মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি কেন এই মেধাহীনতার অপবাদ?
মো. আনছার আলী খান
প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের এত বড় সর্বনাশ হয়ে গেল, সেই কোটাব্যবস্থায় মোট ৫৬ শতাংশ কোটার মধ্যে ছিল ৩০ শতাংশ সুবিধাভোগী মুক্তিযোদ্ধা, তাদের সন্তান ও নাতি-নাতনি। কিন্তু বাস্তব প্রয়োগ কি তাই হয়েছে? মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয় হলেও স্বাধীনতার সৈনিকদের জীবদ্দশাতেই শুধু কোটা নয় বরং মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে অনেকেই প্রকাশ্যে অগ্রহণযোগ্য মন্তব্য করার সাহস দেখিয়ে চলেছেন। উদ্দেশ্যমূলকভাবেই মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরিপ্রাপ্তদের মেধাহীন বলে হেয় করার রীতি শুরু হয়েছে অনেক দিন আগে থেকেই। স্বাধীনতাযুদ্ধে বীরোচিত অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ স্বাধীনতা-উত্তর প্রশাসনে অতীব জরুরি প্রয়োজনে কর্ম কমিশন কর্তৃক সংক্ষিপ্ত পরীক্ষার মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা নিয়োগ করা হয়। উল্লেখ্য, রাতারাতি প্রশাসনিক সংস্কারের কারণে আশির দশকেও সিভিল সার্ভিসে বহুসংখ্যক সাধারণ প্রার্থী নিয়োগ করা হয়। তাদের অনেকেই প্রশাসনের শীর্ষ পদগুলোয় সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেলেও মেধাহীনতার অপবাদ দিয়ে স্বাধীনতা-উত্তর প্রশাসনে জরুরি প্রয়োজনে নিয়োগপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা কমকর্তাদের সে সুযোগ দেওয়া হয়নি। বরং তাদের অধিকাংশকেই ২৫ বছর চাকরি সমাপনান্তে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। এভাবে প্রশাসন থেকে মুক্তিযোদ্ধা বিতাড়ন করেই স্বার্থান্বেষী মহল ক্ষান্ত হয়নি, চাকরিরত মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের পদোন্নতিবঞ্চিত, ওএসডি, শাস্তিমূলক পদায়ন প্রভৃতি নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীকালেও মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তারা যাতে প্রশাসনের key পদ অর্থাৎ ইউএনও, জেলা প্রশাসক পদে পদায়িত না হতে পারেন, সেজন্য অযৌক্তিকভাবে সেসব পদে বয়সসীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এমনকি প্রশাসনের শীর্ষ পদ পর্যন্ত আসার আগেই যেন সব মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা চাকরি থেকে অবসরে চলে যান, সেজন্য সুকৌশলে তাদের পদোন্নতি প্রদান বিলম্বিত করা হয়।
সাধারণ চাকরিজীবীদের চাকরির বয়স বৃদ্ধির কৌশল হিসাবেই ২০১২ সালে প্রাথমিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের অবসরের বয়স ২ বছর বৃদ্ধি করে ৫৯ বছর করা হয়। এ কারণ দেখিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই সব চাকরিজীবীর অবসরের বয়স ৫৯ নির্ধারণ করা হলেও মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের ৫৯ বছরই থেকে যায়। পরে বহু দেনদরবার করে মাত্র ১ বছর অর্থাৎ ৬০ বছর করা হয়। এ বিষয়ে কোনো কোনো মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হন। দীর্ঘদিনের শুনানি শেষে মহামান্য আদালত মুক্তিযোদ্ধাদের অবসরের বয়স ৬৫ পর্যন্ত বিবেচনার বিষয়ে সরকারের নির্বাহী বিভাগকে পরামর্শ দেন। কিন্তু নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের চরম নেতিবাচক মনোভাবের কারণে তা নাকচ হয়ে যায়। এভাবেই বর্তমান প্রশাসন সম্পূর্ণভাবে মুক্তিযোদ্ধাবিহীন হয়ে পড়ে।
মেধাহীনতার অপবাদ নিয়ে দীর্ঘ চাকরিজীবনে মেধাবীদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে; কিন্তু যোগ্যতার মানদণ্ডে তাদের অধিকাংশের সঙ্গেই নিজেকে আলাদাভাবে ভাবতে পারিনি। কারণ মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পেলেও রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে বা লাইনে দাঁড় করিয়ে কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে চাকরি দেওয়া হয়নি। চাকরির জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ বিসিএস পরীক্ষার পূর্ণ সিলেবাসে প্রতিটি ধাপে লক্ষাধিক প্রার্থীর মধ্যে নিজ যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয়েছে। চাকরিজীবনেও বিভিন্ন প্রশিক্ষণসহ সরকারি কর্ম কমিশন পরিচালিত কয়েক স্তরের বিভাগীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই পদোন্নতির যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয়েছে। তাছাড়া কর্মক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের সন্তুষ্টি অর্জন করেই যোগ্যতার সিঁড়ি অতিক্রম করতে হয়েছে। এতকিছুর পরও মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের মেধাহীনতার অপবাদ দিয়ে স্বার্থান্বেষী মহল তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে অনেকখানিই সফল হয়েছে। তাদের এ অপচেষ্টায় রসদ জুগিয়েছে সব সময়ের সুযোগসন্ধানি মহল, যারা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংরক্ষিত ন্যূনতম সুবিধা ভোগ করার জন্য নানা অপকৌশলে মুক্তিযোদ্ধার সনদ সংগ্রহ করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মানের কাতারে দাঁড় করিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এতকিছু করা হলেও সরকারি চাকরিতে তাদের ৩০ শতাংশ কোটা ও কোটা প্রয়োগের প্রকৃত চিত্র কখনোই প্রকাশ করা হয়নি। প্রমাণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৮৫ সালের বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে ৫৫০ জনের ৩০ শতাংশ হিসাবে মোট ১৬৫ জন নিয়োগের সুযোগের বিপরীতে নিয়োগ দেওয়া হয় মাত্র ৬০ জন। এ সংখ্যা মোট নিয়োগের প্রায় ১১ শতাংশ। এ তথ্য কখনোই প্রকাশিত হয়নি। শুধু এই একটি ব্যাচ নয়, সব সময়ই সব চাকরিতে সংরক্ষিত কোটা পূরণ করা হয়নি। যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যায় না, এ অজুহাতে এমনটি করা হয়েছে কি না, তা কখনোই প্রকাশ্যে আনা হয়নি। কোটা আন্দোলন চলাকালে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগের শতকরা হার ৩০ শতাংশের বিপরীতে ৮.৭ শতাংশ। বাকি ২১ শতাংশসহ ৪৪ শতাংশ অর্থাৎ ৬৫ শতাংশ মেধা কোটায় নিয়োগ চলমান থাকার পরও মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সর্বাধিক নিয়োগের যে অপপ্রচার, তা এ আন্দোলনের কোনো পূর্ব ষড়যন্ত্র কি না, ভেবে দেখার বিষয়। ২০১৮ সাল থেকে কোটাবিরুদ্ধ জোরদার আন্দোলনে সব কোটা বাতিল করার সময়ও কোটা প্রয়োগের প্রকৃত তথ্য আড়াল করে রাখা হয়েছে। মাত্র ৪৪ শতাংশ মেধা কোটার বিষয়টি যেমন কোমলমতি ও আবেগপ্রবণ শিক্ষার্থীরা মেনে নিতে পারেনি, তেমনইভাবে তাদের অভিভাবকরাও নিজের সন্তানের ভবিষ্যৎ ভেবে কোটা সুবিধাভোগীদের প্রতিপক্ষ ভেবে বসেছেন। সাধারণ মানুষও তাদের যৌক্তিক দাবির প্রতি সমর্থন জুগিয়েছেন। এ দাবির যৌক্তিক সমাধান সরকারের হাতে থাকা সত্ত্বেও প্রকৃত তথ্যের অভাবে সময়মতো তা করা সম্ভব হয়নি। এ সুযোগটি কাজে লাগিয়ে দেশ ও জাতির ভাবমূর্তিসহ যে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ সাধিত হয়েছে, তা সংশ্লিষ্ট মহলগুলোর জন্য একটি চপেটাঘাত।
১৯৭১-এ যাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সামর্থ্য ছিল; কিন্তু নানা কারণ বা অকারণে মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেননি, তাদের অপরাধবোধে ভোগার কথা থাকলেও তাদের অনেকে মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রেষ্ঠ এ অর্জন নানাভাবে নস্যাৎ করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছেন। তারাসহ নানা মহলের দীর্ঘদিনের হেলাফেলার কারণে মেধাহীন অপবাদ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তক্ষরণ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা কীভাবে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানের মর্যাদাপ্রাপ্ত, তা নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। ‘বীর নিবাস’ প্রকল্পে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরবর্তী প্রজন্মের একটি স্থায়ী ঠিকানার ব্যবস্থা হলেও যখন শোনা যায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আর কত, তখন কি এটা প্রমাণ হয় না যে, এসব ন্যূনতম সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রকারান্তরে করুণার পাত্র হিসাবে অবজ্ঞা করা হচ্ছে!
হালনাগাদ তথ্যানুযায়ী, জীবিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বর্তমানে ৯৫,০০০। তাদের ন্যূনতম বয়স ৬৪ বছর। বয়সের ভারে সবাই ন্যুব্জ। জাতীয় গড় আয়ু ৭২ বছর হিসাবে আর মাত্র ৮ বছর পর কোনো মুক্তিযোদ্ধা জীবিত থাকলে তা ব্যতিক্রম। সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যক্রমে কেউ জীবিত থাকলেও রাষ্ট্রের জরুরি প্রয়োজনে হারিকেন দিয়ে তাদের খুঁজতে হবে। এ পরিস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ কেবল তাদের প্রতি প্রতীকী সম্মান, যা কখনোই পূরণ হবে না। কারণ ৬৪ ও তদূর্ধ্ব বয়সের বৃদ্ধের চাকরিপ্রার্থী সন্তানের সংখ্যা ১-২ শতাংশ হলেও হতে পারে। তাই বলতেই হয়, ‘দাঁত থাকতে বাঙালি দাঁতের মর্ম বুঝল না’-এ প্রবাদটি কি মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে?
স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশে যে বাঙালি জাতির নুন আনতে পান্তা ফুরাত, ঘরে একটি কুপি জ্বালানোর সামর্থ্য ছিল না, একটি কেরানির চাকরি যাদের অধিকাংশের কাছে ছিল সোনার হরিণ, মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে শিক্ষা, চিকিৎসা যেখানে ছিল বিলাসিতা, সে জাতির মর্যাদা আজ বিশ্বস্বীকৃত। কৃষিক্ষেত্রে বিশেষ নজর দেওয়ার কারণে দেশ আজ খাদ্যে স্বনির্ভর। প্রত্যন্ত গ্রামের ঘরে ঘরে বিজলি বাতি, হাতের কাছে স্কুল-কলেজ, সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনের শীর্ষ পদগুলোয় নিজ দেশের মেধাবী সন্তান, দেশের আনাচে-কানাচে উন্নয়নের ছোঁয়া, উন্নত দেশের সুযোগ-সুবিধা গ্রহণে বাঙালি জাতি আজ অভ্যস্ত। দেশের উন্নয়নকে টেনেহিঁচড়ে নিচে নামানোর বারবারের অপচেষ্টা সত্ত্বেও দেশের উন্নয়ন, দেশের মানুষের সার্বিক উন্নয়ন অনেক দেশের ঈর্ষার কারণ হয়েছে। দেশ স্বাধীন না হলে কী অবস্থায় থাকতাম, আমার তা বুঝতে কষ্ট হয় না, যখন পাকিস্তানের অভিজ্ঞজনদের বলতে শোনা যায়, বাংলাদেশের মতো উন্নত দেশ চান তারা।
এতকিছুর পরও কোন পাপে স্বাধীনতার সূর্যসন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জীবদ্দশায় তাদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ দেখতে হচ্ছে জাতিকে। স্বাধীনতার স্থপতিকে রক্ষা করতে না পারার পাপ, তার সুযোগ্য কন্যা, যার হাত ধরে আমাদের গৌরবময় উন্নয়ন, তাকে বারবার হত্যাচেষ্টার পাপ, অকাট্য সত্যকে মিথ্যার চাদরে ঢেকে দেওয়ার পাপের প্রায়শ্চিত্ত প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম করতে পারে না। আমাদের জীবদ্দশায়ই এর শেষ দেখতে চাই আমরা। এ দেশের স্বল্প পরিমাণ উর্বর মাটি ১৮ কোটি জীবনের আহার জোগায়। দলমতনির্বিশেষে সে মাটিতে কান পেতে শোনার সময় হয়েছে-আর কোনো রক্তপাত নয় এ মাটিতে। কারও ভুলে সন্তানহারা মায়ের করুণ আর্তনাদে আসমান যেন কেঁপে না ওঠে। অভিসম্পাত বর্ষিত হয় না যেন দেশ ও জাতির ওপর। সে অভিশাপ থেকে মুক্তি চাই আমরা। স্বাধীন দেশের স্থপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ স্বাধীন দেশ তার সারা জীবনের স্বপ্নের ফসল। তার স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ বিনির্মাণে এ দেশকে সব মানুষের জন্য নিরাপদ আবাস হিসাবে গড়ার দায়িত্ব পালন কেবল বঙ্গবন্ধু কন্যার পক্ষেই সম্ভব। সে প্রজ্ঞা তার রয়েছে, এ বিশ্বাস সব মুক্তিযোদ্ধার।
সবার জন্য নিরাপদ এ দেশে বীর মুক্তিযোদ্ধারা জীবনের শেষ কটা দিন কোনোরূপ আতঙ্কে থাকবেন না, কোনোভাবে কারও করুণার পাত্র হবেন না, কোনো অনুকম্পা নয় বরং বীরের প্রকৃত মর্যাদায় মর্যাদাবান হবেন-এ প্রত্যাশা অবশ্যই বেশি কিছু নয়। এ প্রত্যাশাটুকুর স্থায়ী বাস্তবায়ন করার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ বড়ই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এটা সম্ভব হলে জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সঙ্গে ৩০ লাখ শহিদের বিদেহী আত্মাও শান্তি পাবে।
মো. আনছার আলী খান : মুক্তিযোদ্ধা, অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব