সোনার হরিণ কত কাছে অথবা দূরে?
মো. ফিরোজ মিয়া
প্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রজাতন্ত্রের চাকরি যেন সোনার হরিণ। জাতির শিক্ষিত জনগোষ্ঠী ছুটছে এ সোনার হরিণের পেছনে। সবারই একটাই চাওয়া, আমার সোনার হরিণ চাই। জাতির যুবশ্রেণির প্রায় শতভাগই ৯ থেকে ১২ বছরেরও বেশি সময় ধরে এ সোনার হরিণের পেছনে অক্লান্তভাবে ছুটছেন তো ছুটছেনই। কোনোরকম ক্লান্তিই তাদের থামাতে পারে না। কিন্তু নির্ধারিত বয়সের সীমাবদ্ধতার কারণে যখন তারা থামতে বাধ্য হয়, তখন একরাশ হতাশা ও ক্লান্তির অবসাদে ভোগেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনোরকম কর্মোদ্দীপনা আর তাদের মাঝে অবশিষ্ট থাকে না, যা সমাজ ও রাষ্ট্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
এখন প্রশ্ন হলো, সোনার হরিণের পেছনে ছোটার সময় আরও বাড়িয়ে শিক্ষিত বেকারের দীর্ঘ লাইনকে আরও দীর্ঘতর করা এবং হতাশা ও ক্লান্তির অবসাদে ভোগা শিক্ষিত যুবকের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করা কতটা যৌক্তিক। এ ছাড়া সোনার হরিণের পেছনে আরও পাঁচ-সাত বছর বেশি সময় দৌড়ানোর সুযোগ দেওয়া জাতির জন্য আদৌ মঙ্গলজনক হবে কিনা, তা-ও ভেবে দেখতে হবে।
ভাবতে হবে সরকারি পদের সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত হওয়ায় প্রায় নিরানব্বই শতাংশ যুবকই সোনার হরিণ ধরতে না পেরে হতাশায় নিমজ্জিত হবে। এ হতাশাগ্রস্ত ও ক্লান্ত যুবশ্রেণির জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় সোনার হরিণের পেছনে চলে যাওয়ার পর তাদের অধিকাংশের পক্ষেই হয়তো সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বাভাবিক কর্মধারায় ফেরা কঠিন হয়ে পড়বে। বৃহত্তর যুবশ্রেণির এ হতাশা ও ক্লান্তি সমাজে কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলবে কিনা, তা ভেবে দেখতে হবে। এ বিষয়ে যেহেতু কোনো গবেষণা নেই, সেজন্য যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সমাজ ও রাষ্ট্রে এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো আরও গভীরভাবে পর্যালোচনার দাবি রাখে।
করোনা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দীর্ঘদিন নিয়োগ প্রায় বন্ধই ছিল। এছাড়া কিছুটা হলেও সেশনজট ছিল। এছাড়া কোটা প্রথার কারণেও অনেক মেধাবী চাকরিপ্রাপ্তিতে বঞ্চিত হয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগের জন্যও অনেকে বঞ্চিত হয়েছে। এসব বিবেচনায় সাময়িকভাবে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি অত্যন্ত যৌক্তিক।
ক্যাডার সার্ভিসে নিয়োগের ক্ষেত্রে আরও দুই বা তিনটি বিসিএস পর্যন্ত এ বয়স বৃদ্ধির যৌক্তিকতা আছে। কিন্তু স্থায়ীভাবে বয়স বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনার ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনের ধারণক্ষমতা, চাকরি প্রার্থীর সংখ্যা, চাকরি প্রার্থীর সংখ্যাধিক্যের কারণে নিয়োগ প্রক্রিয়ার ব্যবস্থাপনাসহ সার্বিক বিষয় বিবেচনার প্রয়োজন হবে। তবে সাধারণপ্রার্থীদের স্থায়ীভাবে বয়স বৃদ্ধির চেয়ে প্রতিবন্ধী, তৃতীয় লিঙ্গ ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বয়স স্থায়ীভাবে বৃদ্ধির দাবি অধিক যৌক্তিক।
স্থায়ীভাবে বয়স বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কতগুলো বিষয়কে বিবেচনায় নিতে হবে। যেমন যেসব পদের শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি থেকে এইচএসসি বা সমমান পর্যন্ত। বিদ্যমান বয়সসীমা অনুযায়ী ওই সব পদে আবেদনের যোগ্যতা অর্জিত হয় আঠার বছর বয়স পূর্তিতেই। এরপর সোনার হরিণের পেছনে ছোটার সময় পায় প্রায় ১২ বছর। এসব পদের অধিকাংশের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে শারীরিক সক্ষমতার বিষয়টিও অনেক সময় অধিক গুরুত্ব বহন করে। এ অবস্থায় এসব পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বয়স বৃদ্ধির যৌক্তিকতার বিষয়টি গভীরভাবে পর্যালোচনার দাবি রাখে। কেননা এ পর্যায়ে তাদের সোনার হরিণের পেছনে ছোটার পথরোধ করে তাদের উৎপাদনমুখী কর্মের দিকে ধাবিত করলে তা জাতির জন্য অধিক মঙ্গলজনক হবে বলেই মনে হয়।
নবম গ্রেডের সাধারণ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে উচ্চতর ডিগ্রির প্রয়োজন হওয়ায় তারা সোনার হরিণের পেছনে ছোটা আরম্ভ করতে পারেন একুশ বছর বয়স থেকে। অর্থাৎ তারা সুযোগ পায় প্রায় আট-নয় বছর। উচ্চ শিক্ষিত যুবকের জন্য এ সময়টা যথেষ্ট কিনা, তা পর্যালোচনার দাবি রাখে। এছাড়া অনেক সরকারি পদ আছে, যেখানে আবেদনের বয়সসীমা একত্রিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর পর্যন্ত। এসব পদে আবেদনের সুযোগ থাকছেই। তবে বর্তমানে চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ সাধারণ বয়সসীমা ত্রিশ ও বত্রিশ বছর। দুটি বয়সসীমা না রেখে একটা বয়সসীমা রাখাই অধিক যৌক্তিক।
চাকরিতে প্রবেশের বয়স বৃদ্ধির বিষয়ে বাংলাদেশের বাস্তবতাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে উন্নত বিশ্বের উদাহরণ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের চাকরি বাজারের পরিধি এবং তাদের নিজস্ব জনবল সংকটের বিষয়টি ভাবা হয় না। উন্নত দেশগুলো নিজস্ব জনবল দিয়ে চাকরি বাজারের চাহিদা মেটাতে পারে না। তাদের চাকরি বাজারের চাহিদা মেটানোর জন্য অভিবাসীদের ওপর নির্ভর করতে হয়। উন্নত দেশের জনগণ সরকারি চাকরির পেছনে ছোটে না। উন্নত দেশে প্রয়োজনীয় জনবলের ঘাটতির কারণেই চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা এবং পাশাপাশি অবসরের বয়সসীমা উন্মুক্ত রাখা হয়। আমাদের দেশের চিত্র সম্পূর্ণ উলটো। লাখ লাখ শিক্ষিত বেকারের তুলনায় সরকারি নিয়োগযোগ্য পদের সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত। এ অবস্থায় বাংলাদেশের বাস্তবতার নিরিখেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ অধিক যৌক্তিক।
স্থায়ীভাবে বয়স বৃদ্ধি করা হলে দেশের শিক্ষিত বেকার শ্রেণি আরও দীর্ঘ সময় পর্যন্ত সরকারি চাকরি নামের সোনার হরিণের পেছনে ছুটতে থাকবে। স্বাভাবিকভাবেই এ সময়ে তারা নিজেরা স্বাবলম্বী হওয়ার বা দেশের উৎপাদনমুখী কোনো কার্যক্রমে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকবে। মনে রাখতে হবে, বয়স স্থায়ীভাবে একবার বৃদ্ধি করা হলে ভবিষ্যতে তা থেকে সরে আসা অত্যন্ত কঠিন হবে। যে জন্য বয়সবৃদ্ধির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সমাজ ও রাষ্ট্রে এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব আরও গভীরভাবে পর্যালোচনা করতে হবে।
এ ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ভাবতে হবে, একজন ব্যক্তির যৌবনের প্রতিটি দিন নিজের জন্য এবং জাতির জন্য অত্যন্ত মূল্যবান। এ মূল্যবান সময়ের প্রায় সবটাই যদি চলে যায় চাকরির পেছনে ছুটতে, তাহলে তা ওই ব্যক্তির ও জাতির জন্য কতটা মঙ্গলজনক হবে, সেটাও ভাবতে হবে।
মো. ফিরোজ মিয়া : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব, চাকরি ও আইন সংক্রান্ত গ্রন্থের লেখক