Logo
Logo
×

বাতায়ন

সার্ক সক্রিয়করণে বাংলাদেশকেই নেতৃত্ব দিতে হবে

Icon

ড. মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম

প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সার্ক সক্রিয়করণে বাংলাদেশকেই নেতৃত্ব দিতে হবে

আন্তঃআঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ছিলেন এর স্বপ্নদ্রষ্টা। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় সার্কের প্রথম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আঞ্চলিক এ সংস্থাটির লক্ষ্য ছিল সদস্য দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও বিশ্বাস গড়ে তোলা। দীর্ঘস্থায়ী সংকট ও সম্পর্কে টানাপোড়েনের কারণে বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সার্কের অগ্রগতি ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

দুঃখের বিষয় হলো, নেপালের কাঠমান্ডুতে সার্কের সর্বশেষ শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রায় দশ বছর পেরিয়ে গেছে। এরপর কার্যত কোনো সম্মেলন কিংবা সংকট সমাধানে সফল পদক্ষেপ নিতে পারেনি সংস্থাটি। দীর্ঘদিন ধরেই এটি একটি অকার্যকর ও অপ্রয়োজনীয় সংস্থা হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে। আঞ্চলিক সহযোগিতার জন্য অনুকূল পরিবেশ এবং পর্যাপ্ত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রনায়করা পুরোপুরি এ সুযোগকে কাজে লাগাতে পারছেন না।

সার্কের এ অচলাবস্থার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। তবে এর মধ্যে অন্যতম কারণ ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব এবং সার্কভুক্ত অঞ্চলে ভারতের ‘বিগ ব্রাদার’সুলভ মনোভাব। বিশেষজ্ঞদের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার শক্তিশালী ও জনবহুল দেশ হওয়া সত্ত্বেও ভারতকে তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো অবিশ্বাসের চোখে দেখে। ভারত ও তার প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থার অভাবে সার্কের কার্যকারিতা আরও জটিল হয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞদের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, আঞ্চলিক অখণ্ডতা বজায় রাখতে এবং দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধিতে ভারতের অগ্রণী ভূমিকা পালনের সুযোগ রয়েছে।

ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মতো সার্কের ধারণাটি হলো একটি একীভূত বাজারব্যবস্থা। দুর্ভাগ্যবশত, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক পরিপূরকতার তীব্র অভাব রয়েছে। প্রায় প্রতিটি দেশ তুলা, পাট, মশলা ইত্যাদি পণ্য রপ্তানি করে থাকে। এ কারণে দেশগুলোর বাজারব্যবস্থা অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক। এ ছাড়া এ অঞ্চলটির আন্তঃবাণিজ্য খুবই নগণ্য, যা দেশগুলোকে অর্থনৈতিকভাবে একত্রিত হওয়ার পথে বাধার সৃষ্টি করছে।

বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সার্ক কার্যকর করা আবশ্যক। দীর্ঘদিন অচলাবস্থা শেষে এখন সার্ক এমনভাবে কার্যকর হওয়া প্রয়োজন, যাতে পুরো অঞ্চল উপকৃত হয়। পাশাপাশি মানুষে-মানুষে যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং দক্ষ বাণিজ্য সংকটের সহজ সমাধান হওয়া প্রয়োজন। সমগ্র অঞ্চলেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের নিরবচ্ছিন্ন জোগান থাকা আবশ্যক। টেলিকম থেকে রেলপথ কিংবা মহাসড়ক থেকে সামুদ্রিক অবকাঠামোর সবকিছুই এ জোগানের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। এ অঞ্চলের সহযোগী দেশগুলো খুব কাছাকাছি অবস্থিত হওয়ায় দ্বন্দ্ব-সংঘাত হ্রাস, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য আন্তঃসীমান্ত সহযোগিতা আরও বৃদ্ধি করতে হবে।

কিছু হতাশাজনক কারণ সত্ত্বেও আঞ্চলিক সংহতি বৃদ্ধিতে সার্কের সাফল্যের সম্ভাবনা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। নোবেলবিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাধ্যমে সেই সম্ভাবনা আবার নতুন করে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ সার্ক বিষয়ে সবসময়ই চিন্তাশীল এবং সার্ককে একটি বিকশিত আঞ্চলিক সংগঠন হিসাবে দেখতে চায়। সার্ক সনদের লক্ষ্য ও নীতিগুলো সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ সবসময় নিবেদিত। সার্কের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীতার ব্যাপারে বাংলাদেশ সর্বদা সচেতন। তবে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর দৃঢ় ইচ্ছাশক্তিই নির্ধারণ করবে আগামীতে সার্ককে রক্ষা করা হবে কিনা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা তার অগ্রগামী চিন্তাধারার জন্য প্রশংসার দাবিদার।

একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সার্কভুক্ত অধিকাংশ দেশ ভারতের সীমান্তবর্তী। আঞ্চলিক গতিশীলতার পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো সন্দেহাতীতভাবেই বাস্তবিক কাজের প্রতি বিশ্বাসী হবে। এতে পারস্পরিক সহযোগিতাকে শক্তিশালী করার জন্য বিতর্কিত সমস্যার সমাধান আরও বিলম্বিত হবে। তাই ভারতের এ অঞ্চলে উন্মুক্ত চিন্তা নিয়ে প্রবেশ করা, পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থান থেকে সরে আসা এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে নিয়ন্ত্রণহীনতা এবং নিরবচ্ছিন্ন প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা উচিত।

নানা সংকট থাকা সত্ত্বেও আশার ব্যাপার হলো, সার্ক পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়নি। তা সত্ত্বেও সার্কের মধ্যে যে কোনো অগ্রগতি বা উন্নতি এ অঞ্চলে কৌশলগত কর্মকাণ্ডে কোনো বাধা সৃষ্টি করবে না-এ নিশ্চয়তা দেওয়া জরুরি। এ লক্ষ্যে এখনো অনেক কাজ বাকি রয়েছে। যৌক্তিক উপায়ে আলোচনা চলতে থাকলে সেগুলো সম্ভাবনায় পরিণত হতে পারে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বন্দ্ব কিংবা যে কোনো দুই সদস্য দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব যেন সার্কের অন্যান্য সদস্য দেশের মধ্যে একসঙ্গে কার্যকরভাবে কাজ করার পথে বাধা সৃষ্টি করতে না পারে, সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে।

আঞ্চলিক সহযোগিতা মূলত ভৌগোলিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝা যায়। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, আসিয়ান ও সার্কের সক্রিয়কালীন কার্যক্রম থেকে তা স্পষ্টভাবে লক্ষ করা যায়। এ অঞ্চলের অতীত সাফল্য ও ব্যর্থতাগুলোকে পেছনে রেখে সমন্বিত কাজে যুক্ত হওয়া এবং সহযোগিতা করার জন্য বেশি বেশি সম্মেলনের আয়োজন করতে পারলে তা সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের জন্য কল্যাণকর হবে। এ লক্ষ্যে সদস্য দেশগুলোকে অবশ্যই একযোগে কাজ করতে হবে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের নবগঠিত সরকারের জন্য সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার বিশাল সুযোগ রয়েছে, যা এ অঞ্চলের অগ্রগতি, শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

ড. মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম