Logo
Logo
×

বাতায়ন

আজ আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস

মানুষ প্রবীণ হয় কি মর্যাদা হারানোর জন্য?

Icon

মনজু আরা বেগম

প্রকাশ: ০১ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মানুষ প্রবীণ হয় কি মর্যাদা হারানোর জন্য?

অক্টোবর এলে প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে স্মরণ করা হয় সম্মান ও মর্যাদা প্রদানের মাধ্যমে। আজ আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। বিশ্বব্যাপী ঘটা করে দিবসটি পালিত হয়ে থাকে। এ বছর উদযাপিত হচ্ছে ৩৪তম আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। জাতিসংঘ এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে-‘মর্যাদাপূর্ণ বার্ধক্য : বিশ্বব্যাপী প্রবীণ পরিচর্যা ও সহায়তা ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ’। প্রতিপাদ্যটি দেখে প্রশ্ন জাগে, প্রবীণরা কি আসলে পরিবার বা সমাজে মর্যাদাপূর্ণ বার্ধক্য নিয়ে বেঁচে আছেন? যদি থাকতেন, তাহলে কি তারা বঞ্চনা আর নির্যাতনের শিকার হতেন?

জনবহুল বাংলাদেশের মানুষের একটি বিরাট অংশ প্রবীণ। চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নয়নের ফলে মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে প্রবীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার তুলনামূলক বেশি হওয়ায় প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বিশ্বব্যাপী ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানবজীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বার্ধক্য। এ বিবেচনায় প্রবীণদের জীবনমান উন্নয়ন, সমাজে তাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, প্রবীণ জনগোষ্ঠীর প্রতি সহনশীল আচরণ এবং তাদের সমস্যা সম্পর্কে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে জাতিসংঘ ১৯৯১ সাল থেকে প্রতিবছর ১ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস হিসাবে পালন করে থাকে। কিন্তু দিবসটি পালনের মাধ্যমে আক্ষরিক অর্থে কাজের কাজ তেমন কিছুই হয় না। প্রবীণরা আজও পরিবার ও সমাজে অবহেলিত, নির্যাতিত ও অপাঙ্ক্তেয়। পরিবার ও সমাজে তাদের বোঝা মনে করা হয়। প্রবীণদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না। প্রবীণ জনগোষ্ঠীর কল্যাণে কোনো সরকারই উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। দেশে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রবীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে অনেকেই আর্থিক নিরাপত্তাহীনতার মাঝে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। পরিবার ও সমাজে তারা বিভিন্নভাবে বঞ্চিত ও নির্যাতিত হচ্ছেন।

আজকের যারা নবীন, তারাই আগামীর প্রবীণ। কিন্তু এ অমোঘ সত্য ও বাস্তবতা কেউ মেনে নেয় না বলে প্রবীণদের যথাযথ মর্যাদা ও সম্মান দেওয়া হয় না। প্রবীণদের মেধা, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাকে কোথাও কাজে লাগানো হচ্ছে না। দক্ষ, অভিজ্ঞ ও মেধাবী প্রবীণদের জন্য সরকারিভাবে কোনো কার্যক্রম গৃহীত হচ্ছে না। অনেক প্রবীণ ঘরে কর্মহীন জীবনযাপনের ফলে বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে, অর্থনৈতিক অক্ষমতা এবং সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করছেন। দেশের মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবীরা দুর্মূল্যের বাজারে আর্থিক কষ্টে জীবন অতিবাহিত করছেন।

প্রবীণ বয়সে বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হতে হয়। ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি, ডাক্তারদের চড়া ভিজিট, প্যাথলজিক্যাল টেস্টের মূল্যবৃদ্ধিতে প্রবীণরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। হাসপাতালগুলোয় প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য পৃথক প্রবীণ কর্নার থাকা অত্যন্ত জরুরি হলেও দেশে কোথাও কোনো হাসপাতালে এ ব্যবস্থা নেই। এক্ষেত্রে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সার্বিক কল্যাণে শিশু ও মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মতো প্রবীণবিষয়ক একটি মন্ত্রণালয় স্থাপন প্রবীণ জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের দাবি। সম্প্রতি এক তথ্যে জানা যায়, চীনে শারীরিকভাবে সুস্থ প্রবীণদের সম্মানজনক ভাতা দিয়ে তাদের বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করা হচ্ছে। ভারতে সরকারিভাবে অবসরপ্রাপ্ত দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রবীণদের তালিকা করা হয়। সেখান থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের মেনটর নিয়োগ করা হয়।

জাতিসংঘের তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী প্রবীণরা দুর্ব্যবহার, অবহেলা, বঞ্চনা, নির্যাতন ও শোষণের সম্মুখীন হচ্ছেন সবচেয়ে বেশি। আমাদের সমাজে এ সংখ্যাটা আরও বেশি। পরিবার ও সমাজে তারা অপাঙ্ক্তেয়। অথচ দেশের উন্নয়নের তথা সমাজ ও সভ্যতার মূল কারিগর তারাই। একসময় যারা তাদের মেধা, শ্রম ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে দেশের উন্নয়নে অবদান রেখেছেন, তারা প্রবীণ বয়সে এসে পরিবার ও সমাজে অবহেলিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত আর বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। তাই প্রবীণ জনগোষ্ঠীর পারিবারিক ও সামাজিক অবদানের স্বীকৃতি প্রদান করার পাশাপাশি তাদের প্রতি যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে প্রবীণ নীতিমালা ও পিতামাতার ভরণপোষণ আইন-২০১৩ সরকার অনুমোদন করেছে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, গত ১১ বছরেও এ নীতিমালার যথাযথ বাস্তবায়ন হয়নি। দেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দেড় কোটির উপরে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৫ সাল নাগাদ এ সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখে এবং ২০৫০ সালে প্রায় সাড়ে ৪ কোটিতে। দেশে দক্ষ, অভিজ্ঞ ও মেধাবী প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থানের কোনো সুযোগ নেই। তাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে কোথাও কাজে লাগানো হচ্ছে না।

প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করে ১৯৬০ সালে উপমহাদেশের বিশিষ্ট চিকিৎসাবিদ অধ্যাপক ডা. এ কে এম আবদুল ওয়াহেদ প্রবীণদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ‘পাকিস্তান এসোসিয়েশন ফর দ্য এইজ্ড অ্যান্ড ইনস্টিটিউট অফ জেরিয়াট্রিক মেডিসিন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। ঢাকার ধানমন্ডিতে তার নিজ বাসভবনে প্রতিষ্ঠানটি স্থাপন করে এর কার্যক্রম শুরু করেন তিনি। পরবর্তীকালে, ১৯৮৮ সালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে সরকারের দেওয়া প্রায় ১ একর জায়গার উপর হাসপাতাল ও একটি প্রবীণ নিবাস স্থাপন করা হয়। এরপর একটি জেরিয়াট্রিক ইনস্টিটিউটসহ ‘বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরা বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান’ নামকরণ করা হয়। প্রবীণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা ও কল্যাণের জন্য প্রতিষ্ঠিত এ হাসপাতালে সকাল ও বিকালে বহির্বিভাগে অভিজ্ঞ ডাক্তার দ্বারা রোগী দেখার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রবীণ ছাড়াও সব বয়সি রোগীর সাশ্রয়ী মূল্যে চিকিৎসাসেবাসহ বিভিন্ন প্রকার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি পরিবার ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিবন্ধনভুক্ত হওয়ায় স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে কিছু বার্ষিক অনুদান পেয়ে থাকে। কিন্তু এ অনুদান প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই কম। সারা দেশে প্রতিষ্ঠানটির ৯২টি শাখা রয়েছে। কেন্দ্র ও শাখাগুলোর জন্য স্বাস্থ্য ও সেবামূলক বহুবিধ কর্মকাণ্ড সম্পাদন ও পরিচালনায় প্রতিষ্ঠানটি অর্থাভাবে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর কল্যাণে তেমন এগিয়ে আসতে পারছে না। শুধু তাই নয়, প্রতিষ্ঠানটি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হলেও বিভিন্ন অনিয়মের অজুহাতে বিগত প্রায় দুই বছর সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক নির্বাচন বন্ধ রাখায় এটি সুষ্ঠুভাবে চলছে না। অথচ একই সময়ে অর্থাৎ ১৯৬০ সালে বারডেম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এর কার্যক্রম সারা দেশে কীভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছে, তা কারও অজানা নয়। প্রবীণ জনগোষ্ঠীর কল্যাণে প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালটির উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ, জেরিয়াট্রিক ইনস্টিটিউটের কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি, প্রবীণদের বসবাসের জন্য নিবাসটির উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ এবং শাখাগুলোর কার্যক্রম অব্যাহত রাখা একান্ত প্রয়োজন। প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এ প্রতিষ্ঠানের সদস্য সংখ্যাও ক্রমাগত বাড়ছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির সদস্য সংখ্যা সাড়ে তিন হাজার। দেশব্যাপী প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান শাখাগুলোর উন্নয়নের পাশাপাশি এর সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করা সময়ের দাবি।

আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রবীণদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিসহ প্রবীণ নীতিমালা ২০১৩ বাস্তবায়নে যথাযথ উদ্যোগ ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে জোর দাবি জানাচ্ছি।

মনজু আরা বেগম : অবসরপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক, বিসিক; জীবন সদস্য, বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরা বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান

monjuara2006@yahoo.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম