পাহাড়ি-বাঙালির সম্প্রীতির বন্ধন হোক সুদৃঢ়
ড. সুকোমল বড়ুয়া
প্রকাশ: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আজ ২৯ সেপ্টেম্বর রামু ট্র্যাজেডির একযুগ পূর্তির দিন। আবার ২৯ সেপ্টেম্বর নতুন চাঁদ পেতে যাচ্ছে পৃথিবী। রামু ট্র্যাজেডি এদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত অধ্যায়। সেদিনের ওই নারকীয় ঘটনা বাংলাদেশের মাটিকে কলঙ্কিত করেছিল। বিশ্ব বিবেক সেদিন প্রতিবাদের ঝড় তুলেছিল। ফেসবুকের যে পোস্টের অজুহাতে এ নারকীয় ঘটনা ঘটেছিল, তা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। তৎকালীন সরকারের ছত্রছায়ায় যারা ওই ঘটনা ঘটিয়েছিল, তাদের শাস্তি হয়নি। বরং এ ঘটনায় যারা দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল সেদিন, তাদের নানা উচ্চপদ দেওয়া হয়েছিল। ওই ঘটনায় যেসব প্রাচীন স্থাপনা পুড়ে গেছে, ভস্মীভূত হয়েছে, তা কি আর ফিরে পাওয়া যাবে? একটি-দুটি নয়, বিশটির মতো বৌদ্ধ বিহার-প্যাগোডা এবং স্থাপনা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, সেই সঙ্গে ভাঙচুর করা হয় চল্লিশের অধিক ঘরবাড়ি। জিনিসপত্র লুটপাটও করা হয়। এখনো শুভ মধুপূর্ণিমা এলে ভয়াল রাতের সেই স্মৃতি মনে করে অসহায় বৃদ্ধ-প্রবীণরা চোখের জল ফেলে।
কী ঘটেছিল সেদিন? শুভ মধুপূর্ণিমার আগের রাত। মধুপূর্ণিমা বৌদ্ধদের একটি অন্যতম ধর্মীয় উৎসব। এ পূর্ণিমায় বৌদ্ধ ছেলেমেয়েরা বেশ আনন্দ করে মধুদান করার জন্য। তারা সেভাবে তৈরিও ছিল। রাত পোহালেই মধুপূর্ণিমার সকাল। তাই সাজসাজ রব, বাদ্য-বাজনার আনন্দ নিয়ে গ্রামগুলোতে চলছে আনন্দের মহড়া। আকাশের চাঁদও পূর্ণ হয়েছিল। চাঁদের আলোয় ভরে গিয়েছিল মাঠ, প্রাঙ্গণ ও বিহার আঙ্গিনা। সন্ধ্যায় একটু একটু শোনা যাচ্ছিল গণ্ডগোলের শব্দ। এ শব্দ, স্লোগান কিংবা মিছিলের আওয়াজ যে এমন ভয়াবহ রূপ নেবে-রামু, উখিয়া ও কক্সবাজারবাসী তা জানত না। হঠাৎ আক্রমণ, একসঙ্গে রামু সীমা বিহার, সাদাচিং, লালচিং মৈত্রী বিহার, উত্তর মিঠাছড়ি প্রজ্ঞামিত্র বৌদ্ধ বিহার, জাদিমুরা, চাকমার কুল ক্যাং সেন ধোয়া ও আগুনের ফুলকিতে একাকার হয়ে গেল। ওই বিহারগুলো যেহেতু পুরোনো কাঠের তৈরি ছিল, সেহেতু আগুন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্বলতে শুরু করল। পরদিন ৩০ সেপ্টেম্বরের পরের রাতে উখিয়ার দীপঙ্কর বৌদ্ধ বিহার, জাদিমুরা, উত্তর বড় বিল ও খয়রাতি বৌদ্ধ বিহারসহ বহু বৌদ্ধ স্থাপনা ও মন্দিরে; উখিয়া ও টেকনাফের হোয়াইক্ষ্যংয়ে আগুন দেওয়া হয়েছিল। একইসঙ্গে চট্টগ্রামের পটিয়াতেও।
তদন্তের রিপোর্টে এসেছিল, আগে থেকে একটি ছক করা হয়েছিল এবং ওই দিন ও রাতে কক্সবাজার প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছিল সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়। সুতরাং, পূর্বপরিকল্পিত না হলে সরকারের ছত্রছায়ায় এত বড় ঘটনা ঘটানো কিছুতেই সম্ভব ছিল না। পরে তদন্ত রিপোর্টে যাদের নাম এসেছিল, সেখানে অর্ধেক ছিল চেনা-জানা সরকারদলীয় লোক। সেদিনের পত্র-পত্রিকাগুলোতে সেসব ছবি আছে। এ নিয়ে দেশ-বিদেশে বহু লেখালেখি হয়েছে। প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। সেদিনের নৃশংসতার ছবি এখনো আমাদের কাছে আছে। ঘটনার পরপরই সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী, সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা সেখানে যান এবং সান্ত্বনা দেন। এরপর বিএনপি চেয়ারপারসনও রামু, উখিয়া ও পটিয়ায় যান। তাদের সান্ত্বনা দেন এবং সাহায্য করেন।
আজ রামু ট্র্যাজেডির একযুগ পূর্তি হচ্ছে, অথচ এখনো বিচার নীরবে কাঁদছে। বৌদ্ধরা আজও নীরবে অশ্রু বিসর্জন করছে। সেই ভয়াবহ স্মৃতির কথা মনে করে বৌদ্ধরা এখনো আতঙ্কে দিন কাটায়। সেদিনের বেদনা হয়তোবা তাদের আজীবন বহন করতে হবে। এরপর বহু সুন্দর সুন্দর সৌকর্যমণ্ডিত বিহার নির্মিত হয়েছে; কিন্তু প্রাচীন সেই দুর্লভ ঐতিহ্য, স্থাপনা ও দর্শনীয় বস্তু আর পাওয়া যাবে কি? পাওয়া যাবে না বহু প্রাচীন নিদর্শন, পাণ্ডুলিপি, হস্তলিপিসহ স্বর্ণ-রৌপ্য ও নানা ধাতবের তৈরি মূল্যবান বুদ্ধমূর্তিগুলো।
আমাদের মানবিক আচরণের মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের রক্ষাসহ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে এগিয়ে আসতে হবে। নতুবা আবার তৈরি হবে নানা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি। আমরা এমন ভয়াবহতা আর দেখতে চাই না। চাই না ধর্মের নামে কোনো ধরনের অরাজকতা, সম্প্রদায়ের নামে কোনো নৈরাজ্য কিংবা সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ।
আজ কদিন থেকে হঠাৎ করে পাহাড় হয়ে উঠেছে অশান্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামের দুই জেলা খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি অশান্ত হয়ে উঠেছে দুষ্কৃতকারী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কর্মকাণ্ডে। এ সহিংসতা নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন। এখনো পাহাড়ি জনপদ থমথমে। সম্প্রীতির বন্ধন যেন নষ্ট না হয়, সেজন্য সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আমরাও পাহাড়ি-বাঙালি শান্তি চাই, সম্প্রীতি চাই। চাই সৌহার্দপূর্ণ অবস্থান।
প্রথমে পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষ ও হামলার ঘটনা ঘটে খাগড়াছড়িতে বুধবার রাতে (১৮ সেপ্টেম্বর ’২৪)। সেই উত্তাপ দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে পাশের রাঙামাটিও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তৈরি হয় অশান্ত পরিবেশ। কিছু ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয় এবং প্রাণহানিও ঘটে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বোচ্চ সংযম দেখাতে বলা হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলাসহ ঢাকা, চট্টগ্রামের নানা স্থানে প্রতিবাদ সভা-সমাবেশ ও মিছিল-মিটিং হয়েছে। এদিকে বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ে বিজিবির অভিযানও চলছে অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারে।
আসন্ন দুর্গাপূজায় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ও সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার কথা জানিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক মো. ময়নুল ইসলাম। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এ দেশ সবার। ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার। আবহমানকালের সংস্কৃতিও তাই বলে। এককালে এদেশের সর্বপ্রান্তে ছিল বৌদ্ধদের বসবাস ও ঐতিহ্য। আমরা সেই ঐতিহ্যকে হারাতে চাই না। চাই না ধর্ম ও সম্প্রদায় নিয়ে কলহ। আমাদের চেতনা হোক-মানবতার, মানবিকতার ও সর্বজনীনতার। আমাদের ধরণিতল হোক কলঙ্কশূন্য। জগতের সব জীব সুখী হোক। বাংলাদেশ নবচেতনায় জাগ্রত হোক।
ড. সুকোমল বড়ুয়া : সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক, পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; সভাপতি, বিশ্ব বৌদ্ধ ফেডারেশন-বাংলাদেশ চ্যাপ্টার
skbaruadu@gmail.com