Logo
Logo
×

বাতায়ন

মানিকেরা যে কারণে পালান

Icon

এম আবদুল্লাহ

প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মানিকেরা যে কারণে পালান

‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান/অপমান হতে হবে তাহাদের সমান/মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছ যারে/সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান/অপমান হতে হবে তাহাদের সবার সমান’। রবিঠাকুর তার ‘অপমানিত’ কবিতায় বিধাতার পক্ষ থেকে অবধারিত অপমান ও রুদ্ররোষের কথা এভাবেই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

কাব্যাংশটি মনে পড়ল দেশ তোলপাড় করা একটি আটকের ঘটনায়। শুক্রবার রাতে সিলেটের কানাইঘাট সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় আটক হন সুপ্রিমকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। ১৬ বছরের আওয়ামী দুঃশাসনে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে কলঙ্কিত ও কলুষিত করার জন্য তিনি ব্যাপকভাবে আলোচিত-সমালোচিত। বহুল বিতর্কিত ও ধিকৃত এই বিচারকের আটক ও পরবর্তী কিছু ঘটনা টক অব দ্য কান্ট্রি শনিবার থেকে। ভাইরাল হয় প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তার কিছু বক্তব্য। আদালতে তোলার সময় জনরোষের শিকার হওয়ার ভিডিও অন্তর্জালে সয়লাব।

৫ আগস্টের অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা পালিয়েছেন ভারতে। তার অনুগামী হয়ে আরও অনেক রাজনৈতিক নেতাই ভারতে পালানোর চেষ্টা করে কেউ সফল হয়েছেন, কেউবা আটকা পড়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন বা অভ্যুত্থানে সরকারের পতন হলে পতিত সরকারের মন্ত্রী-নেতারা পলায়ন করেন, রোষানল থেকে বাঁচার প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন-এটা নতুন কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু বিচারকের মতো সাংবিধানিক পদধারী, পেশাজীবী, কথিত বুদ্ধিজীবীদেরও পালাতে হয় কেন, এ প্রশ্ন সামনে আসছে বেশ জোরেশোরেই।

চৌধুরী মানিক ধরা পড়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে খবর আসে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইসহাক আলী খান পান্না পালিয়ে ভারতে প্রবেশের পর মারা গেছেন। শুক্রবার মধ্যরাতে মেঘালয়ের শিলং পাহাড়ে ওঠার সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয় বলে তথ্য পাওয়া গেছে। আওয়ামী সরকার পতনের পর ভারতে পালাতে গিয়ে প্রথমে আটকা পড়েন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও ভোরের কাগজ পত্রিকার সম্পাদক শ্যামল দত্ত। আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভারতে যাওয়ার সময় ইমিগ্রেশন তাকে আটকে দেয়। দেশ ছাড়ার সময় ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও আটকা পড়েন অনেকে। প্রতাপশালী সেনা কর্মকর্তা, পুলিশ কর্মকর্তা, সাংবাদিক দম্পতি থেকে শুরু করে অনেকেই দেশ ছেড়ে পালানোর সময় আটক হন।

ক্ষমতার পালাবদলে বিচারক মানিকদের কেন জল-জঙ্গল পেরিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পালাতে হয়, সে বিশ্লেষণে যাওয়ার আগে শুক্রবার তার পলায়ন ও পাকড়াওর আলোচিত ঘটনায় চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।

সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে স্থানীয় জনতার সহায়তায় শামসুদ্দিন চৌধুরীকে আটক করে বিজিবি। পরে শনিবার সকালে তাকে কানাইঘাট থানায় হস্তান্তর করা হয়। বিকালে আদালতে তোলার পর তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। ৫৪ ধারায় মামলা দিয়ে তাকে আদালতে উপস্থাপন করা হয় বলে জানা গেছে। অবশ্য আটকের আগে এবং আদালতে তোলার সময় তিনি জনরোষে পড়েন। হন লাঞ্ছিত।

ডিম, জুতা, কিল, ঘুষি, লাথির আঘাত নিয়েই আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় দাম্ভিক এ সাবেক বিচারককে। পরে সেনা পাহারায় আদালত থেকে তাকে নিরাপদে বের করা সম্ভব হয়। পালানোর সময় সীমান্তে মারধরের সময় তার অণ্ডকোষ আঘাতপ্রাপ্ত হয়। সিলেট ওসমানী মেডিকেলে শনিবার রাতে তার অস্ত্রোপচার শেষে সেখানে তিনি পোস্ট-অপারেটিভে রয়েছেন বলে সর্বশেষ খবরে জানা যাচ্ছে।

১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে সীমান্ত পার করে দেওয়ার জন্য স্থানীয় দালালদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন শামসুদ্দিন চৌধুরী। সীমান্ত পারও হয়ে গিয়েছিলেন। আটকের সময়ের দুটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে সীমান্তবর্তী এলাকায় ধারণ করা একটি ভিডিওতে শামসুদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘আমি এই দেশে (ভারত) এত কষ্ট করে এসেছি কি বাংলাদেশে ফেরত যাওয়ার জন্য?’

চৌধুরী মানিককে আটক করার পরের আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, একজন ব্যক্তি শামসুদ্দিনের গলায় থাকা গোলাপি রঙের মাফলার বা গামছা ধরে আছেন। তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করা হচ্ছে। শামসুদ্দিনকে তখন আতঙ্কিত, ভীত ও হতাশ দেখাচ্ছিল। ওই ভিডিওতে পালানোর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন-‘ভয়ে পালাইতেছি।’ ‘কার ভয়ে’ জিজ্ঞাসা করলে উত্তরে শামসুদ্দিন বলেন, ‘প্রশাসনের ভয়ে।’

পালানোর সময় সঙ্গে কী কী ছিল জানতে চাইলে মানিক বলেন, ‘আমার সাথে ছিল ব্রিটিশ পাসপোর্ট, বাংলা পাসপোর্ট, টাকা, কয়টা ডেবিট কার্ড আর ক্রেডিট কার্ড।’ এ সময় মারধর করে সঙ্গে থাকা ৬০-৭০ লাখ টাকা ‘দুই ছোকরা’ নিয়ে গেছে বলেও জানান তিনি।

স্বৈরশাসনকবলিত বিগত দেড় দশকের বিচারাঙ্গনে অনেক বিচারকই নীতি-নৈতিকতাবর্জিত আচরণ করেছেন। অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী না হওয়ার শপথ ভঙ্গ করেছেন। সরকারের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন ও প্রতিপক্ষকে নির্মূল ও নিপীড়নের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছেন। শাসকদের হুকুম তামিল করেছেন নির্বিচারে। তবে সবাইকে ছাড়িয়ে বিচারব্যবস্থা ধ্বংসে উদোম ও আগ্রাসী ভূমিকায় ছিলেন শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। পুরস্কারও বাগিয়ে নিয়েছেন দফায় দফায়। নিয়োগও স্থায়ীকরণে আনুকূল্য পেয়েছেন ব্রিটিশ এ নাগরিক। একুশজন সিনিয়র বিচারককে সুপারসিড করে আপিল বিভাগে পদোন্নতি পান।

বিচারক জীবনে শামসুদ্দিন চৌধুরী বহু মানুষকে অপমান করেছেন। অন্যদের হেয় করে পেতেন বিকৃত আনন্দ! কথায় কথায় ‘রাজাকার’, ‘রাজাকারের বাচ্চা’, ‘শান্তি কমিটির সদস্য’ ইত্যাদি ট্যাগ দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা ছিল তার বহুলচর্চিত কৌশল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তীব্র সমালোচক ছিলেন তিনি। এ নিয়ে পত্রিকার কলামে ও টকশোতে আক্রমণাÍক ভূমিকায় ছিলেন। রংপুরের পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদের মর্মান্তিক হত্যাকে তিনি ভিন্নভাবে চিত্রিত করার চেষ্টা চালান।

বিচারকের আসনে ছিলেন স্বেচ্ছাচারী। বোরকা পরতে বাধ্য করা যাবে না মর্মে আদেশ দিয়ে ধর্মীয় বিধানকে চ্যালেঞ্জ করেন। মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারকের সঙ্গে স্কাইপ কেলেংকারি ফাঁস হওয়ার পর সেটি সংবাদপত্রে প্রকাশ করা যাবে না বলে আদেশ দেন তিনি। স্কাইপ সংলাপ প্রকাশ করায় আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আদেশ দেন, পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধের নির্দেশনা দেন। পুলিশি নির্যাতনে সুপ্রিমকোর্টের অ্যাডভোকেট এমইউ আহমেদের মৃত্যুর পর ঘটনাটি ভিন্ন খাতে নিতে মানিক বলেন, বিভিন্ন রোগ থাকায় তার মৃত্যু হয়েছে। তারেক রহমানের বক্তব্য বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে প্রচারে দেন নিষেধাজ্ঞা।

রাজধানীতে সিগন্যালে গাড়ি আটকানোর কারণে এবং তাকে স্যালুট না দেওয়ায় ট্রাফিক পুলিশকে কান ধরে উঠবস করান, আদালতে তলব করে চরমভাবে অপমানিত করেন, আইজিপিকে চাকরিচ্যুত করতে বাধ্য করেন। বিদেশ ভ্রমণের সময় ইকোনমি শ্রেণির টিকিট কেটে জোর করে বিজনেস শ্রেণিতে গিয়ে বসে পড়েন, আবার বিজনেস ক্লাসে সিট না পেয়ে বিমানের এমডিসহ সবাইকে কোর্টে তলব করে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেন। চাকরি শেষে সরকারি বাড়ি না ছেড়ে জোর করে বসবাস করেন। বাড়িভাড়া ও ইউটিলিটির বিপুল অঙ্কের টাকা পরিশোধ না করেও পত্রিকার শিরোনাম হন তিনি।

সংসদের স্পিকার সম্পর্কেও কটাক্ষ করেন, তার এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। সংসদে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমেদ তাকে ‘স্যাডিস্ট’ হিসাবে অভিহিত করেন।

এক বক্তৃতায় বিচারপতি মানিক দম্ভভরে বলেছেন, ‘সাঈদীকে আমি ফাঁসি দিয়েছি।’ বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সম্পর্কে অনেক তাচ্ছিল্যপূর্ণ মন্তব্য করেন তিনি। বলেন-‘জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, ছিলেন পাকিস্তানের চর।’ এক মামলায় জিয়াউর রহমানকে ‘ঠান্ডা মাথার খুনি’ বলে অভিহিত করেন মানিক।

স্বৈরশাসনের দাসত্ব করে বিপুল অবৈধ সম্পদের মালিক বনেন। মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ রয়েছে শামসুদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে। আয়কর নথিতে তিনি দেখিয়েছেন লন্ডনে তার তিনটি বাড়ি রয়েছে। এ বাড়িগুলো মাত্র ৪০ লাখ টাকায় কেনার কথা উল্লেখ করলেও অনুসন্ধানে জানা যায়, পাচারের অর্থে কয়েকগুণ বেশি মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে।

আটকের আগে-পরে তিনি যে নিগৃহীত হলেন, জনরোষের শিকার হলেন, অপদস্থ হলেন, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আদালত প্রাঙ্গণে হামলাও সমর্থনযোগ্য নয়। যদিও কুষ্টিয়ার আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান সরকারদলীয় সন্ত্রাসীদের হামলায় রক্তাক্ত হলে বিচারক মানিকেরা উল্লসিত হয়েছিলেন। মানসিক বিকারগ্রস্তের মতো বিকৃত আনন্দে মেতেছিলেন।

বিচারের নামে প্রহসনকালে তাকে থামানোর তাগিদ অনুভব করেননি কেউ। সম্মানিত মানুষদের লাঞ্ছিত-অপমানিত করাকালে নিবৃত্ত করা হয়নি। অভিশংসনের আবেদন নেওয়া হয়নি আমলে। বরং উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। যথাসময়ে থামানো গেলে রাতের আঁধারে জল-জঙ্গল মাড়িয়ে সীমান্ত পথে অবৈধভাবে পালানোর চেষ্টা করতে হতো না। কলাপাতায় শুয়ে বাংলাদেশে ফিরতে অস্বীকৃতি জানাতে হতো না তাকে। প্রশাসনকে ভয় পাওয়ার কারণ ছিল না।

ক্ষমতার বর্ম পরে কলমে ও টকশোতে বীরত্ব দেখানো যায়, কিন্তু সীমালঙ্ঘন, অবিচার, পাপাচার, অনাচার একদিন কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি করে। দুর্নীতি ও লুটের অর্থ সঙ্গী করে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার অপচেষ্টাও হয়ে যায় ভণ্ডুল। কবি শঙ্খ ঘোষের ভাষায় ‘তুমি ভেবেছিলে অপমান ছুড়ে যাবে/দু’কথা শুনিয়ে সুখ পাবে ভেবেছিলে/চোখের আড়ালে অশ্বত্থের ডালে/ভেবেছ দু’পাখি মরে যাবে এক ঢিলে’।

এম আবদুল্লাহ : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সাবেক সভাপতি, বিএফইউজে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম