বিকল্প নেই। এ চিন্তাধারা থেকেই বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিনের পক্ষ থেকে আমি ইন্টারনাল ইনস্টিটিউটের একটি কনসেপ্ট পেপার ২০১৫ সালে তৎকালীন স্বাস্থ্য সচিবের কাছে জমা দিই।
বস্তুত দেশে এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠা উচিত, যেখানে এক ছাতার নিচে রোগীরা সব অঙ্গের যথাযথ চিকিৎসা পাবেন। এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠানই হচ্ছে ইন্টারনাল মেডিসিন ইনস্টিটিউট। সেখানে মেডিসিনের একজন সিনিয়রের সঙ্গে অন্যান্য অঙ্গের বিশেষজ্ঞরা মিলে একটি টিম হিসাবে কাজ করবেন। প্রতিদিন ওই রোগীকে সবাই দেখবে, রোগীর আর কোথাও যেতে হবে না। যদি কোনো ইন্টারভেনশন প্রয়োজন হয়, যেমন-ডায়ালাইসিস, তাহলে প্রতিষ্ঠানের কর্নারে ডায়ালাইসিস থাকবে, যেখানে রোগী ডায়ালাইসিস নেবে। সেখানে সিসিইউ কর্নার থাকবে, যখন প্রয়োজন হয় রোগী সিসিউতে যাবে। অর্থাৎ পুরো চিকিৎসাব্যবস্থা হবে comprehensive ও holistic।
আমাদের ব্রত : ১. একাধিক রোগে আক্রান্ত রোগীকে এক বিছানায় রেখে একাধিক বিশেষজ্ঞ দ্বারা চিকিৎসা করা। ২. স্বল্প সময়ে, স্বল্প খরচে, স্বল্প ঝামেলায় একজন রোগীর সর্বোচ্চ সুবিধা। ৩. সমন্বিত যত্নের আলোকে ইন্টারনাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞদের প্রশিক্ষণ ও মানোন্নয়নের ব্যবস্থা করা। ৪. উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থার আলোকে অবিরত গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া। ৫. উচ্চতর একাডেমিক ডিগ্রি প্রদান করা : ইন্টারনাল মেডিসিনে এমডি প্রদান করা। ৬. এফসিপিএস ডিগ্রির প্রস্তুতির জন্য পর্যাপ্ত ও নির্ভরযোগ্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। ৭. একিউট মেডিসিনের চিকিৎসার জন্য নতুন এভিনিউ উন্মোচন করা। ৮. ইমার্জেন্সি মেডিসিনের চিকিৎসার প্রশস্ত দ্বার উন্মোচন করা। ৯. বিশেষ বিশেষ সময়কালীন রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। যেমন-বার্ডস ফ্লু, চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু, ইবোলা, নিপা ভাইরাস, কোভিডসহ নানা জটিল রোগ। ১০. আরও অজানা, অব্যাখ্যাত সমস্যার সমাধান করা। ১১. জেরিয়াট্রিক মেডিসিনের ব্যবস্থা করা। উল্লেখ্য, দেশে এখনো এ সমস্যাগুলোর যথোপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। তাছাড়া প্রবীণ রোগীদের বিশেষভাবে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কোনো ব্যবস্থা এখনো গড়ে ওঠেনি।
দেশে ইন্টারনাল মেডিসিনের জন্য সর্বাঙ্গীণ ও সমন্বিত তেমন কোনো গবেষণাকেন্দ্র নেই। মেডিকেল কলেজগুলোতে যা আছে, তা দিয়ে ইন্টারনাল মেডিসিনের গষেষণা পূর্ণমাত্রায় সম্পন্ন হয় না। কারণ বিভিন্ন সাব-স্পেশালিটি রোগী মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি হন না। বিশ্বায়নের কারণে নতুন নতুন রোগের আবির্ভাব হচ্ছে। রোগের ইপিডিমিওলোজি ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত হচ্ছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নয়নে এসব ব্যাপারে গবেষণা জরুরি। তাই একটি মানসম্মত গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার এখনই সময়। ওই গবেষণাকেন্দ্রটি হবে ইন্টারনাল মেডিসিন ইনস্টিটিউট।
পরিশেষে বলতে হয় সেবা, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও গবেষণার ওপর ভিত্তি করে আমাদের দেশে এমন একটি প্রতিষ্ঠানের আশু প্রয়োজন।
অধ্যাপক ডা. মো. ফয়জুল ইসলাম চৌধুরী : সাবেক ইউনিট প্রধান, মেডিসিন বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল