শিক্ষাক্ষেত্রে অচলায়তন দূর হোক
মো. সরোয়ার উদ্দিন
প্রকাশ: ০৮ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সৃজনশীল পদ্ধতি, এনসিটিবি কর্তৃক ভুলসহ অনিয়মিতভাবে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ এবং প্রশ্নব্যাংক শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও সমস্যায় ফেলে দিয়েছে। এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছেন বহু শিক্ষার্থী। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ইংরেজি বিষয়ে মাত্র ২ জন পাশ করার দৃষ্টান্ত সেই দুঃখজনক বাস্তবতা জাতির কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছে।
করোনা অতিমারির জন্য এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল, এ মর্মে জাতীয় সংসদ কর্তৃক বিল পাশ ছিল দেশে প্রথমবারের মতো ইতিহাসে কোনো পাবলিক পরীক্ষায় অটোপাশের উদাহরণ। এর পরিণাম ‘নবম শ্রেণিতে পড়তে হবে অষ্টম শ্রেণির পড়া’। আর ‘অটোপাশের সাড়ে তিন লাখ এইচএসসিতে লাপাত্তা’। এসব দুঃখজনক চিত্র জাতির কাছে ফুটে ওঠে।
দেশের ৪৯টি কারিগরি (পলিটেকনিক) কলেজে ৭০ শতাংশ শিক্ষকের পদ শূন্য অবস্থায় একাডেমিক ও ব্যাবহারিক ক্লাসে সময় ও সংখ্যায় কমিয়ে কোনোভাবে সিলেবাসসহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে শিক্ষার্থীদের সনদ দেওয়া হচ্ছে। সমস্যা সমাধানের উপর্যুপরি প্রতিশ্রুতি আজও বাস্তবায়ন হয়নি।
দেশের সর্ববৃহৎ শিক্ষায়তন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে (কেবল ঢাকার ৮টি সরকারি কলেজ ছাড়া) সরকারি, আধা-সরকারি ও বেসরকারি কলেজ ইত্যাদির বেশির ভাগ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। দীর্ঘ অধ্যাপনার অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, একটি সরকারি মাস্টার ডিগ্রি কলেজে প্রতিবছর ব্যবস্থাপনা (সম্মান) প্রথম বর্ষে ২৬২ জন শিক্ষার্থী (এইচএসসি ও সমমানের চূড়ান্ত পরীক্ষায় জিপিএ’র ভিত্তিতে) ভর্তি করা হয়। অনার্স প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষে প্রতিদিন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের গড় উপস্থিতি সংখ্যা যথাক্রমে-৭০, ২০, ৭ ও ৫। মাস্টার্স শেষ পর্বে আজও কোনো শিক্ষার্থীকে ক্লাসে উপস্থিত দেখা যায়নি। কলেজের ব্যবসায় স্টাডিজ (প্রশাসন) ভবনে প্রত্যেক শ্রেণিকক্ষে সর্বোচ্চ ১০০ জন শিক্ষার্থীর জন্য বসার আসন ব্যবস্থা আছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন চূড়ান্ত লিখিত, ব্যাবহারিক ও মৌখিক এবং কলেজের ইনকোর্সসহ অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা; একাডেমিক কার্যক্রমসহ নানা অনুষ্ঠানের কারণে প্রয়োজনের চেয়ে কম সংখ্যায় ক্লাস পান শিক্ষার্থীরা। সিলেবাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অংশ ও অধ্যায় অজানাই থেকে যায় পরীক্ষার্থীদের জন্য। ঘাটতি পূরণসহ অপেক্ষাকৃত কম সময় ও পরিশ্রমে চূড়ান্ত পরীক্ষার প্রস্তুতি হিসাবে গাইড ও নোট বই অনুসরণ করা হয়। এসব বইয়ের বেশির ভাগই অসংগতিপূর্ণ, সংক্ষিপ্ত ও ভুলে ভরা।
বিশেষ কিছু কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গণিত, পরিসংখ্যান, কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি এবং এমআইএস ইত্যাদি টেকনিক্যাল ও জটিল বিষয়ের উত্তরপত্র মূল্যায়নে দায়িত্ব দেয় কিছু শিক্ষককে, যাদের অনেকেরই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জ্ঞানের ঘাটতি অথবা দীর্ঘদিন চর্চার অভাব রয়েছে। তাড়াহুড়া করে নির্দিষ্ট সময়ের ভেতর উত্তরপত্র মূল্যায়নে সঠিক, আংশিক ও ভুল উত্তরেও নম্বর প্রদান করায় অনেক দুর্বলও অপেক্ষাকৃত বেশি নম্বর পেয়ে যায়।
অনার্স চতুর্থ বর্ষ এবং মাস্টার্স প্রথম ও শেষ পর্বে ৫০ (প্রাইভেটের ক্ষেত্রে ১০০) নম্বরের মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয় সংশ্লিষ্ট কলেজের অভ্যন্তরীণ ও বহিঃপরীক্ষকের বোর্ডে। এক্ষেত্রে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী লিখিত পরীক্ষার বিষয়গুলোর শিরোনামও ঠিকমতো বলতে পারে না। এ পরিস্থিতিতে অতীত পরীক্ষার ফলাফল, ক্লাসের উপস্থিতি, অপেক্ষাকৃত সহজ বিষয়ের ওপর প্রশ্ন এবং মানবিক কারণ ইত্যাদি বিবেচনায় সম্মানজনক নম্বর প্রদান করে এ বোর্ড। এভাবে নিম্নমেধাবী এবং একাডেমিক দুর্বল শিক্ষার্থীরাও অনার্স ও মাস্টার্সের চূড়ান্ত পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হতে সক্ষম হয়।
দুর্বল ও নড়বড়ে শিক্ষাব্যবস্থায় অর্জিত ফলাফল/সনদের মান সন্তোষজনক ও আকাশচুম্বী হলেও বারবার বিসিএসসহ সম্মানজনক সরকারি চাকরিতে আবেদন ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে শিক্ষার্থীরা। কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে অধিকাংশই ব্যর্থ হয়ে অবশেষে বেসরকারি চাকরি গ্রহণ অথবা কতিপয় প্রার্থী এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের মধ্য দিয়ে সরকার কর্তৃক ঘোষিত ১০ শতাংশ কোটায় কেবল পিএসসি কর্তৃক মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সরাসরি সহকারী অধ্যাপক হিসাবে সরকারি কলেজে যোগদান করতে সক্ষম হন। অথচ সরকারি কলেজে চাকরি পেতে অনেক লেখাপড়া, সময় ও কষ্ট করতে হয়। যেমন-বিসিএস (বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস) কর্তৃক ঘোষিত বিজ্ঞাপনের আলোকে সব শর্ত পূরণ সাপেক্ষে আবেদনপত্র দাখিলের পর প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় ন্যূনতম নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হতে হয়। অতঃপর (ধারাবাহিকভাবে) লিখিত, মনস্তাত্ত্বিক ও মৌখিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে নির্ধারিত বিষয়ে কেবল শূন্য পদের বিপরীতে সুযোগ পেলেই সরকারি কলেজে প্রভাষক হিসাবে চাকরির সুযোগ মিলে। এছাড়াও এ চাকরিতে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনসহ পরবর্তীকালে পদোন্নতির জন্য আবশ্যকীয় বিধিবিধান ও নিয়মকানুন ইত্যাদির ওপর যথাযথ জ্ঞান ও যোগ্যতা অর্জনের জন্য (প্রথমে) বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ গ্রহণ, (পর্যায়ক্রমে) ডিপার্টমেন্টাল ও সিনিয়র স্কেল পরীক্ষায় মোট ৬টি বিষয়ের ওপর প্রত্যেকটিতে ১০০ নম্বরের ভেতর আলাদা ও পৃথকভাবে ন্যূনতম ৬০ শতাংশ নম্বর পেলেই কেবল উত্তীর্ণ হওয়া যায়। প্রতিবছরের জন্য বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে (এসিআর) কর্তৃপক্ষের সন্তোষজনক সুপারিশসহ নিরবচ্ছিন্নভাবে কমপক্ষে দুই বছরের চাকরিকালসহ উল্লিখিত সব শর্ত যথাযথভাবে পূরণ সাপেক্ষে ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং চাকরি স্থায়ীকরণ, অতঃপর ডিপিসির (ডিপার্টমেন্টাল প্রমোশন কমিটি) সুপারিশের ভিত্তিতে কেবল শূন্য পদের বিপরীতে সহকারী অধ্যাপক হওয়ার সুযোগ মেলে।
১০ শতাংশ কোটায় নিয়োগের পূর্বশর্ত ছিল, প্রার্থী যদি আগের কোনো বিসিএসএ নিয়োগপ্রাপ্ত হন। এক্ষেত্রে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে ওই (প্রথমবার নিয়োগে) বিসিএসের মেধাতালিকায় প্রথম আর যদি সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বশেষ বিসিএসের মেধা তালিকায় প্রথম স্থান পান, কেবল তখনই তারা সহযোগী অধ্যাপক হিসাবে সর্বশেষ পদোন্নতির সুযোগ পাবেন। কোনোভাবেই অধ্যাপক হিসাবে পদোন্নতি পাবেন না। অধ্যাপক হিসাবে পদোন্নতির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কতিপয় দুর্বৃত্তের সাহায্য ও কারসাজিতে এসব (১০ শতাংশ কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত) চতুর, বর্ণচোরা ও সুবিধাভোগী ১৬শ বিসিএসের মেধাক্রমের ১২ ও ১৩তম স্থানের মধ্যবর্তী স্থানে প্রবেশ করেন।
এরই একজন বর্তমানে বিভাগীয় প্রধান হিসাবে (নাম, বিভাগ ও কলেজের নাম গোপন রাখা হলো) দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি কোনো জরুরি কাজ ছাড়া সচরাচর রুটিন অনুযায়ী কেবল কলেজ বাসে আসা-যাওয়ার ভেতর সীমাবদ্ধ থাকেন। একাডেমিক বিষয়েও দুর্বল, যা অনেকেই জানেন। বিভাগে সব সুবিধা থাকা সত্ত্বেও কোনো উন্নতি নেই। আগের মতো সবকিছুই স্থবির ইত্যাদি। উল্লেখ্য, বিভাগের একজন অধ্যাপক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স শেষপর্বে প্রধান পরীক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালনকালে এক পরীক্ষকের নম্বরপত্র হারিয়ে যায় এবং অনেক খোঁজাখুঁজি-পরিশেষে ওই পরীক্ষকের দেওয়া তথ্যে জানা যায় বিভাগের একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী (মাস্টার রোল) রেজিস্ট্রিকৃত ডাকে নম্বরপত্রটি গ্রহণ করেছেন। এ ঘটনা বিভাগীয় প্রধানকে অবহিত করা হলে তিনি স্পষ্টভাবে জানান, ‘আমরা (ওই কর্মচারীসহ) একই জেলার মানুষ বিধায় কিছু বলতে ও করতে পারব না।’
বিভাগীয় প্রধান নিম্নমেধাবী হওয়ায় একাডেমিক ও সাধারণ বিষয়গুলোর ওপর জ্ঞান গ্রহণ করা সত্ত্বেও যথাযথভাবে মস্তিষ্কে আয়ত্ত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এছাড়াও সরকারি চাকরির বিধিবিধান ও নিয়মকানুন সম্পর্কে একেবারেই অজানা। যেহেতু কোটায় ১০ শতাংশ হিসাবে সরাসরি সহকারী অধ্যাপক নিয়োগপ্রাপ্ত হন, বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং ডিপার্টমেন্টাল ও সিনিয়র স্কেলের বিষয়গুলোর ওপর কোনো জ্ঞান না থাকায় সঠিকভাবে বিভাগ পরিচালনাসহ শিক্ষক ও কর্মচারী প্রত্যেককে যথাযথভাবে নিজ দায়িত্ব পালনসহ শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য পরিমিত জ্ঞান ও কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং আদেশ ও নির্দেশনা দিতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছেন।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় (দেশ ও বিদেশে) সর্বক্ষেত্রে, যথা: খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষা, বাসস্থানসহ পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা; বিচার, প্রশাসন ও নির্বাহী বিভাগ; সমাজ ও সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, সরকার ও নির্বাচন ইত্যাদি প্রত্যেক ক্ষেত্রে বাস্তবতার ভিত্তিতে উত্তম পরিকল্পনা প্রণয়ন, যোগ্য ও দক্ষ কর্মীবাহিনী তৈরি ছাড়াও কর্তব্যপরায়ণ, সৎ, সাহসী ও নিরপেক্ষ প্রশাসক ও নির্বাহী নিয়োগ নিশ্চিত করা দরকার। আধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন, উন্নয়ন, মেরামত ও ব্যবহারে সর্বোত্তম পদ্ধতিকে নির্বাচন, চূড়ান্তভাবে গ্রহণ এবং যথাযথভাবে প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে আইটি বিষয়ে যোগ্য প্রোগ্রামার, অভিজ্ঞ সিস্টেমস অ্যানালিস্ট এবং পর্যাপ্তসংখ্যক দক্ষ অপারেটর এবং আধুনিক ‘হার্ডওয়্যার’ ও ‘সফটওয়্যার’সহ ইঞ্জিনিয়ার তৈরি এবং ডিজিটাল সম্পর্কিত সব উপকরণ ন্যূনতম দামে পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহের নিশ্চয়তা কেবল মেধাবী ও একাডেমিক উচ্চশিক্ষিতরাই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ধারা চলমান রাখতে সক্ষম হবে। পক্ষান্তরে কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত অপেক্ষাকৃত নিম্নমেধাবী ও একাডেমিক জ্ঞানে দুর্বলরা স্থবিরতাসহ এলোমেলো এবং সুযোগ পেলে উন্নয়নকে চেপে ধরবে।
মো. সরোয়ার উদ্দিন : অধ্যাপক, সরকারি সা’দত কলেজ, করটিয়া, টাঙ্গাইল