সংস্কার : রাষ্ট্রের আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা
ড. এম এল আর সরকার
প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রতীকী ছবি
দেশে সংস্কারের জন্য যেসব ক্ষেত্র রয়েছে, তার মধ্যে সম্ভবত অন্যতম হচ্ছে আমলাতন্ত্র। বর্তমানে দেশের প্রশাসনিক বৈষম্য, অদক্ষতা, সেবাহীনতা, সরকারের দুর্নীতির জন্য অনেকটাই দায়ী হচ্ছে আমলাতন্ত্র। বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে আমলাতন্ত্রের করালগ্রাস নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে, কিন্তু রাজনৈতিক দুর্বলতার কারণে আমলাতন্ত্রের অবসান বা সংস্কারের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।
হ্যাঁ, আমলাতন্ত্র দেশের সব ক্ষেত্রে বিদ্যমান। সুবিধাভোগীদের মতে, আমলাতন্ত্র আগে ছিল, এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। আমলাতন্ত্র থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে কিনা সেটা পরে বলছি। তবে সর্বাগ্রে যেটি বলা প্রয়োজন তা হচ্ছে, আমলাতন্ত্রের মূল ভিত্তি প্রোথিত আছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন একজন সচিব এবং এ সচিবরা মূলত এসেছেন একটি ক্যাডার থেকে। সচিবরা শুধু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীদেরই আচ্ছন্ন করে রাখেন না, অধিকন্তু রাষ্ট্রের প্রধানকেও আচ্ছন্ন করে রাখেন।
দেশের সরকারপ্রধান যখন কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আলোচনায় বসেন, তখন তা দেখে মনে হয়, দেশ পরিচালনার জন্য একটি শ্রেণির কর্মকর্তা ছাড়া আর কারও মতামতের প্রয়োজন নেই। এ দেশে বিচারক, শিক্ষক, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ, অর্থনীতিবিদ, প্রতিরক্ষা বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ অন্য কোনো সেক্টরের কোনো কর্মকর্তা-বিশেষজ্ঞ নেই। সবকিছুই হচ্ছে বা করছে আমলারা। দীর্ঘদিন থেকেই চলে আসছে এ ধারা। অতীতে সচিব পদে বিভিন্ন সেক্টরের যোগ্য ব্যক্তিদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হতো, কিন্তু সেই প্রথা আজ বিলুপ্ত।
খুব সহজেই বলা যায়, আমলাতন্ত্রের জন্য দায়ী হচ্ছে প্রশাসনিক কাঠামোতে বিদ্যমান মহিরূহ এবং বনসাই ব্যবস্থা। মহিরুহ ব্যবস্থাটি বিদ্যমান আছে শুধু এক শ্রেণির কর্তাদের ক্ষেত্রে। এ শ্রেণির কর্মকর্তা ছাড়া অন্যদের সরকারের সর্বোচ্চ স্তরে বা সচিব পদে যাওয়ার পথ বলা যায় রুদ্ধ। ফলে এক শ্রেণির কর্তারাই তরতর করে উপরে উঠছে এবং বিশাল বটবৃক্ষের মতো তারা অন্য সেক্টরের ওপর প্রভাব বিস্তার করছে। পেশাজীবীসহ সবাই কাজ করছে, শুধু হুকুম এবং মিটিং করেই সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে এ শ্রেণির কর্মকর্তারা।
বনসাই ব্যবস্থাটি বিদ্যমান রয়েছে, অন্য সেক্টরের চাকরিজীবী বিশেষ করে বিচারক, শিক্ষক, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ ইত্যাদি পেশায় নিয়োজিতদের ক্ষেত্রে। এ এক অপরূপ বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা, যা দেখলে মনে হয় পেশাজীবী বা এ ধরনের চাকরিজীবীদের সচিব হওয়ার মতো কোনো যোগ্যতা নেই। এদের জন্য একমাত্র বরাদ্দকৃত পদ হচ্ছে ডিজি বা অন্য কিছু। এসব সেক্টরের কর্মকর্তাদের মন্ত্রণালয়ের অন্য শ্রেণির অধীনেই থাকতে হবে বা কাজ করতে হবে। তাদের বনসাই বৃক্ষের মতো বটবৃক্ষের পাদপ্রদীপের আলোয় নানারূপ অপুষ্টি নিয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। দীর্ঘদিন থেকেই প্রচলিত এ ব্যবস্থায় সৃষ্টি হয়েছে সীমাহীন বৈষম্য, অদক্ষতা, সেবাহীনতাসহ নানারূপ সমস্যা-যার কয়েকটি মাত্র এখানে আলোকপাত করছি।
সীমাহীন বৈষম্য : আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিয়ে আমরা সবাই জানি এবং অনেকেই এ বিষয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে; কিন্তু সরকার বরাবরই নিশ্চুপ। বৈষম্যের বিষয়টি একটু পরিষ্কার করতে এটুকু বলা প্রয়োজন যে, প্রমোশন, পদায়ন, ভাতা, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয় এক শ্রেণির কর্মকর্তা প্রাধিকারের নামে পাচ্ছেন চাহিবা মাত্র। কিন্তু রাষ্ট্রের অন্য সেক্টরের কর্মকর্তাদের জন্য এ ধরনের সুবিধাপ্রাপ্তির আশা অনেকটা কল্পনামাত্র। অন্য সেক্টরের কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত সুবিধাদি পাওয়া তো দূরের কথা, নিয়মানুযায়ী যা প্রাপ্য, তা পেতেও সীমাহীন হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। সম্ভবত দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তা ছাড়া, অন্য সব সেক্টরের কর্মকর্তারাই প্রতিনিয়তই এরূপ বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন।
শুধু সুযোগ-সুবিধা নয়, উপজেলা বা জেলা পর্যায়ের কর্মরতদের মর্মপীড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে পদায়ন, প্রমোশন এবং সিনিয়র-জুনিয়র বৈষম্য। এ বৈষম্যের কারণে অনেক কর্মকর্তাকে তাদের চেয়ে অনেক কম বয়সি কর্মকর্তার অধীনে কাজ করতে হচ্ছে। প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা প্রায় ৩ বছরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং প্রায় ১০ বছরে জেলা প্রশাসক হিসাবে প্রমোশন পাচ্ছেন। এত কম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন কর্মকর্তাকে এসব দায়িত্বে পদায়নের ফলে কত বিচারক, শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ বা অন্য সেক্টরের কর্মকর্তাকে যে কী নিদারুণ মর্মপীড়া নিয়ে তার চেয়ে জুনিয়র একজনকে স্যার স্যার করতে হচ্ছে, তার হিসাব একমাত্র ভুক্তভোগী কর্মকর্তারাই জানেন।
আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে আছে ক্যাডার এবং নন-ক্যাডার বৈষম্য। উপজেলা পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তা আছেন, যারা ক্যাডার সমাজের অন্তর্ভুক্ত নন। উপজেলা ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষা কর্মকর্তা, সমাজসেবা কর্মকর্তা, সমবায় কর্মকর্তা, যুব-উন্নয়ন কর্মকর্তা বা আইসিটি কর্মকর্তারা হচ্ছে এ ক্যাডার, নন-ক্যাডার বৈষম্যের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কেন একজন উপজেলা ইঞ্জিনিয়ার ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তা হিসাবে পরিগণিত হতে পারছে না, কেন বিসিএস পাশ করেও সমাজসেবা কর্মকর্তাকে নন-ক্যাডার শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত, সেটি একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন। এসব পদে কর্মরতদের অভিযোগ, সবকিছুর মূলেই আছে এক শ্রেণির কর্মকর্তাদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রবণতা, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রশাসনিক অদক্ষতা ও সেবাহীনতা : প্রশাসনিক অদক্ষতা এবং সেবাহীনতার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হচ্ছে আমাদের দেশ। সবই আছে, কিন্তু কোনো কাজই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হচ্ছে না এবং জনগণ কোনো সেবা পাচ্ছে না। এ অদক্ষতার মূল কারণ হচ্ছে বিদ্যমান দ্বিস্তরভিত্তিক ব্যবস্থা-পেশাজীবীরা কাজ করছে, কিন্তু পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং নিয়ন্ত্রণ করছে আমলারা। বিচার, চিকিৎসা, শিক্ষা, প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা, কৃষি ইত্যাদি ক্ষেত্রে কী ধরনের সমস্যা আছে, তা সমাধানের উপায় কী এবং কীভাবে জনগণকে কাক্সিক্ষত সেবা প্রদান করা সম্ভব, সে বিষয়ে ভালো জানে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এসব কর্মকর্তার মতামত রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রদানের ক্ষমতা তাদের নেই।
প্রশাসনিক অদক্ষতার অন্যতম আর একটি কারণ হচ্ছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা বা নীতিনির্ধারণী কাজের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বদলি প্রথা। এসব কর্মকর্তা কয়েক বছর এক মন্ত্রণালয়ে কাজ করার পর অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি হচ্ছেন। বদলির এ খেলায় এবং মন্ত্রণালয়ে কী কাজ হচ্ছে, সে সম্পর্কে তাদের সংশ্লিষ্টতা না থাকায় এ কর্মকর্তাদের মধ্যে কোনো ধরনের অংশীদারত্ব তৈরি হয় না। ফলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাজের মানোন্নয়ন বা সমস্যা সমাধানের জন্য তাদের কোনো আত্মোপলব্ধি বা ভূমিকা থাকে না। রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সুবিধাদিপ্রাপ্ত এসব কর্মকর্তার একমাত্র কাজ হচ্ছে বদলি, পদায়ন এবং শাসনব্যবস্থা কায়েম করা।
ট্রেনিং ও দক্ষতার অপচয় : মন্ত্রণালয়ের বড় কর্তাব্যক্তিরা যখন কোনো মন্ত্রণালয়ে পদ পাচ্ছেন, তখন কোনো না কোনোভাবে তারা সেই মন্ত্রণালয়ের উন্নয়নের জন্য বিদেশ থেকে স্বল্পমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি ট্রেনিং, এমনকি উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করছেন। ট্রেনিং নিয়ে কিছুদিন পর অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি হচ্ছেন। আমার একজন অতি-পরিচিতকে দেখেছি দুর্নীতি দমন বিষয়ে অস্ট্রেলিয়া থেকে ট্রেনিং নিয়ে আসার কিছুদিন পর অন্য একটি মন্ত্রণালয়ে বদলি হলেন। এটি শুধু তার ক্ষেত্রে নয়, সব কর্মকর্তার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ক্ষমতার বলে প্রতিনিয়ত এ কর্মকর্তারা ট্রেনিং নিচ্ছেন এবং বদলি হচ্ছেন। এমন কর্মকর্তাও বিদেশে গিয়ে ট্রেনিং নিচ্ছেন, যার চাকরি আছে মাত্র কয়েক মাস বা কয়েক দিন।
ওএসডি ও রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় : বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাজ হচ্ছে শুধু হাজিরা দিয়ে বেতন-ভাতা, গাড়িসহ যাবতীয় সুবিধাদি ভোগ করা। সচিবালয়ে এরকম শত শত কর্মকর্তা আছেন। সাধারণত কোনো কর্মকর্তা অনিয়ম করলে বা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তাকে ওএসডি করা হয়, তবে বর্তমানে ওএসডি করা হচ্ছে মূলত রাজনৈতিক কারণে। কেন এমনটি হয়, তার একটি ব্যাখ্যা প্রয়োজন। আমলাতন্ত্রের চরম আশীর্বাদে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা অতি দ্রুত প্রমোশন পেয়ে মাঠপর্যায় থেকে মন্ত্রণালয়ে চলে আসছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে প্রমোশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যার চেয়ে মন্ত্রণালয়ে পদের সংখ্যা অনেক কম।
পদের সংখ্যা কম হওয়ায়, পছন্দনীয় মন্ত্রণালয়ে পদ পাওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ে চলছে এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সবাই চেষ্টা করে নিজেকে সরকারের সমর্থক হিসাবে প্রকাশ করার জন্য। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, কিছু কর্মকর্তা আছেন, যারা শুধু নিজেকে সরকার ঘরনার হিসাবে জাহির করেই ক্ষান্ত দেন না, অধিকন্তু তারচেয়ে দক্ষ বা তার প্রতিযোগী কর্মকর্তাকে সরকারবিরোধী বলে তকমা লাগতেও দ্বিধাবোধ করেন না। সরকার সমর্থক এবং সরকারবিরোধী, এ দুপক্ষের প্রতিযোগিতায় স্বাভাবিকভাবেই সরকার সমর্থকরা পান পদ এবং বিরোধীরা হন বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। সরকার যায়, সরকার আসে! কিন্তু প্রচলিত সংস্কৃতির কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না।
সমাধানের উপায় : বহুদিন থেকে প্রচলিত এ আমলাতন্ত্রের অবসানের আজ সময় এসেছে। কথা হচ্ছে, আসলেই কি আমলাতন্ত্রের অবসান সম্ভব? হ্যাঁ, এর অবসান অবশ্যই সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিদ্যমান মরিুহ এবং বনসাই প্রথা বন্ধ করা। অথাৎ এক শ্রেণির কর্মকর্তারাই শুধু সব শীর্ষস্থান দখল করবে এবং অন্যরা শুধু ডিজি বা এ ধরনের পদেই সীমাবদ্ধ থাকবে, সেই নিয়ম বিলুপ্ত করা। এটি বিলুপ্ত হলে বিচার, চিকিৎসা, শিক্ষা, প্রতিরক্ষা, নিরাপত্ত, কৃষি ইত্যদি পেশায় যারা নিয়োজিত আছেন, তারাই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব থেকে শুরু করে সব পদে নিয়োজিত হতে পারবেন এবং অবসান হবে আমলাতন্ত্র।
অনেকেই হয়তো ভাবছেন একজন বিচারক, শিক্ষক, চিকিৎসক, কৃষিবিদ, ইঞ্জিনিয়ার বা সেনা কর্মকর্তা কী করে সচিব হবেন? হ্যাঁ, অবশ্যই তারা পারবেন। এসব কর্মকর্তা যদি ডিজি বা এ ধরনের পদে কাজ করতে পারেন, তাহলে তারা সচিব পদেও অনায়াসে কাজ করতে পারবেন। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, যারা যে মন্ত্রণালয়ের কাজ করছেন বা যারা যে কাজ সম্পর্কে অবগত, তাদেরই সেই মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ পদে কাজ করা উচিত। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব হওয়া উচিত একজন ডাক্তারের, কোনোভাবেই অন্য কারও নয়। এরকম ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে অনায়াসেই দূর হবে বৈষম্য, অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা এবং দেশ পরিচালনায় অংশগ্রহণ করতে পারবে রাষ্ট্রের সব সেক্টরের কর্মকর্তা।
একবার কল্পনা করুন, ডিজি প্রথা নেই। সব মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছে সংশ্লিষ্ট সেক্টরের কর্মকর্তারা। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ বা পরিকল্পনা প্রণয়নে রাষ্ট্রপ্রধানের পাশে আছে বিচার, প্রশাসন, চিকিৎসা, শিক্ষা, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষি, প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা, সমাজসেবা ইত্যাদি পেশায় নিয়োজিত কর্তাব্যক্তিরা। প্রত্যেকেই তাদের সংশিষ্ট বিষয়ে মতামত দিচ্ছে, যার যে সমস্যা তা সে সরাসরি সরকারপ্রধানের কাছে ব্যক্ত করছে। সবাই মিলে দেশের কল্যাণে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। কী অপূর্ব ব্যবস্থা! কারও আধিপত্য নেই। রাষ্ট্রের কল্যাণে সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে।
না, এ সুন্দর ব্যবস্থাটিকে আজ আর কল্পনায় দেখার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজনী পদক্ষেপ নিলে বাস্তবেই আমরা এটি দেখতে পাব। অনেকেই হয়তো ভাবছেন, এতে প্রশাসন ক্যাডারকে অবমূল্যায়ন করা হবে। না, এ ব্যবস্থায় কাউকেই অবমূল্যায়ন করার অবকাশ নেই। সবাই কাজ করবে নিজ নিজ গণ্ডির মধ্যে। প্রমোশন বা রাষ্ট্রীয় সুবিধাদি পাবে নিয়মানুযায়ী। সুবিধাদির উনিশ-বিশ বা আটারো-বিশ হতে পারে, কিন্তু কোনোভাবেই পনেরো-বিশ হওয়ার কারণ থাকতে পারে না। ট্রেনিং বা উচ্চশিক্ষা যার যে ক্ষেত্রে প্রয়োজন, সে ক্ষেত্রেই পাবে, কিন্তু বিনা কারণে রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় বন্ধ হবে।
অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, বিষয়টি যদি এতই সহজ, তাহলে এতদিন এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কেন? হ্যাঁ, বিষয়টি সহজ, সমাধান হয়নি দেশের দুর্বল রাজনৈতিক ব্যবস্থার কারণে। রাজনীতিবিদরা জানেন, তারা আমলাতন্ত্রের খাঁচায় আবদ্ধ। কিন্তু ক্ষমতার লোভ এবং রাজনৈতিক ঐকমত্যের কারণে তারা আমলাতন্ত্রের শৃঙ্খল থেকে দেশকে মুক্ত করতে পদক্ষেপ নেননি। বরং রাজনৈতিক বিভেদ বা অনৈক্যের কারণে আস্তে আস্তে আমলাতন্ত্রের শিকল সুদৃঢ় হয়েছে। এখন সময় এসেছে, সংস্কারর করার এরকম সুবর্ণ সুযোগ হয়তো আর আসবে না।
ড. এম এল আর সরকার : প্রফেসর, ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
lrsarker@yahoo.com