শিক্ষাক্ষেত্রে ভালো কিছু হওয়া চাই
বিমল সরকার
প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
কেবল বাংলাদেশে নয়, গোটা উপমহাদেশেই ইংরেজি তথা আধুনিক শিক্ষার প্রচলন করেছে ইংরেজরা। শিক্ষাবিষয়ক বিভিন্ন আইনকানুন ও বিধিবিধানেরও প্রবর্তক মূলত তারাই। ইংরেজ প্রণীত এসব আইনকানুন ও বিধিবিধানের ওপর ভিত্তি করেই প্রধানত আমাদের অঞ্চলে সময় সময় বিভিন্ন স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে ও পরিচালিত হয়ে আসছে। প্রায় ২০০ বছর শাসন করে দেশ থেকে ইংরেজ বিদায়ের পর আমরা নতুন করে পাকিস্তানি শাসনের বেড়াজালে আটকে ছিলাম আরও চব্বিশটি বছর। লক্ষ্য করার বিষয় হলো; কেবল শিক্ষাক্ষেত্রে নয়, অন্যসব ক্ষেত্রেও একেবারে শুরু থেকে এ পর্যন্ত আমরা ইংরেজ প্রণীত আইনকানুনগুলোর খুব একটা রদবদল বা সংস্কার করতে পারিনি। রদবদল বা সংস্কার ও নতুন আইনকানুন বা ব্যবস্থার প্রবর্তন একেবারেই যে হয়নি, তা অবশ্য নয়। হয়েছে নিশ্চয়ই। তবে এও সত্য যে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছাড়া রদবদল বা সংস্কার এবং নতুন কিছু করার নামে যখন যেখানেই হাত দেওয়া হয়েছে, সেখানেই কোনো না কোনোভাবে হোঁচট খেতে হয়েছে। এসবের ফলে সৃষ্টি হয়েছে এবং এখনো হয়েই চলেছে নানা ধরনের বিপত্তির। দেখা গেছে, কোনো একটি বিষয়ে আইন বা নির্দেশনা জারি করা হলো, কয়েকদিন যেতে না যেতেই আইনটি বলবৎ বা নির্দেশনাটি কার্যকর করার আগেই তা সংশোধন করতে হয়েছে। অতীতে তো বটেই, এমনকি সাম্প্রতিককালেও এমন অনেক উদাহরণ সবার সামনেই রয়েছে।
২.
নিবন্ধটি তৈরি করতে গিয়ে ব্যঙ্গাত্মক রচনায় সিদ্ধহস্ত বরেণ্য কবি, নাট্যকার ও গীতিকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে (১৯৬৩-১৯১৩) শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। বাংলা কবিতায় নতুন ধরনের আঙ্গিক ও ছন্দের সৃষ্টি এবং কবিতা, নাটক ও গান রচনায় ব্যঙ্গবিদ্রুপ ও হাস্যরসাত্মক বিষয়বস্তুর জন্য তিনি খ্যাতিমান। এ মহাজনের আয়ুষ্কাল ছিল মাত্র পঞ্চাশ বছর। একশ বছরের বেশি সময় গত হয়েছে, তিনি পরলোকগমন করেছেন। কিন্তু তার রচনাগুলোর পাশাপাশি তিনি নিজেও বাংলাভাষী মানুষের মাঝে জাগরূক হয়ে রয়েছেন। ‘নতুন কিছু করো’ শিরোনামে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের একটি বিখ্যাত ব্যঙ্গাত্মক কবিতা রয়েছে। পাঁচটি ধাপে বিভক্ত মোট ৫৩ লাইনের কবিতাটির শুরুটা ঠিক এভাবে-‘নতুন কিছু করো,/একটা নতুন কিছু করো।/নাকগুলো সব কাটো,/কানগুলো সব ছাঁটো;/পাগুলো সব উঁচু করে,/মাথা দিয়ে হাঁটো;/হামাগুড়ি দাও, লাফাও,/ডিগবাজি খাও, ওড়ো;/কিম্বা চিৎপাত হয়ে- /পাগুলো সব ছোড়ো;/ঘোড়াগাড়ি ছেড়ে এখন/বাইসাইকেলে চড়ো,/-নতুন কিছু করো,/একটা নতুন কিছু করো।’
৩.
দিন যায়, কথা থাকে। শিক্ষাক্ষেত্রে সময় সময় খামখেয়ালিপনায় অনেক ক্ষতি হয়েছে আমাদের। এক্ষেত্রে রয়েছে সংশয়-সন্দেহ, অনাস্থা-অবিশ্বাস। আর রয়েছে মাত্রাতিরিক্ত আবেগ, যা বেশির ভাগ সময়ই ক্ষতির কারণ। আবেগও ভালো ফলদায়ক হতে পারে, তবে এর পেছনে উপযুক্ত যুক্তি থাকা চাই। মিথ্যা বাগাড়ম্বর, অযথা আত্মতুষ্টি ও জেদের কারণেও আমরা দিনে দিনে অনেকদূর পিছিয়ে পড়ি।
সচেতনতা সবার মাঝেই থাকার কথা। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের (২০০১-২০০৬) পুরো মেয়াদেই শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন ড. এম ওসমান ফারুক। ২০০৪ সালে মাধ্যমিক স্তরে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ নিয়ে চারদিকে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। সর্বত্র তোলপাড়। শিক্ষাবিদসহ সচেতন মহল এর বিপক্ষে অবস্থান নিলে শেষ পর্যন্ত সরকারকে পিছু হটে তা বাতিল করতে হয়। তবে এ খাতে সেসময় কোটি কোটি টাকা লুটপাট ও অপচয় হওয়ার বিষয়টি সচেতন কারও অজানা নয়। শিক্ষা নিয়ে সরকারের অপরিণামদর্শিতা বা সিদ্ধান্তহীনতার কারণে নতুন বছরে (২০০৫) পাঠ্যপুস্তক নিয়েও বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি হয়। এ কারণে সেই বছরের শুরুতে বই হাতে পায়নি মাধ্যমিক স্তরের লাখ লাখ কোমলমতি শিক্ষার্থী। ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবির জন্য এটিকেও মোটা দাগে দায়ী করা হয়।
৪.
জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পদচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার তিন মেয়াদে শিক্ষাক্ষেত্রে বেশকিছু উন্নয়ন তথা পরিবর্তন সাধন করে। কিন্তু বিদায় হওয়ার আগে, বিশেষ করে ২০২৩ ও ২০২৪ সালে মাধ্যমিক স্তরে নতুন কারিকুলাম চালু করতে গিয়ে বেশকিছু বিপত্তি ঘটিয়ে যায়। অর্থনীতি ও রাজনীতিসহ অন্যসব ক্ষেত্রে যেমনই হোক, নতুন এ কারিকুলাম বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকার জনগণের মুখোমুখী হয়ে পড়ে। গোটা এক কিংবা দেড়টি বছর শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাটে সীমাহীন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা; এককথায় চরম অনিশ্চয়তায়। এ নিয়ে শিক্ষার্থী-অভিভাবক তথা সচেতন মহল প্রতিবাদ ও ক্ষোভ প্রকাশ করলেও সরকারযন্ত্র একেবারে নাছোড়বান্দা-যে করেই হোক তা বাস্তবায়ন করবেই, করেই ছাড়বে! দেশের সর্বত্র শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রতিবাদ, ক্ষোভ ও আহাজারিও সরকার দেখে না দেখার ভান করেছে। এ খাতে প্রচুর টাকা ব্যয়-অপচয় হয়েছে। স্তাবকরা সরকারের পক্ষে কেবল ঢাকঢোলই বাজিয়ে গেছেন!
নতুন কারিকুলামে (বাতিলকৃত) এসএসসিতে আগের গ্রেডিং সিস্টেমের বদলে চালু করা হয়েছিল নতুন গ্রেডিং সিস্টেম। কিছুদিন আগে বলা হয়েছিল ‘ত্রিভুজ’, ‘বৃত্ত’ ও ‘চতুর্ভুজ’ এমনসব দিয়ে শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন করা হবে। শেষদিকে আর সেটিও থাকেনি। বলা হয়, মূল্যায়ন হবে সাত ধাপে। যেমন-‘অনন্য’, ‘অর্জনমুখী’, ‘অগ্রগামী’, ‘সক্রিয়’, ‘অনুসন্ধানী’, ‘বিকাশমান’ ও ‘প্রারম্ভিক’। এ যেন ‘নতুন মদ পুরোনো বোতলে ভরার’ মতো। ব্যাখ্যায় বলা হলো-আগের ‘এ প্লাস’ মানে বর্তমান অনন্য। তেমনই আগের ‘এ’ বর্তমানে অর্জনমুখী, ‘এ মাইনাস’ অগ্রগামী, ‘বি’ মানে সক্রিয়, ‘সি’ অর্থাৎ অনুসন্ধানী, ‘ডি’ হলো বিকাশমান ও আগের ‘এফ’ মানে বর্তমান প্রারম্ভিক।’
আহারে, কী চমৎকার বন্দোবস্ত! কী সুন্দর নামকরণ। লেখার শুরুতেই উল্লেখ করেছি যে, আমাদের দেশে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তক ইংরেজরা। পরীক্ষা গ্রহণ, পাশ-ফেল নির্ধারণ ও ডিভিশনেরও (ফার্স্ট, সেকেন্ড ও থার্ড ডিভিশন) প্রবর্তক তারাই। তবে পাশ কিংবা ফেল বুঝতে পারলেও এদেশের বেশির ভাগ মানুষেরই ‘ডিভিশন’ বুঝতে বেশ সময় লেগেছিল। ২০০১ সালে পরীক্ষায় ডিভিশনের বদলে গ্রেডিং সিস্টেম তথা ‘এ প্লাস’, ‘এ’, ‘বি’, ‘সি’, ‘ডি’ ইত্যাদি চালু করা হলো। গত বিশ-বাইশ বছরেও কত নম্বর পেলে কিংবা না পেলে কী গ্রেড হয়, তা ভালো করে বুঝতে না বুঝতেই আবারও পরিবর্তন (অনন্য, অর্জনমুখী, অগ্রগামী)। নতুন সরকার এসে উল্লিখিত কারিকুলাম বাতিল না করলে, আমার তো মনে হয় ‘অনন্য-প্রারম্ভিক’ বোঝা ও বোঝানোর জন্য আলাদা টিউটর রাখার দরকার হতো। আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় আসে না, এসব কাদের মস্তিষ্কপ্রসূত? সমাজের বড় একটি অংশ এখনো শিক্ষিত কিংবা সচেতন নয়। ফলে দৃশ্যটা সহজেই কল্পনা করা যায়; স্কুলে পরীক্ষার ফল প্রকাশ হলো, ছেলে বা মেয়েটি বাড়ি গেলে বাবা-মা জানতে চাইলেন-ফলাফল কী? শিক্ষার্থী জানাল, ‘অর্জনমুখী’ কিংবা ‘প্রারম্ভিক’। পাশের বাড়ির কেউ এসে বললেন, আমার মেয়েটা পরীক্ষায় ‘অনুসন্ধানী’ পেয়েছে। ঠিক এমনই ‘অগ্রগামী’, ‘সক্রিয়’, ‘বিকাশমান’।
এ বিড়ম্বনা ও ক্ষতির জবাব কী? নেশা, নতুন কিছু করার নেশা। আসলে ভালো কিছু করতে হলে যেমন স্বচ্ছ একটি মগজ লাগে, ভালো একটি মনেরও দরকার। তা না হলে হবে না। কর্তাব্যক্তিদের নতুন কিছু করার নেশা থেকে আমাদের হতভাগ্য শিক্ষার্থীদের কবে যে মুক্তি ঘটবে?
বিমল সরকার : কলাম লেখক ও অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক