ফলপ্রসূ হোক পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের উদ্যোগ
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
প্রকাশ: ২২ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রতীকী ছবি
বেশ কিছুকাল ধরে দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে। অর্থ-ক্ষমতালিপ্সু মানুষদের আত্মতৃপ্তির কোনো সীমা নেই। যে কোনো অবৈধ-অনৈতিক পন্থায় অর্থ উপার্জনই ছিল তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। ব্যক্তিস্বার্থে, লোভলালসা চরিতার্থে জনগণের অর্থ-সম্পদ লুণ্ঠনে তারা বিন্দুমাত্র সংকোচবোধ করেনি। মৃত্যুভয়-পাপপুণ্য, দেশ-মানবপ্রেম কোনো ধরনের অনুভূতি ওই কদাচার মানুষদের স্পর্শ করেনি। কতিপয় রাজনৈতিক নেতার প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় এসব অপকর্ম সংঘটিত হয়েছে। অর্থ বিশ্লেষকদের মতে, অত্যন্ত নিকৃষ্ট অপকৌশলে ব্যাংকগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ করা ঋণখেলাপিরাই অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত। বিদেশে বাড়িঘর ক্রয়সহ সম্পদের পাহাড় গড়েছে এই অর্থ পাচারকারীরা। দুঃখজনক হলেও সত্য, বিভিন্ন সরকারি সংস্থার পক্ষ থেকে এসবের প্রকৃত চিত্র জনসম্মুখে আনা হয়নি। সংবাদমাধ্যমের নানা অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ভয়ংকর অর্থ পাচারের ঘটনা সম্পর্কে দেশবাসী অবগত হয়েছেন।
বিশেষ কিছু ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান পারস্পরিক যোগসাজশে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করেনি, বরং নানা অপকৌশলে পুনরায় ঋণপ্রাপ্ত হয়েছে। পুনঃতফশিলকরণের নামে সুদমুক্তি এবং অধিকমাত্রায় ঋণ প্রদানের অপসংস্কৃতি দেশের অর্থব্যবস্থাকে প্রায় পঙ্গু করে দিয়েছে। শেয়ারবাজার থেকে শুরু করে প্রতিটি খাত এদের করায়ত্ত ছিল। মানুষরূপী এসব দানব সম্পর্কে বিজ্ঞমহল সম্যক অবগত ছিল। কিন্তু দমন-পীড়ন-নিপীড়নের মাধ্যমে এবং নানাভাবে ফাঁসিয়ে দিয়ে এদের কণ্ঠরোধ করা হয়েছিল। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০০৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে ২৪টি বৃহৎ ব্যাংকে বড় ধরনের কেলেঙ্কারি হয়েছে। এতে অর্থ লোপাট হয়েছে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা এবং খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। সচেতন লেখক-সাংবাদিক-কলামিস্টরা এসব বিষয়ে প্রচুর লেখালেখি করেছেন। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, এসবের কিছুই আমলে না নিয়ে অপরাধীদের অর্থ পাচারের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। দেশবিধ্বংসী এসব কর্মযজ্ঞের কোনো বিচার হয়নি।
পক্ষান্তরে বিচারের দাবিতে যারা অগ্রগণ্য ছিলেন, তাদের নানাভাবে নাজেহাল হতে হয়েছে। কানাডায় বেগমপাড়া, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমসহ উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থ বিনিয়োগের বিনিময়ে নাগরিকত্ব গ্রহণের বিষয়টি বহুল আলোচিত। সংবাদমাধ্যমসহ বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, মালয়েশিয়া সরকারের ‘মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম’ প্রকল্পে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী, সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের আমলা, রাজনীতিকসহ কয়েক হাজার নাগরিক নিবন্ধন করেছেন। সেকেন্ড হোমের বাসিন্দাদের মতে, সেখানে প্রকৃত বাংলাদেশির সংখ্যা ১৪ থেকে ১৫ হাজারের মতো। তাদের অনেকেই বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার করে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছেন মালয়েশিয়ার কৃষিসহ বিভিন্ন খাতে। গড়ে তুলেছেন রেস্টুরেন্ট, পাঁচ তারকা হোটেল, গার্মেন্ট কারখানা, ওষুধ শিল্পসহ নানা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। অনেকে কুয়ালালামপুরে বড় বড় শপিংমলে দোকানও কিনেছে। দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি ন্যূনতম মমত্ববোধ এদের চরিত্রে পরিলক্ষিত হয় না। সম্পূর্ণ ব্যক্তি ও পরিবারের স্বার্থে দল ও সরকারের নানা পর্যায়ে ম্যানেজ করে তারা এসব অশুভ কর্ম সম্পন্ন করেছে।
অর্থ পাচার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক চারটি সংস্থার প্রতিবেদনে বাংলাদেশ থেকে ভয়াবহ টাকা পাচারের তথ্য নিয়মিত প্রকাশ পেয়েছে। সংস্থাগুলো হচ্ছে-ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শ প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই), সুইস ব্যাংক, ইউএনডিপি এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন আইসিআইজের পানাম ও প্যারাডাইস পেপার। ১৬ আগস্ট গণমাধ্যমে প্রকাশিত জিএফআইর প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে দেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ১১ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৭ বছরে পাচার হয়েছে প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা এবং ২০২৩ সাল পর্যন্ত পরবর্তী ৮ বছরে পাচার হয়েছে প্রায় ৬ লাখ কোটি টাকা, যার সিংহভাগ কানাডা-যুক্তরাষ্ট্র-সিঙ্গাপুর-যুক্তরাজ্য ও আরব আমিরাতসহ ১০ দেশে পাচার হয়েছে বলে সংস্থাটির ধারণা। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আমদানি ও রপ্তানির আড়ালে দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বিগত সরকারের কতিপয় প্রভাবশালী মন্ত্রী, এমপি, আমলারা এই বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারে জড়িত। সংস্থাটির মতে, পাচারকৃত অর্থের ৮০ শতাংশের বেশি পাচার হয় বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে। তাছাড়া অবৈধ হুন্ডি, বিটকয়েন বা ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমেও দেশ থেকে প্রচুর অর্থ পাচার হয়ে গেছে।
অর্থনীতিবিদরা বিগত সময়ে দেশ থেকে টাকা পাচারের পাঁচটি কারণ নির্দিষ্ট করেছেন। কারণগুলো হচ্ছে, দেশে বিনিয়োগের পরিবেশের অভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার শঙ্কা, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর দুর্বল নজরদারি, আইনের শাসনের ঘাটতি এবং বেপরোয়া দুর্নীতি।
বর্তমান ছাত্র-জনতার অসাধারণ গণঅভ্যুত্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। নেতৃত্বে রয়েছেন বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব শান্তিতে নোবেল জয়ী খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সরকারে যারা উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন, তারাও সততা-যোগ্যতা-দক্ষতা-দেশপ্রেমে ঋদ্ধ। সমগ্র রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিপূর্ণ মেরামতের প্রতিশ্রুতি ইতোমধ্যেই উচ্চারিত হয়েছে। জনগণের সার্বিক আস্থায় তারা কর্মকৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন অব্যাহত রেখেছেন। সব ধরনের শোষণ-বঞ্চনা-দুর্বৃত্তায়ন সংহার করে দেশকে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় পৌঁছানো অবশ্যই জরুরি। অবিচল নিষ্ঠার সঙ্গে কর্মকাণ্ড সম্পাদনে পর্যাপ্ত সময়েরও প্রয়োজন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটিয়ে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি অর্থব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় সংস্কারও জরুরি।
বিশ্লেষকদের দাবি, আন্তর্জাতিক আইনকানুন মেনেই পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরত আনা সম্ভব। পাশাপাশি সরকারের সদিচ্ছায় অর্থ পাচারের মূল কুশীলবদের ফিরিয়ে আনতে পাওয়া যাবে আন্তর্জাতিক সহায়তা। তারা সুইস ব্যাংকসহ বিভিন্ন বিদেশি ব্যাংকে কার কত টাকা রয়েছে, সেই তথ্য জানতে বর্তমান সরকারকে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। ১৪ আগস্ট মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসের অর্থায়ন প্রতিরোধে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা, নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় সমন্বয় কমিটির ২৮তম সভায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ উপদেষ্টা অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর বার্তা দিয়েছেন। তিনি অর্থ পাচারে জড়িতদের নামের তালিকা তৈরির নির্দেশনা দেন। পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনতে সংশ্লিষ্ট দেশের আইন পর্যালোচনার পাশাপাশি বিদ্যমান আইনগুলো খতিয়ে দেখতে বলেন। দেশে যাতে নতুন করে কালোটাকার জন্ম না হয়, সে ব্যাপারেও পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।
সভা শেষে সাংবাদিকদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘গত দুই বছর পর আমরা মিটিং করছি। আজকে মানি লন্ডারিং বিষয়সহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এটি দেশের স্বার্থে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর একটি বিষয়। কিছু গাইডলাইন লাগে, আইনের কিছু বিষয় থাকে, সেটা আমরা করব। এখন যে বিদ্যমান আইন আছে, সেটা যথেষ্ট ভালো। আপনারা সবকিছু নির্ভয়ে করবেন। আইন বিধিমালা ও দেশের স্বার্থে কাজ করবেন, ভয়ের কিছু নেই। অনেক স্পর্শকাতর বিষয় আছে, সেসব বিষয়ে ব্যবস্থা নেব। যারা ইতোমধ্যে অর্থ পাচার করেছে, তাদের বিষয়ে কিছু কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে, কিছু কিছু ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ হয়েছে। আমরা আমাদের দিক থেকে সব সময় চেষ্টা করব। কিছুদিন পর আবার রিভিউ মিটিংয়ে বসব কী কী করা হয়েছে এবং কী কী করা যেতে পারে।’
এদিকে গণমাধ্যমে দেওয়া এক বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নবনিযুক্ত গভর্নর বলেছেন, ‘পাচার করা টাকা ফেরত আনার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা হবে। টাকা ফেরত এলে তো ভালো, না এলেও টাকা পাচারকারীরা শান্তিতে ঘুমাতে পারবে না। শুধু সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক একা নয়; আন্তর্জাতিক মহলের সহায়তা নিয়ে অর্থ পাচারকারীদের ধরতে হবে। আমরা এমন একটা সিচুয়েশন তৈরি করব, যারা টাকা নিয়ে গেছে তারা যেন কষ্টে থাকে। তারা টাকার বিছানায় বালিশ দিয়ে যেন ঘুমাতে না পারে; এ ব্যবস্থা করব। একটু দৌড়াদৌড়ির মধ্যে থাকতে হবে। আন্তর্জাতিক আইন এখন কিছুটা সহায়ক আছে, এটাকেই কাজে লাগাতে হবে। টাকা আসুক আর না আসুক, তাদের কষ্টে রাখব।’
বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্থ পাচার রোধে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ একান্ত প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংক, বিশেষ করে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) বিশেষভাবে সক্রিয় হতে হবে। এছাড়াও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ এবং দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকেও সচেষ্ট হতে হবে। যেহেতু অর্থ পাচারের সঙ্গে হুন্ডির বিষয়টি সরাসরি জড়িত, সেহেতু হুন্ডি বন্ধেও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। প্রণোদনা সত্ত্বেও প্রবাসীরা কেন বৈধ চ্যানেলে অর্থ প্রেরণে উৎসাহী হচ্ছেন না, তা খুঁজে বের করতে হবে। টাকা পাচার প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধিসহ মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন, আমদানি-রপ্তানি নীতি, জয়েন্ট স্টক আইনসহ আরও যেসব আইন রয়েছে, সেগুলো যুগোপযোগী সংশোধন-বাস্তবায়নে জরুরি উদ্যোগ নিতে হবে। অর্থ পাচারকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা না হলে এ বিষয়ে কাঙ্ক্ষিত সুফল আসবে না। সামগ্রিক পর্যালোচনায় এটি স্পষ্ট, পাচারকৃত অর্থ আদায় করা গেলে দেশের অর্থ ব্যবস্থায় নতুন মাত্রা যোগ হবে। রাজস্ব আদায়সহ রাষ্ট্রের আয় বৃদ্ধিতে এসব উদ্যোগ দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : শিক্ষাবিদ; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়