Logo
Logo
×

বাতায়ন

বিশ্ব শিক্ষক দিবস

শিক্ষকের মর্যাদা ও কাজী কাদের নেওয়াজ

Icon

বিমল সরকার

প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষক দিবস সামনে এলে কবি কাজী কাদের নেওয়াজের (১৯০৯-১৯৮৩) কথা বেশি মনে পড়ে। কেবল ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ কবিতাটির জন্যই বোধকরি তিনি একটি স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী অগণিত মানুষের হৃদয়ের গহিনে। পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে অমর কবিকে স্মরণ করি। কী পবিত্র ও সাহসী উচ্চারণ তার-

‘শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার

দিল্লির পতি সে তো কোন ছার।’

কেমন ছিল কাজী কাদের নেওয়াজের কালজয়ী কবিতাটি রচনায় সেদিনকার ভাবনার প্রেক্ষাপট? প্রথমে তার সম্পর্কে দুটি কথা বলে নেওয়া যাক।

কাজী কাদের নেওয়াজ ব্রিটিশ বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার তালিবপুর গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট গ্রামে। তিনি কর্মজীবনে মূলত ছিলেন সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। ১৯২৩ সালে বর্ধমান জেলার মাথরুন উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স এবং বহরমপুর কলেজ থেকে ১৯২৯ সালে ইংরেজি বিষয়ে অনার্স পাশ করেন। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের পর পশ্চিমবঙ্গ ত্যাগ করে ঢাকায় আসেন এবং নবাবপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কর্মে যোগ দেন। ১৯৫১ সালে দিনাজপুর জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং ১৯৬৬ সালে এ পদ থেকে অবসরগ্রহণ করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তার সাহিত্যচর্চার শুরু। শিক্ষকতার ফাঁকে এবং পরবর্তীকালে অবসরজীবনে তার বিখ্যাত সব কর্ম সম্পাদন করেন। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : ‘মরাল’ (কাব্য), ‘নীল কুমুদী’ (কাব্য), ‘দুটি পাখি দুটি তীরে’ (উপন্যাস), ‘দস্যু লাল মোহন’ (গোয়েন্দা কাহিনী), ‘দাদুর বৈঠক’ (স্মৃতিচারণমূলক গল্প-কাহিনী) ইত্যাদি।

কাজী কাদের নেওয়াজের কবিতায় মাতৃভক্তি, গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধা, শিশুদের প্রতি অকৃত্রিম স্নেহ, দেশপ্রেম ও প্রকৃতির নিঃসর্গের প্রতি ভালোবাসা সাবলীলভাবে ফুটে উঠেছে। ছাত্রজীবনে ‘শিশুসাথী’ পত্রিকায় প্রকাশিত তার ‘মা’ কবিতায় মায়ের প্রতি গভীর ভক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং একই বছর প্রেসিডেন্ট পুরস্কার লাভ করেন।

দিল্লির বাদশাহ পরম প্রতাপশালী আওরঙ্গজেব আলমগীর (১৬৫৮-১৭০৭) তার পুত্রকে পড়াতে দিয়েছেন দিল্লির এক মৌলভী শিক্ষকের কাছে। শাহজাদা রোজ সকালে শিক্ষকের পায়ে পানি ঢেলে দেয়, আর শিক্ষক নিজ হাতে ঘষে ঘষে পায়ের ময়লা সাফ করেন। একদিন বাদশাহ ঘটনাটি নিজ চোখে দেখে ফেললেন। শিক্ষক ভাবলেন, শাহজাদাকে দিয়ে পদসেবার হয়তো কৈফিয়ত দিতে হবে; অপরাধে আজ বুঝি তার গর্দান যাবে। কিন্তু না, বাস্তবে ঘটল ভিন্ন কিছু। কোনোরকম কৈফিয়ত চাওয়ার বদলে বাদশাহ বরং শিক্ষকের কাছে অনুযোগ জানালেন শাহজাদাকে তিনি যথাযথ আদব শেখাননি বলে; একহাত দিয়ে বদনা থেকে পানি ঢালতে ঢালতে অন্য হাতে শিক্ষকের পা নিজ হাতে সাফ করে দিলেই শাহজাদার আদবের শিক্ষা সম্পূর্ণ হতো-এই হলো বাদশাহর অভিমত। শিক্ষক তো বাদশাহর অভিমত শুনে একেবারে স্তম্ভিত, অভিভূত। এ তার কাছে খুবই অপ্রত্যাশিত, ভাবনারও অতীত। ভয়ে জড়োসড়ো শিক্ষক বাদশাহর মুখোমুখি হয়ে ভর্ৎসনার বদলে আজ এ কী শুনলেন! একজন শিক্ষকের জন্য এর চেয়ে বড় সম্মান ও পরম স্বস্তির বিষয় আর কী হতে পারে? বস্তুত কার সঙ্গে তুলনা চলে শিক্ষকের মর্যাদার!

শিক্ষককে এ পর্যন্ত কর্মে ও ভাবনায় মর্যাদার এমন উচ্চাসনে দিল্লিশ্বর আলমগীরের মতো আর কেউ প্রতিষ্ঠিত করেছেন বলে আমাদের জানা নেই। আরও জানা নেই, মানুষ গড়ার মহান কারিগর শিক্ষককে এমন উচ্চাসনে স্থাপন করে বাংলা ভাষায় আর কজনের কলমে এমন গৌরবময় পঙ্ক্তিমালা রচিত হয়েছে।

শিক্ষক সম্পর্কে একজন প্রবল প্রতাপশালী সম্রাটের এমন মনোভাব কবির হৃদয়কে স্পর্শ করে। সাধারণ একজন শিক্ষককে আপন ভাবনায় অসাধারণ করে তোলেন তিনি। উদার হৃদয় বাদশাহ আলমগীরের প্রশংসা করার পাশাপাশি ঊর্ধ্বে তুলে ধরেন শিক্ষকতা পেশার মহিমাকে :

‘আজ হতে চির উন্নত হলো

শিক্ষাগুরুর শির,

সত্যই তুমি মহান উদার

বাদশাহ আলমগীর।’

শিক্ষকতা আর পাঁচ-দশটি পেশার মতো নয়। এটি একটি মহান ব্রত। শিক্ষকতার সঙ্গে অন্য কোনো পেশার তুলনা চলে না। জ্ঞানদান-চক্ষুদান, জ্ঞানচর্চা-গবেষণা-সাধনা; কী আশ্চর্য এক অনুভূতি! অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, নানা কারণে ও নানাভাবে আজ বিতর্কিত এবং আলোচিত-সমালোচিত হয়ে উঠেছে এ মহান পেশাটি। এখন আর এ পেশার সোনালি অতীত ও গৌরবোজ্জ্বল পরম্পরার কথা আমাদের মনে খুব একটা রেখাপাত করে না। এমন পরিস্থিতির পরিবর্তন চাই।

আজ ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস। আজকের দিনে প্রাতঃস্মরণীয় মহাজন কাজী কাদের নেওয়াজকে আন্তরিক অভিবাদন জানাই। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ঘরে ঘরে কবি কাজী কাদের নেওয়াজের বাঁধানো ছবি রাখা দরকার। একইসঙ্গে উচিত মহান পেশাটি সম্পর্কে তার হৃদয়ে লালিত ধারণাটিকে সমুজ্জ্বল রাখা।

বিমল সরকার : কলাম লেখক, অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম