সিদ্ধান্ত গ্রহণে দৃঢ়তা থাকা চাই
বিমল সরকার
প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সিদ্ধান্ত গ্রহণে দৃঢ়তা থাকা চাই
কোনো একটি সরকারের পক্ষে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় দৃঢ়তা থাকা চাই। সরকারের সিদ্ধান্তহীনতা কিংবা ভুল বা দেরিতে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনেক সময় বড় ধরনের বিপত্তি ও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। কোনো গুরুত্বপূর্ণ কিংবা জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে একবার সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ নিয়ে পরক্ষণে তা থেকে সরে আসাটাও ভালো কোনো লক্ষণ নয়। এমন ক্ষতির দীর্ঘস্থায়ী মাশুল দিয়ে যেতে হয় গোটা জাতিকে।
গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ‘ইতস্ততা’ করার কোনো সুযোগ নেই। সিদ্ধান্ত গ্রহণে কালক্ষেপণ বা ইতস্ততা কিংবা একবার সিদ্ধান্ত নিয়ে পরবর্তীকালে সামান্য ছুতায় সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসাটাও দায়িত্বশীল কোনো সরকার, প্রতিষ্ঠান, সংস্থা কিংবা সংগঠনের কাছ থেকে কেউ আশা করে না; কিন্তু এমনটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে একের পর এক ঘটে চলেছে।
বৃদ্ধ ও তার ছেলে এবং গাধাকে নিয়ে মহাজন শেখ সাদীর বহুলপ্রচলিত গল্পটির কথা প্রথম আমি শুনি আমার বাবার মুখে। ‘নানা মুনির নানা মত’-কোনো বিষয়ে শতজনে শতরকমের কথা বললেও কাজ করতে হয় নিজের জ্ঞান আর বুদ্ধিমত্তায়। এটিই গল্পের সারকথা-‘নিজের বুদ্ধিতে তর, পরের বুদ্ধিতে মর।’ নিজের মগজে ঘাটতি থাকলে সবসময় সবার কথা শুনে ভালো ও কল্যাণকর কোনো কাজ করা যায় না। সবারই বোধকরি জানা এবং মনে আছে, তবু সংক্ষেপে এখানে গল্পটি উল্লেখ করি :
বৃদ্ধ ও তার ছেলে গাধার পিঠে চড়ে হাটে যাচ্ছে। তাই না দেখে পথচারীদের মধ্য থেকে কেউ একজন মন্তব্য করল- ‘দেখ দেখ, দুজন মিলে গাধাটাকে কী কষ্টটাই না দিচ্ছে!’ লোকের মুখে একথা শুনে বৃদ্ধ তার ছেলেটিকে নামিয়ে গাধার বোঝাটি কিছুটা হালকা করল। বৃদ্ধ গাধার পিঠে আর ছেলে হেঁটে পথ চলছে। এবার দেখে একদল পথচারী বলতে শুরু করল-‘লোকটি কত চালাক, নিজে আরাম করে গাধার পিঠে বসেছে আর বাচ্চাটাকে নিয়ে যাচ্ছে হাঁটিয়ে।’ এমন কথা শুনতে শুনতে বৃদ্ধ নেমে ছেলেটিকে উঠাল গাধার পিঠে। বৃদ্ধ এবার হেঁটে চলেছে। আবারও পথচারীদের মন্তব্য-‘হায়রে বোকা, বুড়ো বয়সে নিজে কষ্ট করে হাঁটছে আর ছেলেটাকে গাধার পিঠে বসিয়ে নিচ্ছে।’ একের পর এক এমন তির্যক মন্তব্য ও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ বৃদ্ধের আর সহ্য হচ্ছিল না। এবার বাপবেটা উভয়ে হেঁটে চলেছে আর ওদের সামনে ভারহীন গাধাটা। আবারও বাঁকা মন্তব্য, বিদ্রুপের হাসি-‘দেখ দেখ, বোকাদের কাণ্ড দেখ; গাধাটাকে নিচ্ছে খালি খালি আর নিজেরা এ কড়া রোদের মধ্যে মরুপথে চলেছে হেঁটে।
পথচারীদের বারবার তাচ্ছিল্য আর তিরস্কারে বৃদ্ধ একেবারে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে পড়ল। অপমান, রাগ আর ক্ষোভ তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। নতুন এক উপায় বের করে এবার বৃদ্ধ একটি বাঁশের সঙ্গে গাধাটির পা বেঁধে দুজনে বাঁশের দুই প্রান্ত নিজেদের কাঁধে ঝুলিয়ে আগে-পিছে পথ চলতে শুরু করল। গাধার তো ত্রাহী অবস্থা, উলটো হয়ে থাকায় কিছুক্ষণের মধ্যে জিহ্বা বের করে দিয়ে ছটফট করতে থাকে। সামনেই বাঁশের তৈরি সরু সাঁকো। নিচে পানি। যেই তারা সাঁকোতে পা রাখল, পানি দেখে কাঁধের তৃষ্ণার্ত গাধা মোচর দিতে শুরু করল। আর মট মট করে সাঁকোটি ভেঙে সবাই নিচে পানিতে পড়ে গেল।
আমাদের এ সমাজ বড় বিচিত্র। এখানে নানা রকমের লোকের বাস। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, পণ্ডিত-মূর্খ, সুবিধাবাদী ও বঞ্চিত-অবহেলিত-নির্যাতিত-নিষ্পেষিত সবাইকে খুশি রাখা যায় না। লোকের কথায় কান না দিয়ে নিজের মতো করে বাঁচা ও চলার জন্য দরকার নিজস্ব বিবেচনাবোধ। অপ্রিয় হলেও সত্য, বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বকীয়তা বা ওই বিবেচনাবোধটুকু আজ বিলীন হওয়ার পথে। স্রোতের অনুকূল বা গড্ডালিকা প্রবাহের বাইরে যেন কেউ কিছু সহজে ভাবতে পারেন না। ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সংস্থা বা সংগঠন কম-বেশি সবার ক্ষেত্রেই কথাটি বোধকরি প্রযোজ্য।
শোনা খারাপ কিছু না। না শুনলে জানা হবে কীভাবে। জানতে হলে পড়তে হবে, দেখতে হবে এবং শুনতেও হবে। না শুনলে, জানা হবে কীভাবে? কিন্তু আমরা কয়জনের কথা শুনব। ‘নানা মুনির নানা মত’। তা সত্ত্বেও ভালো কিছুর স্বার্থে সবার কথাই আমাদের শুনতে হবে। কিন্তু কাজটি করতে হবে নিজের বুদ্ধি-বিবেচনায়। তা না হলে অস্বস্তি-অস্থিরতা বাড়বে। ‘আলালের ঘরের দুলাল’-খ্যাত প্যারীচাঁদ মিত্রের ভাষায়, ‘সব কাজ বরাতে চলে, কিন্তু ঝালের স্বাদ পেতে হলে যে লঙ্কায় নিজেকেই কামড় দিতে হয়।’
বিমল সরকার : কলাম লেখক, অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক