বন্যা-পরবর্তী কৃষি পুনর্বাসন
মো. বশিরুল ইসলাম
প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বন্যা-পরবর্তী কৃষি পুনর্বাসনে সহায়তার জন্য শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা মাঠে ধানের চারা উৎপাদন করার জন্য বীজতলা তৈরির কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। বন্যা-পরবর্তী সময়ে কৃষককে সহযোগিতা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের অ্যাকাউন্টে এভাবেই লেখেন কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের অধ্যাপক ড. জামিলুর রহমান। গবেষণা মাঠে ধানের চারা উৎপাদনের জন্য বীজতলা তৈরির এলাকার ছবি জুড়ে দিয়ে তিনি আরও লেখেন, বীজতলায় আমন ধানের বিভিন্ন জাতের চারা যেমন- ব্রি ধান ৭৫, ব্রি ধান ২৩, বিনা ধান ১৭ বপন করা হবে। এ ছাড়া সবজি ফসলের চারা উৎপাদনের কাজও এগিয়ে চলছে। বাণিজ্য মেলার মাঠে ব্যাপক আকারে বিভিন্ন সবজির চারা উৎপাদন করা হবে।
লেখার শুরুতেই এ ধরনের উদাহরণ তুলে ধরার কারণ হচ্ছে, টানা ভারি বর্ষণ এবং ভারত থেকে আসা পানিতে দেশের ১১ জেলায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। চলমান বন্যায় দেশের ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জমির শাকসবজি, ধানসহ অন্যান্য ফসল ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। সবচেয়ে অসুবিধা গবাদিপশুর বাসস্থান নিয়ে। গোয়ালঘরসহ বসতভিটায় পানি ওঠায় গো-খাদ্যের অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। পশুর অসুখ-বিসুখ বেড়ে গেছে। যাদের পুকুরে মাছ ছিল, সেগুলোও ভেসে গেছে। এ অবস্থায় সবার আগে কৃষকের পাশে দাঁড়ানো উচিত। কৃষক যাতে টিকে থাকতে পারেন, বেঁচে থাকতে পারেন, সে লক্ষ্যে পরিকল্পনা করে এগোতে হবে।
সম্প্রতি বন্যাকবলিত আমার নিজ এলাকা কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা গিয়েছিলাম ত্রাণ দিতে। এ সময় দেখেছি মানুষ কত অসহায়। অনেক বাড়িঘর পানির নিচে চলে যাওয়ায় মানুষ গবাদিপশু নিয়ে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। অনেক আশ্রয়কেন্দ্রের মাঠে গবাদিপশু বেঁধে রাখা হয়েছে। কোথাও কোথাও উঁচু সড়কের ওপর বেঁধে রাখা হয়েছে। দানাদার খাবার খাওয়াতে না পেরে অনেকে কচুরিপানা খাওয়াচ্ছেন। পশুর পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা করতে না পেরে অনেকে অসহায় অবস্থায় রয়েছেন। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কৃষিবিভাগকে এখনই কৃষকের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদের প্রথম কাজ হবে ক্ষতির পরিসংখ্যান ও প্রকৃতি নির্ণয় করা। ২৪ আগস্ট সচিবালয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে বন্যাদুর্গত এলাকায় কৃষি খাতে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত পরিমাণ দ্রুত নির্ধারণ করে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও পুনর্বাসনের আহ্বান জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা।
বন্যার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ ও বন্যা-পরবর্তী করণীয় বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় ১২টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। সিদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছে অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায় আপৎকালীন বীজতলা তৈরির কাজ শুরু করতে হবে। আরও রয়েছে নাবি জাতের ধানের বীজ দেশের বন্যামুক্ত এলাকা থেকে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সরবরাহের উদ্যোগ গ্রহণ করার পরামর্শ। আমি মনে করি, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা মাঠে বন্যা-পরবর্তী সময়ে কৃষককে সহযোগিতার জন্য যেভাবে বীজতলা তৈরি করে চারা উৎপাদন করা হচ্ছে, এভাবে কৃষিসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কিংবা দেশের বিত্তশালীরা উঁচু এলাকায় বীজতলা তৈরি করে পরবর্তীকালে বন্যাকবলিত এলাকায় দিতে পারবেন।
আমরা দেখেছি, যে কোনো দুর্যোগে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানো এ দেশের মানুষের একটি চিরায়ত সংস্কৃতি। মানবিক সংকট যত বৃদ্ধি পায়, এ দেশের মানুষ তত ঐক্যবদ্ধ হয়। সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। চলমান বন্যায়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বন্যার্ত মানুষকে সহায়তা করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গণত্রাণ সংগ্রহ কার্যক্রমে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ঢল নেমেছে। শিক্ষার্থীদের এ উদ্যোগে অংশীদার হতে নগদ অর্থ, ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিতে আসেন অনেকেই। রাস্তাঘাটে, বাসা-বাড়িতে, যানবাহনে, দোকানে দোকানে ঘুরে ঘুরে নগদ অর্থ ও ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ করছেন তারা। সংগৃহীত ত্রাণ নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন দুর্গত এলাকায়। তবে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গণত্রাণ সংগ্রহ কার্যক্রমে পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় বীজতলা তৈরি করে কৃষকের জন্য চারা বিতরণের কার্যক্রমও নেওয়া যেতে পারে। এটা বন্যা-পরবর্তী সময়ে খাদ্য সংকট মোকাবিলায় অনেকাংশে ভূমিকা রাখবে।
ইতোমধ্যে বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। সেপ্টেম্বর মাসের পর বড় বন্যার প্রকোপ দেখা না গেলে এ ক্ষেত্রে আমন ধান নষ্ট হলেও ধান চারার সংস্থান করা গেলে পুনরায় স্বল্পমেয়াদি আমন ধান, যেমন- বিআর ৫, বিআর ২২, বিআর ২৩, ব্রি ধান ৩৪, ব্রি ধান ৪৬, ব্রি ধান ৭৫, বিনা ধান ১৭ জাতসমূহ বীজতলায় চারা উৎপাদন করে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রোপণ করা যাবে। কৃষক পর্যায়েও ধানের চারা ভাসমান পদ্ধতি বা দাপোগ পদ্ধতিতে উৎপাদন সম্ভব; এজন্য দরকার সরকারি সহযোগিতা। তবে কোনোভাবেই যেসব জমি থেকে বন্যার পানি সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেও সরে না যায়, সেসব জমিতে আমন ধান লাগানো ঠিক হবে না। কারণ, এতে ফলন মারাত্মকভাবে কমে যাবে এবং ওই জমিতে রবিশস্য সঠিক সময়ে চাষ করা যাবে না। কিন্তু যেসব জমির বন্যার পানি সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ের আগেই নেমে যাবে, সেসব জমিতে দ্বিতীয়বার চারা রোপণ উঁচু জমির ধানের কুশি উঠিয়ে প্রতি গোছায় ২-৩টি কুশি রোপণ করা যেতে পারে। যদি কুশির বয়স ১০-১২ দিনের মধ্যে হয়, তাহলে মূল গোছার তেমন ক্ষতি হবে না। লক্ষ রাখতে হবে, মূল জমির ধানের যে গোছায় কমপক্ষে ৬-৭টি কুশি আছে, সেখান থেকে দুটি কুশি তোলা যেতে পারে। এসব কুশি লাগানো গেলে তা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে নতুন কুশির জন্ম দেবে এবং কৃষক কিছুটা হলেও ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে। এছাড়া মাসকলাই জাতীয় ফসল নরম মাটিতে বিনা চাষেই করা যেতে পারে। একইভাবে গিমা কলমি, ডাঁটা, পালং শাক ইত্যাদির চাষ করা সম্ভব। অন্যদিকে বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর গবাদিপশুর রোগবালাই বেড়ে যায়। রোগবালাই থেকে রক্ষার জন্য বিশেষ নজর দিতে হবে।
আগামী রবি ফসলের বাম্পার ফলন না হলে কৃষকের দুর্ভোগের সীমা থাকবে না। কাজেই এখনই কৃষককে রবি ফসল, বিশেষ করে গম, ভুট্টা, আলু ও ডালের উন্নত চাষাবাদের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কৃষককে বীজসহ কৃষি উপকরণ আগাম সরবরাহ করতে হবে। চর এলাকার কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষককে কৃষি উপকরণের ওপর যথেষ্ট পরিমাণ ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষির ওপর ভর্তুকি হলো সরকারের প্রকৃত কৃষি বিনিয়োগ। অনেক সময়ই সরকারের কৃষি বিভাগের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা দুর্গমে কাজ করতে আগ্রহী হয় না। ফলে নতুন প্রযুক্তি থেকে প্রান্তিক কৃষক বঞ্চিত হয় বা বিলম্বে তা জানতে পারে। মনে রাখতে হবে, প্রান্তিক কৃষক কৃষিকাজ করতে নিরুৎসাহিত হলে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য তা হবে এক মারাত্মক হুমকি।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে যে কটি খাতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে, তার মধ্যে অন্যতম হলো কৃষি। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছর প্রায় ৬ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতির মধ্যে কৃষিতে ৪ থেকে ১৪ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। আর্থিক ক্ষতি মোকাবিলা করার জন্য যে বিমাপত্র গ্রহণ করা হয়, তা-ই হচ্ছে শস্যবিমা। শস্যবিমা করা থাকলে কোনো কারণে ক্ষতি হলে বিমা প্রতিষ্ঠান আর্থিক সহায়তা দেয়। তবে এ ক্ষেত্রে স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদে বিমার জন্য প্রিমিয়াম দিতে হয়। শস্যবিমার প্রচলন প্রথম জার্মানিতে শুরু হলেও পরে আমেরিকা, জাপান ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এর ব্যাপকতা লাভ করে। বর্তমানে প্রায় সব দেশেই শস্যবিমার প্রচলন আছে। আমাদেরও উচিত হবে কৃষককে দ্রুত শস্যবিমাসহ কৃষিবিমার আওতায় নিয়ে আসা। শুধু শস্যই নয়, কৃষির অন্যান্য উপখাত-গবাদিপশু ও মৎস্য খাতকেও কৃষিবিমার আওতায় আনা প্রয়োজন। যেহেতু নিচু এলাকায় প্রতিবছরই বন্যা দেখা দেয় এবং ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা আরও বৃদ্ধির আশংকা আছে, সেহেতু নিচু এলাকার কৃষি ব্যবস্থাপনার ওপর বিশেষ কৃষি প্রকল্প গ্রহণ করা উচিত।
বন্যা শুধু আমাদের ক্ষতিই করে না; উপকারও করে থাকে। যেমন বন্যার পানি আমাদের অপরিচ্ছন্ন এবং দূষিত পরিবেশকে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে দেয়। পানির সঙ্গে ভেসে আসা কোটি কোটি টন পলি আমাদের জমিকে সমৃদ্ধ করে। কিন্তু এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের করণীয় ঠিক করতে হবে। বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কমাতে আমাদের কোনো সীমাবদ্ধতা আছে কিনা, সেগুলোর প্রতিটি বিষয় খতিয়ে দেখতে হবে। আমাদের আরও বেশি সক্রিয়তা দেখাতে হবে বন্যা-পরবর্তী সময়ে।
কৃষককে পুনর্বাসনের জন্য কাউন্সেলিং করাতে হবে। পাশে দাঁড়িয়ে সাহস দিতে হবে। এ পর্যায়ে কৃষকের সবচেয়ে বেশি দরকার হয় আর্থিক ও মানসিক সাহায্য। টিকে থাকার জন্য গবাদিপশু পালন ও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত রাখতে হবে তাদের। যেসব প্রতিষ্ঠান কৃষককে সাহায্য করবে, তাদেরও আয়কর কমানোসহ প্রণোদনা দিতে পারে সরকার। বিশেষ করে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিতে হবে। আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষি ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে সরকারকে এখনই বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
সর্বস্বান্ত হওয়া কৃষকের জন্য শুধু ত্রাণ যথেষ্ট নয়; বন্যার পর কৃষককে তার কৃষিকাজের সঙ্গেই যতটা সম্ভব সম্পৃক্ত রাখাটাই আসল কথা। পাশাপাশি আয়ের বিকল্প উৎস তৈরির ব্যবস্থাও করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে ভর্তুকি দিতে হবে।
কৃষিবিদ মো. বশিরুল ইসলাম : উপ-পরিচালক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
mbashirpro1986@gmail.com