Logo
Logo
×

বাতায়ন

বিপ্লবী তারুণ্য যেন পথ না হারায়

Icon

এ কে এম শাহনাওয়াজ

প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিপ্লবী তারুণ্য যেন পথ না হারায়

সফল গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা এ দেশের কিশোর-তরুণদের নতুনভাবে আবিষ্কার করেছি। অন্যায়ের প্রতিবাদে ও দেশপ্রেমের শক্তিতে ওদের ভেতরের দ্রোহ মৃত্যুকেও পরোয়া না করতে শিখিয়েছে। এমন আত্মশক্তি যে তরুণ সমাজের, সে তারুণ্যকে রুখবে কে!

তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এ শক্তিকে জাগিয়ে রাখতে পারা। এ সত্য মানতে হবে, একটি বড় গণবিপ্লবের মাধ্যমে সরকার নামিয়ে ফেলা এক বিষয় আর নতুনভাবে রাষ্ট্রকে সংস্কার করে, প্রশাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা আনা ও প্রত্যাশা অনুযায়ী সরকার পরিচালনা করা আরেক বিষয়।

আরেকটি ভয়ের ব্যাপার হচ্ছে, একটি বড় বিপ্লব ঘটে গেলে বিপ্লবোত্তরকালে বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী কারও কারও মনে যে উত্তেজনা বিরাজ করে, একে যদি যৌক্তিকভাবে প্রশমিত করতে না পারা যায়, তবে বড় অনর্থ ঘটার আশঙ্কা থাকে। এছাড়া আরেকটি সমস্যা হলো, বিপ্লবের সঙ্গে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট না থাকা পক্ষের কেউ কেউ এ বিপ্লবী তরুণদের আবেগকে ব্যবহার করে নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চাইতে পারে। ফলে সব ক্ষেত্রে লাগামটানার জন্য দায়িত্বশীলদের সতর্ক থাকতে হয়; কিন্তু দিন দিন এক্ষেত্রে হতাশার চিত্র দেখতে পাচ্ছি।

বাড়াবাড়ির ফল কী হয় তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীরা। ১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধের পরপর স্বাধীন বাংলাদেশকে মহাসংকট অতিক্রম করতে হয়েছিল। অস্ত্র হাতে থাকা অনেক মুক্তিযোদ্ধা নিজেদের উজ্জ্বল অবয়বে কালিমা লাগিয়ে ছিলেন। শত্রু নিধনে গুপ্তহত্যা শুরু করেছিলেন কেউ কেউ। লুটপাটের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন অনেকে। এমন সংকটের প্রতিক্রিয়ায় খান আতাউর রহমান নির্মাণ করেছিলেন ‘আবার তোরা মানুষ হ’ চলচ্চিত্র।

সরকার পতনের পর থেকে বিপ্লবী তারুণ্য চাঁদাবাজ, ঘুসখোরদের বিরুদ্ধে তৎপর হয়েছিল। এসব তৎপরতাকে মানুষ সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু দিনে দিনে মনোযোগ অন্যদিকে চলে যাওয়ায় বিএনপি ও ছাত্রদল-যুবদলের নামে নানা জায়গায় চাঁদাবাজি-দখলদারির কথা পত্রিকার পাতায় ছাপা হচ্ছে। সেসব প্রতিহত করতে শিক্ষার্থীদের সংঘ শক্তিকে আর তেমনভাবে দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের অনেককে অপমানজনকভাবে পদত্যাগ করানোয় মত্ত থাকা শিক্ষার্থীদের দেখে ওদের মহান বিপ্লবের সারথি রূপের সঙ্গে মেলানো যাচ্ছে না। বিপ্লবী কিশোর-তরুণরা সাধারণ মানুষের মনে যে সম্ভ্রম ও স্নেহের জায়গা তৈরি করেছে, তাতে একটু একটু ফাটল ধরছে। এমন অবস্থা কাম্য হতে পারে না।

আমাদের মনে হচ্ছে, সরকার পরিচালক সম্মানিতরা এ তরুণ শক্তিকে সঠিক পথ দেখাতে তেমন ভূমিকা রাখছেন না। বিপ্লবোত্তরকালে শিক্ষার্থীদের কোন পথে হাঁটা উচিত এর দিকনির্দেশনা প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্য উপদেষ্টাদের দেওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে তা দেখতে পাচ্ছি না। সফল বিপ্লবের ১ মাসের মধ্যেই শিক্ষার্থীদের কোনো কোনো তৎপরতা নিয়ে অনেকে সমালোচনা শুরু করছেন, যা মোটেও কাম্য নয়। এর সুযোগ নেবে নানা অপশক্তি। এ কারণে আমার মনে হয়, সব পক্ষেরই সতর্ক হওয়া জরুরি।

একটি সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য আমাদের প্রয়োজন শিক্ষিত, দায়িত্বশীল সংস্কৃতিবান তারুণ্যের শক্তি। এ দেশের ঐতিহাসিক বাস্তবতায় সমরে-সংকটে ওরা জেগে উঠবেই। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়াটা ওদের স্বভাবজাত। কিন্তু এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ওদের পিঠ চাপড়ে বাহবা দেওয়ার পাশাপাশি সতর্ক দৃষ্টি রাখা, ওরা যাতে পথ না হারায়। যাতে বুঝতে পারে কোথায় ওদের থামা উচিত।

বুঝতে হবে এ সফল আন্দোলন শুধু শিক্ষার্থীরা করেনি। আমজনতাও এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। একইভাবে আত্মত্যাগ করেছেন তারা। অনেক পেশাজীবী আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের ছোড়া গুলিতে নিহত হয়েছেন। অনেকে আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। এদের বড় অংশ নিম্ন আয়ের মানুষ। অনেকের সংসারে অন্ধকার নেমে এসেছে। যদিও সরকারিভাবে এদের চিকিৎসা খরচ মেটানোর কথা শুনেছি। কিন্তু টিভি রিপোর্টে অনেক পরিবারের আর্তনাদ দেখতে পাচ্ছি। আজ পর্যন্ত আহতদের একটি বিস্তারিত তালিকা দেখতে পেলাম না। অনেকে হয়তো হাসপাতালে চিকিৎসায় সরকারি সহযোগিতা পাচ্ছেন; কিন্তু এদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার দায়িত্ব সরকার কীভাবে গ্রহণ করবে এর স্পষ্ট ব্যাখ্যা আমরা পাইনি। অনেক পরিবারের একমাত্র উপার্জনের মানুষটি শহিদ হয়েছেন, পঙ্গু হয়ে গেছেন। এসব অসহায় পরিবারের পাশে সরকার কীভাবে দাঁড়াবে এরও সুস্পষ্ট ঘোষণা আমরা পাইনি। গণআন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছাত্র নেতৃত্বের উচিত এসব বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্ত চাওয়া।

পুরো গণআন্দোলনের ভেতর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছিল। গণতন্ত্রের বড় নিয়ামক নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। মানছি, একটি বড় গণআন্দোলনের পর উত্তেজনা বিরাজ করে। তাই আন্দোলনের পর উত্তেজিত ছাত্র-জনতা স্বৈরাচারের প্রতীক ভেবে গণভবন ভেঙেছে। সঙ্গে মিশে থাকা দুর্বৃত্তরা লুটপাট করেছে। বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাড়ি এ দেশের দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ঐতিহাসিক বস্তুগত দলিল। এটি আর শেখ হাসিনার বাড়ি নয়। ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানে আছে বাড়িটি। সবচেয়ে বড় কথা, এখানে ছিল মুক্তিযুদ্ধসংশ্লিষ্ট একটি মূল্যবান সংগ্রহশালা। এ জাদুঘরটি আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়ায় পৃথিবীর সব সভ্য মানুষই ব্যথিত হবেন। হাজার বছর আগে হালাকু খান বাগদাদের লাইব্রেরি-জাদুঘর আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিল। এখনো পৃথিবীর মননশীল মানুষ একে নিষ্ঠুর বর্বরতা হিসাবে বর্ণনা করে।

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, গণআন্দোলনে অংশ নেওয়া বিপ্লবীদের মধ্যে তৈরি হওয়া উত্তেজনা বড় জোর ২ সপ্তাহ স্থায়ী থাকে। এরপর ধীরে ধীরে আত্মচৈতন্যে ফিরে আসে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হচ্ছে গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। কিন্তু যখন দেখি, বিভিন্ন ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা ভিন্নমত পোষণকারী শিক্ষক-কর্মকর্তাদের ওপর চড়াও হচ্ছে, শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে লাঞ্ছিত করছে, তখন ভাবতে হয়, হয়তো ওদের শিক্ষায় কোথাও ঘাটতি রয়েছে অথবা কোনো সেয়ানা পক্ষ পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে।

তথ্য রয়েছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কোনো শিক্ষক-কর্মকর্তা আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন, তাই আন্দোলনের পাশে দাঁড়াননি। তাই বলে তারা পরিত্যাজ্য হবেন কেন? এমন শিক্ষা তো গণতন্ত্র দেয় না। দু-তিন প্রজন্ম আগে এ দেশের নব্বই ভাগ পরিবারই আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিল। না হলে ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অভ্রভেদী বিজয় হতো না। জামায়াতে ইসলামীর আমির রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে বললেন, আওয়ামী লীগকে তারা ক্ষমা করে দিয়েছেন। তবে এটি ঠিক, একই ধরনের প্রজ্ঞা আমরা বিপ্লবোত্তর সময়ে তরুণদের কাছ থেকে আশা না-ও করতে পারি। তারপরও এখন ভয় পাই, যখন শুনতে পাই ওমুক জনপ্রিয় শিক্ষক আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগ সরকারকে সমর্থন দেওয়ায় এখন লাঞ্ছিত হওয়ার ভয়ে ক্যাম্পাসে আসতে পারছেন না। আমার বন্ধুর মেয়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন। আওয়ামী লীগ পরিবারের মেয়ে হওয়ায় লাঞ্ছনার ভয়ে ইস্তফা দিয়ে চলে এসেছে। এখানেই আশা জাগানিয়া বিপ্লবী শিক্ষার্থীদের নিয়ে আমার শঙ্কা হয়। ওরা বয়স ও অভিজ্ঞতার কারণে পথ হারাচ্ছে না তো?

তারুণ্য যে উজ্জ্বল আলো জ্বেলে আমাদের নতুন পথের দিশা দিয়েছে, ওদের পরিচর্যা করা আমাদের কর্তব্য। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দ্রোহের আগুন ওদের বুকের ভেতরে প্রজ্বলিত থাকাটা খুব দরকার। এমন শক্তি সাধনা করে তৈরি করা যায় না; কিন্তু পদে পদে তো জটিল পথের আবর্তে পড়ছে ওরা। আমাদের রাষ্ট্রপরিচালনায় থাকা অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ববানরা এসব ব্যাপারে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে না। আওয়ামী লীগ সরকারের অপশাসনে ক্ষত-বিক্ষত দেশে রাষ্ট্রপরিচালনার মতো জটিল জায়গায় বসে যদি বারবার যাদের আন্দোলন ও ত্যাগের ফসল হিসাবে আপনারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়েছেন বলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে থাকেন, তবে এ প্রজন্মকে সঠিক পথের দিশা দেখাবে কে? কোনো বিষয়েই কেউ শেষ পণ্ডিত হয়ে যায় না। সবারই পথপ্রদর্শক লাগে। না হলে বিশ্বের দাপুটে ক্রিকেট টিমের বিশ্বখ্যাত ক্রিকেটারদের জন্য কোচ নিয়োগ করতে হবে কেন? আমরা চাই না, আমাদের কোনো বিভ্রান্তি আরব বসন্তের পরিণতি পাক।

২০১০-এ আরব বিশ্বের অনেক দেশেই তরুণদের বিপ্লব বিশ্বজুড়ে আশা জাগিয়েছিল। অনেক দেশে তরুণ বিপ্লবীরা সরকারের পতনও ঘটিয়েছিল; কিন্তু বিপ্লবের পর রাশ টানা যায়নি। পেছন থেকে যারা বিপ্লবীদের উত্তেজিত করেছিল, তারা এক সময় প্রকাশ্যে আসে। মিসরে ইসলামি ব্রাদারহুড আন্দোলনের ফসল নিজেরা ছিনিয়ে নেয়। এরপর আরও উত্থান-পতন ঘটে আরবের নানা দেশে। এসব অমোঘ বাস্তবতা আমাদের শঙ্কিত করে। আমরা চাই না এত রক্তদান, এত আত্মত্যাগ বিফলে যাক। এটি স্পষ্ট, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র থেমে নেই। তাই এ সময় যৌক্তিক পথে দৃঢ়তার সঙ্গে হাঁটাটাই জরুরি। সতর্ক থাকতে হবে, আমরা যাতে সরল পথেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারি।

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

shahnawaz7b@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম