বিশ্ববিদ্যালয়ে অযোগ্যদের নিয়োগ কাম্য নয়
ড. এমএলআর সরকার
প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
অন্তর্বর্তী সরকার প্রশাসন থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ প্রদান করেছে এবং করছে। কিন্তু নিয়োগ বা অন্য যা কিছু হচ্ছে, তা হচ্ছে সংস্কারবিহীন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকেন্দ্রিক। অর্থাৎ নিয়োগ, শাস্তি, অপসারণ সবকিছুই হচ্ছে সরকারের ইচ্ছায়। কে কীভাবে বা কাকে কিরূপে পুরস্কার বা শাস্তি দেওয়া হচ্ছে তার সঠিক ব্যাখ্যা বা জবাবদিহি নেই। হ্যাঁ, অতীতে এরূপ ছিল, কিন্তু এবার কি এরকম হওয়ার কথা ছিল? দেখতে দেখতে প্রায় দুমাস চলে গেল। তথাপি কাঠামোগত নিয়ম বা নীতি প্রতিষ্ঠার কোনো ব্যবস্থা অদ্যাবধি পরিলক্ষিত হয়নি। যতদূর শুনেছি, এ ব্যাপারে কাজ চলছে এবং কাজ শেষ হতে সময় লাগবে।
আমাদের অবশ্যই মেনে নিতে হবে যে, প্রশাসনিক সংস্কার একটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই সে ব্যাপারে আর কোনো প্রশ্নের অবতারণা করার অবকাশ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কিছু নিয়োগ, যেমন বিশ্ববিদ্যালয়, ইউজিসি, পিএসসি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তি নিয়োগের আগে পরিপূর্ণ না হোক, একটি রূপরেখা তৈরি করা কি অসম্ভব ছিল? না, বিষয়টি অসম্ভব ছিল বলে মনে হয় না! বরং একটি ভালো সুযোগ ছিল, কিন্তু সেই সুযোগটি গ্রহণ করা হয়নি বা করা যায়নি। কেন যায়নি বা হয়নি তা কর্তারাই বলতে পারবেন!
সংস্কার হয়নি, তবে অনেকটা সময় নিয়ে এবং চিন্তাভাবনা করে বিশ্ববিদ্যালয়, ইউজিসি, পিএসসি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। শিক্ষা উপদেষ্টা মহোদয় বলেছেন, তিনি প্রত্যেকটি জীবনবৃত্তান্ত ভালোভাবে দেখে তবেই নিয়োগ দিয়েছেন। তাকে যে কঠোর পরিশ্রম করতে হচ্ছে, সে বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই। নজিরবিহীনভাবে অনেক মেধাবী শিক্ষক এবার এসব গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পেয়েছেন। এ কাজের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার এবং উপদেষ্টা মহোদয়কে ধন্যবাদ না জানালে তাদের প্রতি অবিচার করা হবে। আমিও তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি এবং নিয়োগপ্রাপ্তদের সফলতা কামনা করছি।
কিন্তু এত সুন্দর কাজেও যে বিশাল এক অসামঞ্জস্য বা অতৃপ্তি রয়েছে, তার প্রতিফলন হচ্ছে শিক্ষা উপদেষ্টার মন্তব্য-সব শিক্ষকই উপাচার্য হতে চায়! একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করলে অবশ্য সেই প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদে যাওয়ার ইচ্ছা সবারই থাকতে পারে। সেই বিবেচনায়, যদি সব শিক্ষকই উপাচার্য হতে চান, তাতে কি দোষের কিছু আছে? না, দোষের কিছুই নেই। কিন্তু একথা বলা প্রয়োজন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক সম্মানিত শিক্ষক আছেন, যারা জ্ঞানে-গুণে অতুলনীয়, কিন্তু তারা অতীতে উপাচার্য হতে চাননি এবং বর্তমানেও চাচ্ছেন না এবং বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতেও উপাচার্য হতে চাইবেন না।
প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কেন শিক্ষা উপদেষ্টা এরকম কথা বলেছেন? বিশ্ববিদ্যালগুলো এ ঘুণে ধরা সমাজের অংশ। সংখ্যায় কম হলেও এখানেও লোভী বা অযোগ্য শিক্ষক আছেন। যারা এসব পদে নিয়োগ পাওয়ার জন্য অতীতেও তদবির করছে এবং বর্তমান সময়েও তদবির করবেন, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। এই তদবিরবাজরা স্রোতের মতো নানা মাধ্যমে বা নানারূপে শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে ধরনা দিয়েছে বা দিচ্ছে, তাই তার মনে হয়েছে সবাই উপাচার্য হতে চায়। অযোগ্যরা সুযোগ নিতে চাইবেই। কিন্তু কথা হচ্ছে, অযোগ্যরা যাতে সুযোগ না নিতে পারে, সে জন্য কি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে?
অনেকভাবেই এ অযোগ্যদের প্রতিরোধ করা যেত; কিন্তু তা করা হয়নি। অনেকেই মনে করে, এবারের অনাসৃষ্টির জন্য দায়ী হচ্ছে একটি সুষ্ঠু নীতিমালার অভাব। প্রথম থেকেই উপাচার্য বা এ ধরনের পদে নিয়োগ প্রদানের ক্ষেত্রে একটি স্বচ্ছ নীতিমালা তৈরির জন্য নানা ধরনের সুপারিশ পত্রপত্রিকায় বা অন্য মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। আমি নিজেও লিখেছিলাম। সবাই ভেবেছিল, নতুন কিছু একটা হবে। দুর্ভাগ্যজনক যে, এত কথা হলো, এত লেখালিখি হলো, কিন্তু কাজের বেলায় কিছুই হলো না। হ্যাঁ, বলতেই হবে যে, কিছু মেধাবী শিক্ষক স্থান পেয়েছেন, কিন্তু নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আস্থার সংকট প্রকট হয়েছে।
যাদের এ পর্যন্ত নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে, তাদের বয়স, অভিজ্ঞতা, ডিগ্রি, প্রকাশনা, সাইটেশন, কর্মক্ষেত্র ইত্যাদি বিশ্লেষণ করলে সহজেই পরিলক্ষিত হয়, সবকিছুই হয়েছে থোক বরাদ্দের মতো বা ইচ্ছাধীন। বয়স চল্লিশের কম থেকে ষাটোর্ধ্ব। প্রশাসনিক দীর্ঘ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন থেকে অভিজ্ঞতাবিহীন। ডিগ্রি কেমব্রিজ থেকে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়। প্রকাশনা শতাধিক থেকে ২৫ বা ২৬টি। সাইটেশন হাজার দশেক থেকে দুই বা চার হাজার। কর্মক্ষেত্র একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই কয়েক হালি এবং একই বিভাগ থেকে একাধিক।
হতাশ হয়ে বলতেই হচ্ছে, যোগ্যতার কোনো মাপকাঠিই ঠিক নেই! সব ক্ষেত্রেই রয়েছে এক অপরিসীম অসামঞ্জস্যতা। হ্যাঁ, নিয়োগ দিতে গেলে অবশ্যই কিছু হেরফের হতে পারে। কিন্তু আকাশ-পাতাল পার্থক্য হওয়ার কারণ কী? আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কি যোগ্য এবং অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষকের অভাব রয়েছে? না, এখনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়েনি। তাহলে তো বলতেই হবে যে, ইচ্ছাকৃতভাবেই যোগ্যতার কোনো মাপকাঠি ঠিক করা হয়নি। নিজের পছন্দমতো যাকে খুশি তাকে নিয়োগ প্রদান করার জন্য এটি করা হয়েছে।
কথা হচ্ছে, আমরা এ ধরনের নিয়োগকে কী বলব? আর যাই বলি, সুষ্ঠু বা নিয়মতান্ত্রিক নিয়োগ বলার কি কোনো অবকাশ রয়েছে? এ হযবরল অবস্থা দেখে সুযোগসন্ধানীরা যদি ভিড় করে, তাহলে কি তাদের দোষ দেওয়া যায়? অনেকেই মনে করে, সুযোগসন্ধানীরা ঠিকই বুঝতে পারছে যে, শুধু যোগ্য নয়, তদবিরের মাধ্যমে কেউ না কেউ নিয়োগ পাচ্ছেন। তাই তো তারাও তদবির করছে, আর দোষ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসমাজের। দোষ হচ্ছে নিয়মের; কিন্তু শাস্তি ভোগ করছি আমরা শিক্ষকরা।
উপদেষ্টা মহোদয়, বলুন তো, যোগ্যতার মাপকাঠি নির্ধারণ করে একটি নীতিমালার মাধ্যমে যদি এ নিয়োগগুলো সম্পন্ন করা হতো, তাহলে কি দেশের ক্ষতি হতো? যাদের আপনি নিয়োগ দিয়েছেন, তারা কি বাদ পড়ত? আমি মনে করি, এভাবে নিয়োগ হলে দেশের ক্ষতি হতো না এবং যারা নিয়োগ পেয়েছেন তাদের সবাই বাদ পড়ত না। কয়েকজন হয়তো বাদ পড়ত। কিন্তু ভবিষ্যতের দ্বার তাদের জন্য খোলা থাকত। অন্তর্বর্তী সরকার তথা আপনার সুনাম বাড়ত এবং সরকারের ওপর মানুষের আস্থা বৃদ্ধি পেত। প্রশ্ন হচ্ছে, তা না করে কেন মাত্র কয়জনের জন্য এ নিয়োগ প্রক্রিয়াকে বিতর্কিত করার প্রয়োজন হলো?
দুঃখজনক যে, সংস্কারের জন্য এতগুলো প্রাণ গেল, সেই সংস্কার যেমন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বাস্তবায়িত হয়নি, অনুরূপভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়ও সংস্কার প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। উপাচার্যরা তাদের ইচ্ছামতোই যাকে খুশি তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে নিয়োগ প্রদান করেছেন বা করছেন। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক প্রশাসনিক পদ রয়েছে। ইচ্ছা করলেই একটি নীতিমালা তৈরি করা যায়। যে নীতিমালার মাধ্যমে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক এবং প্রভাষকদের জ্যেষ্ঠতার নিরিখে বিভাগভিত্তিক বা অনুষদভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করা যেত। এভাবে কাজ করলে উপাচার্যদের সম্মান নষ্ট হতো না এবং কাজের অসুবিধা হতো না। কিন্তু তারা তাদের গণ্ডির বাইরে যেতে চাননি বা পারেননি।
দায়িত্ব নেওয়ার পর শিক্ষা উপদেষ্টা মহোদয় বলেছেন, ‘আমরা চাইব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সত্যিকারের শিক্ষানুরাগী ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি আসুক।’ কথাগুলো ছিল খুবই আশা উদ্দীপক এবং দলনিরপেক্ষ। একটি সরকারের জন্য এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ ছিল সত্যিই একটি অমূল্য সুযোগ। প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তার আশা কতটুকু পূরণ হয়েছে, তা তিনিই বলতে পারবেন তবে জনগণের আশা হচ্ছে, ভবিষ্যতের জন্য একটি নিয়োগ নীতিমালা, সেটি পূরণ হয়নি!
ধরে নিলাম সময় এবং প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে নীতিমালা ছাড়াই এতগুলো নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, এভাবেই কি ভবিষ্যতে উপাচার্য বা অন্য পদে নিয়োগ হবে? এভাবেই কি উপাচার্যরা তাদের ইচ্ছামতো যাকে খুশি তাকে নিয়োগ দিবেন? আমরা হতাশ, কিন্তু এ থেকে আমাদের পরিত্রাণ পেতেই হবে। সময় থাকতেই বিশ্ববিদ্যালয়, ইউজিসি, পিএসসি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের নিয়োগ প্রদানের জন্য একটি লিখিত নীতিমালা আমাদের অবশ্যই তৈরি করতে হবে। যোগ্যতার মাপকাঠি অনুযায়ী নিয়োগই হচ্ছে নিয়ম এবং এটিই সর্বত্র বিদ্যমান। কিন্তু আমাদের তা নেই, তাই তো এই নৈরাজ্য!
অনেক বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে যোগ্যতার মাপকাঠি তৈরি করা যেতে পারে। বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাবনা ইতোমধ্যে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। উপদেষ্টা মহোদয় নিজেও একজন শিক্ষক ছিলেন। তাই বিষয়টি যে তার অজানা, তা মনে হওয়ার কোনো কারণ নেই। বয়স, অভিজ্ঞতা, ডিগ্রি, প্রকাশনা, সাইটেশন ইত্যাদি বিষয় হতে পারে এ নীতিমালার ভিত্তি। নীতিমালাটিকে অধিকতর গ্রহণযোগ্য এবং কার্যকর করতে সংশ্লিষ্ট মহলের মতামত গ্রহণ করাই হবে শ্রেয়। এক্ষেত্রে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, নীতিমালায় যোগ্যতার শর্তগুলো হতে হবে কঠোর এবং স্পষ্ট।
পরিশেষে এটি বলা প্রয়োজন, শুধু নীতিমালা তৈরি করলেই চলবে না, নীতিমালা অনুযায়ী যাতে যোগ্য কর্তাব্যক্তি নিয়োগপ্রাপ্ত হন, সেজন্য যথাযথ প্রচার এবং আবেদন/জীবনবৃত্তান্ত জমার প্ল্যাটফরম প্রয়োজন। এ ব্যবস্থা করলে শিক্ষকরা সসম্মানে তাদের আবেদন বা জীবনবৃত্তান্ত যথাযথ স্থানে পাঠাতে পারবেন। জীবনবৃত্তান্ত পাঠানোর বর্তমান প্রক্রিয়াটি যোগ্যতাসম্পন্ন অনেক শিক্ষকের জন্য অত্যন্ত অপমানজনক। একজন যোগ্য শিক্ষক কেন অন্য মাধ্যমে তাদের জীবনবৃত্তান্ত পাঠাবেন? কেন তাদের অন্যের মুখাপেক্ষী হতে হবে? এ নিয়ে অনেক কথা অনেকে বলেছেন, কিন্তু অদ্যাবধি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। আশা করি, নিয়োগ নীতিমালা তৈরির সময় এ বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা থাকবে।
ড. এমএলআর সরকার : প্রফেসর, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
lrsarker@yahoo.com